অনলাইন রেডিও বা পডকাস্ট কেন জনপ্রিয় হতে পারেনি
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ২০:২০
বাংলাদেশে ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইন রেডিওর যাত্রা প্রায় এক যুগ আগে শুরু হলেও সেগুলো এফএম রেডিওর মতো পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশে ২০০৬ সালের পর থেকে একের পর এক এফএম রেডিও স্টেশন যাত্রা শুরু করে এবং রাতারাতি জনপ্রিয়তা পায়।
কিন্তু এই এফএম রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি একটি নির্দিষ্ট শহর বা অঞ্চলভিত্তিক হওয়ায় সেই জনপ্রিয়তা ছিল সীমাবদ্ধ। তাই রেডিওর এই জনপ্রিয়তা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইন রেডিও চালু করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই রেডিও সম্প্রচার হওয়ায় বিভিন্ন দেশে এটি ই-রেডিও, নেট রেডিও, ওয়েব রেডিও নামেও পরিচিত।
ধারণা করা হয়েছিল অনলাইন রেডিও যেহেতু বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে শুনতে পাওয়া যায় তাই এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এই রেডিও চালু করতে বড় ধরনের বিনিয়োগ বা লোকবলের প্রয়োজন না হওয়ায় বাংলাদেশে এক সময় দেড় শতাধিক অনলাইন রেডিও চালু হয়েছিল, যার প্রায় সবই ঝরে গেছে।
এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে সে সময় ইন্টারনেটের গতি দুর্বল থাকা, সব পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা এবং স্মার্টফোন না পৌঁছানোয় অনলাইন রেডিও সফল হতে পারেনি। এমনটাই জানিয়েছেন লেমন২৪.কম এর নির্বাহী প্রধান আশরাফ খান আবির।
লেমন২৪.কম প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ২০০৯ সালে। সে সময় প্রতিষ্ঠানটি প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে লাভবান না হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানটি সাত বছরের মাথায় ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে মি. খান বলেন, "আমরা যখন অনলাইন রেডিও শুরু করেছিলাম তখন আমেরিকা, ব্রিটেনে এই ই-রেডিও বেশ জনপ্রিয়। কারণ ওইসব দেশে ইন্টারনেট দ্রুতগতির ছিল। আমরা যখন শুরু করেছি তখন ছিল টুজি ইন্টারনেট, খুব স্লো। সবার কাছে স্মার্টফোনও ছিল না। এজন্য বিদেশে যতো মানুষের কাছে অনলাইন রেডিও পৌঁছাতে পেরেছিল। আমরা সেভাবে পারিনি।"
এছাড়া অনলাইন রেডিও নিয়ে সে সময় যারা কাজ করেছিলেন তাদের বেশিরভাগ প্রযুক্তিতে ভালো হলেও রেডিওতে কি ধরনের অনুষ্ঠান শ্রোতারা পছন্দ করবেন, সেই ধারণার অভাবে তারা দীর্ঘমেয়াদে অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারেননি বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেটের গতি ও সহজলভ্যতা যেভাবে বেড়েছে, এটাই অনলাইন রেডিও প্রতিষ্ঠার আসল সময় বলে মনে করছেন মি. খান। কিন্তু ইতোমধ্যে মানুষ ভিডিও কন্টেন্টের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় নতুন করে অনলাইন রেডিও জায়গা করে নিতে পারবে কিনা, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
"এখন শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামে দ্রুত গতির মোবাইল ইন্টারনেট, ব্রডব্যান্ড লাইন পৌঁছে গেছে, সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন আছে। এটা অনলাইন রেডিওর সময়। কিন্তু মানুষ এখন ভিডিও কন্টেন্ট দেখতে অভ্যস্ত। আমাদের পরের প্রজন্ম ভিডিও কন্টেন্ট দেখেই বড় হয়েছে। তাদের কাছে নতুন করে রেডিওকে পরিচিত করে তোলা কঠিন হবে," বলছেন মি. খান।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইন রেডিও ব্রডকাস্ট বা পডকাস্ট জনপ্রিয়। এখানে মূলত বিভিন্ন অনুষ্ঠান, গান, সংবাদ বা সাক্ষাতকারের অডিও সরাসরি বা রেকর্ড করে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়।
বাইরের দেশের এই অনলাইন রেডিওগুলো মূলত আয় করে থাকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনদাতারা অনলাইন রেডিওতে বিজ্ঞাপন দিতে তেমন আগ্রহী নয় বলে জানিয়েছেন, কয়েকটি অনলাইন রেডিওর প্রধান।
ফলে এধরনের রেডিও চালাতে অল্প বিস্তর ব্যয় যাই হোক না কেন সেই খরচ তুলে আনার কোন ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ইন্টারনেটভিত্তিক রেডিওর ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে বলে জানান মি. খান।
