যাকাতের হিসাব করবেন যেভাবে!
রাশেদ রাসেল | প্রকাশিত: ৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৩:১০
‘যাকাত’ ইসলামের মূল পাঁচ স্তম্ভের একটি।
যাকাত অস্বীকারকারী নিঃসন্দেহে কাফির। বান্দার বৈধ উপার্জন থেকে একটি ‘নির্দিষ্ট পরিমাণ’ আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করার নাম ‘যাকাত’। আল্লাহ তা'আলা কোরআনে এরশাদ করেন, 'হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের বৈধ উপার্জন এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যে শস্য উৎপন্ন করি তা থেকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় (যাকাত দাও) কর।' (সূরা বাক্বারা ২৬৭ নং আয়াত)
যাকাতের হিসাব যেভাবে নির্ধারণ করবেন
যাকাতের হিসাব করার নিয়ম কী?
১। যে অর্থ/সম্পদে যাকাত আসে সে অর্থ/সম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত আদায় করা ফরয। মূল্যের আকারে নগদ টাকা দ্বারা বা তা দ্বারা কোনো আসবাবপত্র ক্রয় করে তা দ্বারাও যাকাত দেওয়া যায়।
২। যাকাতের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসের হিসাবে বৎসর ধরা হবে। যখনই কেউ নেসাব পরিমাণ অর্থ/সম্পদের মালিক হবে তখন থেকেই যাকাতের বৎসর শুরু ধরতে হবে।
৩। সোনা-রুপার মধ্যে যদি ব্রোঞ্জ, রাং, দস্তা, তামা ইত্যাদি কোনো কিছুর মিশ্রণ থাকে আর সে মিশ্রণ সোনা-রুপার চেয়ে কম হয়, তাহলে পুরোটাকেই সোনা-রুপা ধরে যাকাতের হিসাব করা হবে-মিশ্রিত দ্রব্যের কোনো ধর্তব্য হবে না। আর যদি মিশ্রিত দ্রব্য সোনা-রুপার চেয়ে অধিক হয়, তাহলে সেটাকে আর সোনা-রুপা ধরা হবে না। বরং ওই মিশ্রিত দ্রব্যই ধরা হবে।
৪। যাকাত হিসাব করার সময় অর্থাৎ, ওয়াজিব হওয়ার সময় সোনা, রুপা, ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদির মূল্য ধরতে হবে তখনকার (ওয়াজিব হওয়ার সময়কার) বাজার দর হিসাবে এবং সোনা-রুপা ইত্যাদি যে স্থানে রয়েছে সে স্থানের দাম ধরতে হবে।
৫। শেয়ারের মূল্য ধরার ক্ষেত্রে মাসয়ালা হলো- যারা কোম্পানির লভ্যাংশ অর্জন করার উদ্দেশ্যে নয় বরং শেয়ার ক্রয় করেছেন শেয়ার বেচা-কেনা করে লাভবান হওয়া এর উদ্দেশ্য, তারা শেয়ারের বাজার দর ধরে যাকাত হিসাব করবেন। আর শেয়ার ক্রয় করার সময় যদি মূল উদ্দেশ্য থাকে কোম্পানি থেকে লভ্যাংশ অর্জন করা এবং সাথে সাথে এ উদ্দেশ্যও থাকে যে, শেয়ারের ভালো দর বাড়লে বিক্রি করে দেব, তাহলে যাকাত হিসাব করার সময় শেয়ারের বাজার দরের যে অংশ যাকাতযোগ্য অর্থ/সম্পদের বিপরিতে আছে তার ওপর যাকাত আসবে, অবশিষ্ট অংশের ওপর যাকাত আসবে না। উদাহরণ স্বরূপ শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু (বাজার দর) ১০০ টাকা, তার মধ্যে ৬০ ভাগ কোম্পানির বিল্ডিং, মেশিনারিজ ইত্যাদির বিপরীতে, আর ৪০ ভাগ কোম্পানির নগদ অর্থ, কাঁচামাল ও তৈরি মালের বিপরিতে, তাহলে যাকাতের হিসাব করার সময় শেয়ারের বাজার দর অর্থাৎ, ১০০ টাকার ৬০ ভাগ বাদ যাবে। কেননা সেটা এমন অর্থ/সম্পদের বিপরীতে যার ওপর যাকাত আসে না । অবশিষ্ট ৪০ ভাগের ওপর যাকাত আসবে।
৬। যাকাতদাতার যে পরিমাণ ঋণ আছে সে পরিমাণ অর্থ বাদ দিয়ে বাকিটার যাকাত হিসাব করবে। ঋণ পরিমাণ অর্থ বাদ দিয়ে যদি যাকাতের নেসাব পূর্ণ না হয় তাহলে যাকাত ফরজ হবে না।
৭। কারও কাছে যাকাতদাতার টাকা পাওনা থাকলে সে পাওনা টাকার যাকাত দিতে হবে।
আরও পড়ুন: আয়কর দিলে কি যাকাত দিতে হয়?
