রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

মেঘনায় সারবোঝাই বাল্কহেডে ডাকাতি: নৌ শ্রমিক পরিচয়ের আড়ালে সক্রিয় ১৪ ডাকাত দল

নিউজফ্ল্যাশ ডেস্ক | প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:০৮

নরসিংদী প্রতিনিধি

নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চানপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে চলতি বছরের ১০ অক্টোবর গভীর রাতে সারবোঝাই একটি বাল্কহেডে ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ১০ অক্টোবর; রাত দেড়টা ছুঁইছুঁই। হঠাৎই অস্ত্রধারী জলদস্যুরা বাল্কহেডে উঠে সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের এসকর্ট শামীমকে (৪১) জিম্মি করে নিয়ন্ত্রণে নেয় পুরো নৌযানটি।

পরে হাত-পা বেঁধে ট্রলারে তুলে শামীমকে নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। ভাগ্যক্রমে জীবিত ফিরে এলেও ভয়ংকর সেই রাতের অভিজ্ঞতা এখনও তাড়া করছে তাকে

নৌ পুলিশের তথ্য বলছে, বাল্কহেডটিতে ছিল ৬ হাজার ৩৪০ বস্তা ডিএপি সার। ডাকাত দলটি নৌপথে সক্রিয় এমন শ্রমিক পরিচয়ের লোকদের সমন্বয়ে গঠিত। দিনে নৌ শ্রমিক, রাতে জলদস্যু—এমনই পরিচয়ে তারা সহজেই নৌযানে ঢুকে ডাকাতি চালায়।

ঢাকা রিজিওন নৌ পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা ও পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদে সক্রিয় ১৪টি ডাকাত দল চিহ্নিত হয়েছে। এদের অধিকাংশই নৌ শ্রমিক পেশার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে ডাকাতি চালিয়ে আসছে। তাদের হয়ে অর্ধশতাধিক সদস্য নিয়মিত অপারেশন করে প্রতিবার নির্দিষ্ট অর্থ নেয়।

স্থানীয়ভাবে নৌ শ্রমিক হিসেবে পরিচিত নরসিংদীর পঞ্চবটি গ্রামের আলমগীর—একসময় নৌ পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত। পরবর্তীতে পুলিশি পরিচিতিকে ব্যবহার করে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে নিজস্ব ডাকাত দল। শুরুর দিকে চাঁদাবাজি করলেও পরে ডুবোজাহাজ, জেলে নৌকা, বাল্কহেড—সব ধরনের নৌযানকেই টার্গেট করতে থাকে।

মেঘনা নদীতে বাল্কহেড ডাকাতির ঘটনায় আলমগীরকে গ্রেপ্তার করেছে নৌ পুলিশ। রিমান্ডে সে জানায়—কোম্পানি থেকে চুক্তিতে নেওয়া বাল্কহেডটিকে সরাসরি ‘গায়েব করে দেওয়ার’ পরিকল্পনা ছিল তার। বর্তমানে তার নামে ডাকাতি ও হত্যাচেষ্টাসহ অন্তত আটটি মামলা রয়েছে।

১০ অক্টোবর রাতে বাল্কহেডে উঠে এসকর্ট শামীমকে মুখ বেঁধে ছোট একটি কুঠুরিতে আটকে রাখে ডাকাতরা। সকাল পর্যন্ত সেখানে থাকতে বাধ্য করা হয় তাকে। পরে ৬ হাজার টাকায় চুক্তি করে ট্রলারে তুলে গোপনে নদীতে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

নৌ পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে বাল্কহেডের সুকানি জসিম, ইঞ্জিন মিস্ত্রি রহিম এবং ট্রলারচালক সাকিমসহ সবাই ছিল আলমগীরের সহযোগী।

এর আগেও গত ৭ জুলাই মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া সিমেন্টবোঝাই একটি বাল্কহেড ‘অপহরণের শিকার’ হয়। পরে জানা যায় বাল্কহেডটির সুকানি আক্তার হোসেন খান ও মিস্ত্রি বেল্লাল নিজেই অপহরণকারী সেজে মালিকের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেছিল। নৌ পুলিশের অভিযানে দুজনই গ্রেপ্তার হয়।

সেভ দ্য রোডের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে নৌপথে ১৬১টি ডাকাতির ঘটনায় প্রাণ গেছে ১১ জনের। সংগঠনের দাবি—নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের দুর্বল তদারকির সুযোগেই বাড়ছে এসব অপরাধ।

নৌ পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কুসুম দেওয়ান জানান, নৌ শ্রমিকদের মধ্য থেকে ডাকাতি বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সারা দেশের সব নৌ শ্রমিকের পরিচয় সংরক্ষণে কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরির প্রস্তাব নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।

তার মতে, নৌযানে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, নেই লোকেশন ট্র্যাকার, ফলে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় ও ছিনতাই হওয়া নৌযান শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

এই দুটি ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা গেলে নৌ ডাকাতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top