তিনি বলেন, "যারা শুরু করেছিল তাদের স্বদিচ্ছার অভাব ছিল না। অনেকে মৌলিক অনুষ্ঠানও সম্প্রচার করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় না থাকায় এর খরচ বহন করা বা ধরে রাখা কষ্টসাধ্য ছিল। আমরা ৭ বছর নিজেরাই খরচ চালিয়েছি। বিজ্ঞাপন ছাড়া এভাবে বছরের পর বছর চ্যানেল চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না।"
তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে এফএম রেডিও, কমিউনিটি রেডিও এবং অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা নিয়ে আইন ও নীতিমালা থাকলেও অনলাইন রেডিওর ক্ষেত্রে এমনটি নেই। তবে ইদানিং এফএম রেডিওতে গান সম্প্রচারে কপিরাইট বা মেধার মালিকানার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কপিরাইট আইনানুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তার গান বা মৌলিক কন্টেন্ট ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। আইনের এসব বাধ্যবাধকতা অনলাইন রেডিওর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হতে পারে সে কারণেও অনলাইন রেডিওকে এগিয়ে নিয়ে যাবার বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তাভাবনার দরকার বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন রেডিও চ্যানেলগুলোতে কী সম্প্রচার করা হচ্ছে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে যে অনলাইন রেডিওগুলো ছিল তার বেশিভাগই গান এবং হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদ সম্প্রচার করতো। সরাসরি অনুষ্ঠান বা মৌলিক অনুষ্ঠানের সম্প্রচার প্রায় ছিল না বললেই চলে।
তবে নতুন ও মৌলিক অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে সেইসঙ্গে শ্রোতাদের রুচির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা নিয়ে কেউ যদি অনলাইন রেডিও শুরু করেন তাহলে এই মাধ্যমটি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি তুলে ধরতে শক্তিশালী মাধ্যম হতে উঠতে পারে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাবেরী গায়েন।
তিনি বলেন, "বিদেশে পডকাস্ট এতো জনপ্রিয় কারণ তাদের সব কন্টেন্ট মৌলিক। আমাদের বেশিরভাগ অনলাইন রেডিওর হয় সঠিক পরিকল্পনা ছিল না, নাহলে ব্যবস্থাপনায় সমস্যা ছিল। সর্বোপরি কন্টেন্টের মানের জায়গাতে আমরা পিছিয়ে আছি।
''এখন আমরা যদি টার্গেট অডিয়েন্সের চাহিদা গবেষণার মাধ্যমে বের করে সে অনুযায়ী কন্টেন্ট দিতে পারি তাহলে বাংলাদেশের অনলাইন রেডিও অসীম সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে। কারণ এই সেবা মানুষ সবখানে পাবে," বলেন কাবেরী গায়েন।
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশ জনপ্রিয়, তাই রেডিও এখন শুধু শ্রুতিমাধ্যমে আটকে নেই। রেডিওগুলো তাদের অনুষ্ঠান এখন লাইফ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে, না হলে স্টুডিও রেকর্ডিং ভিডিও করে ফেসবুক এবং ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করছে। এছাড়া স্মার্টফোন থেকেও রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করে শুনতে পারছেন শ্রোতারা।
বর্তমানে জনপ্রিয় এফএম রেডিও, বেতার তরঙ্গের নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করে। অর্থাৎ ওই ফ্রিকোয়েন্সিতেই নির্দিষ্ট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনতে পাওয়া যায়। এই ফ্রিকোয়েন্সি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে, ওই নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে গেলে কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সেক্ষেত্রে ইন্টারনেট নির্ভর অনলাইন রেডিওর সুবিধা হল বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে কম্পিউটার, মোবাইল বা ল্যাপটপ থেকে তা শুনতে পাওয়া যাবে। শুধু ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই হবে। এ কারণে বাংলাদেশের প্রায় সব এফএম বেতারকেন্দ্র অনলাইনেও তাদের স্ট্রিমিং চালু করেছে। কেন্দ্রগুলো তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিয়মিত তাদের বেতার অনুষ্ঠানগুলো অনলাইনে প্রচার করছে। সূত্র: বিবিসি
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।