পাওনা তিন প্রকার:
(ক) কাউকে নগদ টাকা ঋণ দিয়েছে কিংবা ব্যবসায়ের পণ্য বিক্রি করেছে এবং তার মূল্য বাকি রয়েছে। এরূপ পাওনা কয়েক বছর পর উসুল হলে যদি পাওনা টাকা এত পরিমাণ হয় যাতে যাকাত ফরজ হয়, তাহলে অতীত বৎসরসমূহের যাকাত দিতে হবে। যদি একত্রে উসূল না হয়- ভেঙে ভেঙে উসুল হয়, তাহলে ১১ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ হলে যাকাত দিতে হবে। এর চেয়ে কম পরিমাণ উসূল হলে তার যাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে অল্প অল্প করে সেই পরিমাণে পৌছে গেলে তখন ওয়াজিব হবে। আর যখনই ওয়াজিব হবে তখন অতীত সকল বৎসরের যাকাত দিতে হবে। আর যদি এরূপ পাওনা টাকা নেসাবের চেয়ে কম হয় তাহলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না।
(খ) নগদ টাকা ঋণ দেওয়ার কারণে বা ব্যবসায়ের পণ্য বাকিতে বিক্রি করার কারণে পাওনা নয় বরং ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, কাপড়, চাষাবাদের গরু ইত্যাদি বিক্রয় করেছে এবং তার মূল্য পাওনা রয়েছে, এরূপ পাওনা যদি নেসাব পরিমাণ হয় এবং কয়েক বছর পর উসূল হয় তাহলে ওই কয়েক বৎসরের যাকাত দিতে হবে। আর যদি ভেঙে ভেঙে উসুল হয় তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ না হবে ততক্ষণ যাকাত ওয়াজিব হবে না। যখন উক্ত পরিমাণ উসূল হবে তখন বিগত বৎসর সমূহের যাকাত দিতে হবে।
(গ) মহরের টাকা, পুরস্কারের টাকা, খালা তালাকের টাকা, বেতনের টাকা ইত্যাদি পাওনা থাকলে এরূপ পাওনা উসূল হওয়ার পূর্বে যাকাত ওয়াজিব হয় না। উসূল হওয়ার পর এক বৎসর মজুদ থাকলে তখন থেকে তার যাকাতের হিসাব শুরু হবে। পাওনা টাকার যাকাত সম্পর্কে উপরোল্লিখিত বিবরণ শুধু তখনই প্রযোজ্য হবে যখন এই টাকা ব্যতীত তার নিকট যাকাতযোগ্য অন্য কোনো অর্থ/সম্পদ না থাকে। আর অন্য কোনো অর্থ/সম্পদ থাকলে তার মাসলা উলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নেবেন।
৮। যে ঋণ ফেরত পাওয়ার আশা নেই, এরূপ ঋণের ওপর যাকাত ফরজ হয় না। তবে পেলে বিগত সমস্ত বৎসরের যাকাত দিতে হবে।
৯। যৌথ কারবারে অর্থ নিয়োজিত থাকলে যৌথভাবে পূর্ণ অর্থের যাকাত হিসাব করা হবে না বরং প্রত্যেকের অংশের আলাদা আলাদা হিসাব হবে।
১০। যেসব সোনা-রুপার অলংকার স্ত্রীর মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয় সেটাকে স্বামীর সম্পত্তি ধরে হিসাব করা হবে না বরং সেটা স্ত্রীর সম্পত্তি। আর যেসব অলংকার স্ত্রীকে শুধু ব্যবহার করতে দেওয়া হয়, মালিক থাকে স্বামী, সেটা স্বামীর সম্পত্তির মধ্যে ধরে হিসাব করা হবে। আর যেগুলোর মালিকানা অস্পষ্ট রয়েছে তা স্পষ্ট করে নেওয়া উচিত। যেসব অলংকার স্ত্রীর নিজস্ব সম্পদ থাকে তৈরি বা যেগুলো বাপের বাড়ি থেকে অর্জন করে, সেগুলো স্ত্রীর সম্পদ বলে গণ্য হবে। মেয়েকে যে অলংকার দেওয়া হয় সেটার ক্ষেত্রেও মাকে মালিক বানিয়ে দেওয়া হলে সেটার মালিক সে। আর শুধু ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দেওয়া হলে মেয়ে তার মালিক নয়।
নাবালেগা মেয়েদের বিয়ে উপলক্ষে তাদের নামে যে অলংকার বানিয়ে রাখা হয় বা নাবালেগা ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়েতে ব্যয়ের লক্ষ্যে তাদের নামে ব্যাংকে বা ব্যবসায় যে টাকা লাগানো হয় সেটার মালিক তারা। অতএব সেগুলো পিতা/মাতার সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না এবং পিতা/মাতার যাকাতের হিসাবে সেগুলো ধরা হবে না। আর বালেগ সন্তানের নামে শুধু অলংকার তৈরি করে রাখলে বা টাকা লাগালেই তারা মালিক হয়ে যায় না যতক্ষণ না সেটা সে সন্তানের দখলে হয়। তাদের দখলে দেওয়া হলে তারা মালিক, অন্যথায় সেটার মালিক পিতা/মাতা।
১১। হিসাবের চেয়ে কিছু বেশি যাকাত দিয়ে দেওয়া উত্তম। যাতে কম হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। প্রকৃতপক্ষে সেটুকু যাকাত না হলেও তাতে দানের সওয়াব তো হবেই।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।