শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

তোফাজ্জলকে হত্যার আগে পরিবারের কাছে চাওয়া হয়েছিল ২ লাখ টাকা

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩:০৪

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে ‘চোর সন্দেহে’ বরগুনার পাথরঘাটার মাসুদ কামাল তোফাজ্জলকে (৩০) পিটিয়ে হত্যার আগে পরিবারের কাছে ২ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। আজ বৃহস্পতিবার তোফাজ্জলের ভাবি শরিফা আক্তার এ দাবি করেন।

শরিফা আক্তার আমাদের সময়কে বলেন, ‘গতকাল রাতে আমার ফোনে দুটি নম্বর থেকে কল দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘‘তোফাজ্জল মোবাইল চুরি করেছে, ওকে আটকে রাখা হয়েছে। ছাড়িয়ে নিতে দুই লাখ টাকা পাঠাতে হবে।” পরে আমি ওর আত্মীয়-স্বজনকে জানাই। সকালে জানতে পারি ওকে হত্যা করা হয়েছে। আমার দেবর তোফাজ্জল হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’

শরিফা আরও বলেন, ‘মাসুদ কামাল তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ২০২০ সাল থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন, কিন্তু চোর নয়। পরিবারের কেউ না থাকায় ওর চিকিৎসা করানো যায়নি। একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সব সময় এলাকাতেই থাকতেন।’

তোফাজ্জলের প্রতিবেশী লিটন তালুকদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘তোফাজ্জল একজন মেধাবী ছাত্র, কয়েক বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় রয়েছেন। পরিবারের কেউ না থাকায় ওর চিকিৎসা করানো হয়নি। মানুষের কাছে হাত পেতে খেতেন। এলাকায় চুরি বা অন্য কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ওর হত্যার খবর শুনে আমরা শোকাহত। এ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি জানাই।’

পরিবার সূত্রে জানা যায়, তোফাজ্জল পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন। ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ২০১১ সালে তোফাজ্জলের বাবা আবদুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, ২০১৩ সালে মা বিউটি বেগম লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। একমাত্র বড় ভাই নাসির পুলিশে চাকরি করতেন। ২০২৩ সালে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তিনিও মারা যান। পরিবারে রয়েছেন একমাত্র বড় ভাইয়ের স্ত্রী ও তার দুই সন্তান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তোফাজ্জল তার এলাকার একটি মেয়েকে পছন্দ করতেন। মেয়ের পরিবার ওই মেয়েকে অনত্র বিয়ে দেওয়ার পর তোফাজ্জল ২০২০ সালে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। পরিবারের কেউ না থাকায় পরিবার ও অভিভাবকহীন হয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরতেন তিনি। ক্ষুধার প্রয়োজনে মানুষের কাছ থেকে চেয়ে খেতেন।

এদিকে, বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) একটি বেসরকারি সংবাদমাধ্যম চ্যানেলে সাক্ষাতে এ তোফাজ্জলের মামাতো বোন বলেন, ‘তোফাজ্জলের মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নাই। রাত ১১টার সময় আমার বাবাকে ফোন দেওয়া হইছে। আপনি কি তোফাজ্জলের মামা? আমার আব্বা ফোন ধরছে। তখন বলছে, ওরে (তোফাজ্জল) আমরা আটকাইছি, হলেই আছে, ওরে নিতে হলে টাকা দিতে হবে ৩৫ হাজার। ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে ওরে ছাড়াই নেন, না হলে আমরা ওরে ছাড়ব না, আরও মারবো।’

তিনি বলেন, ‘আমার আব্বা বললো, আমি তো গ্রামের বাড়িতে আমি কীভাবে কি করবো। তখন আব্বা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে, তুমি এখটু কথা বলে দেখো। তোফাজ্জলকে হলে...কথা-বার্তায় অসঙ্গতি পাইছে। এজন্য ওরে ধরছে। ধইরা ওরে মারতেছে।’

‘পরে আমি ওই লোককে ফোন দিয়েছি, আমি তোফাজ্জলের মামাতো বোন, তাকে কেন মারছেন। ওরা বলছে, ও (তোফাজ্জল) আমাদের হলে ঢুকছে বা...। তখন আমি বলেছি, দেখেন ও তো পাগল মানুষ, যদি অন্যায়ও করে প্রশাসনের কাছে দেন। ওরে মাইরেন না। কিন্তু ওরা বলে- একটা পাগলের কীভাবে মামার নাম্বার মুখস্ত থাকবে। চাচাতো ভাইয়ের নাম্বারও মুখস্ত, তাহলে কীভাবে পাগল হয়?’

‘তখন বলেছি, তোফাজ্জল অনেক মেধাবী ছিল, ওর মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই বলতে গেলে। আমার ফুফু (তোফাজ্জলের মা) মারা যাওয়ার পর থেকেই ওর মাথায় সমস্যাটা হয়েছিল। আপনি খাবার খাচ্ছেন, টান দিয়ে নিয়ে খাইলো...ক্ষুধার জ্বালায় টাকা নিলো চেয়ে...এরকম। ওর বাবা মারা যায় রোড এক্সিডেন্টে ৮ বছর আগে। পাঁচ বছর আগে মা মারা গেছে লিভার ক্যান্সারে। তারপর ছিল দুই ভাই। ভাই ছিল নাজিরপুর থানার এসআই, গত বছর রোজায় সেও ক্যান্সারে মারা গেছেন। ভাই মারা যাওয়ার পরে তোফাজ্জল একেবারে পাগল হয়ে যায়।’

তোফাজ্জলের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তার মামাতো বোন বলেন, ‘যে মানুষটা চার বছর আগে পাগল হয়ে গেছে, সে কীভাবে রাজনীতি করবে। মাঝে মাঝে তো ওর পরনের কাপড়ও থাকতো না...। একজন খুনি হলেও তো জীবন্ত মেরে ফেলতে পারে না। একটা কুকুরকেও তো কেউ এইভাবে মারতে পারে না...।’

যারা যারা তোফাজ্জলকে হত্যায় জড়িত তাদের আইনের অধীনে সর্বোচ্চ বিচার চান তিনি। আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘মারছে, ভাত খাওয়াইছে, এরপর আবার মারছে, ভাত খাওয়াইছে। একটা মানুষকে তো এভাবে মাইরা ফালায় না! সে যদি খুনিও হয়, এভাবে জীবন তো নিতে পারে না।’

উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ‘চোর সন্দেহে’ পিটুনিতে মারা যান তোফাজ্জল হোসেন। গতকাল বুধবার দিবাগত রাতে হলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তিনি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তার বাবার নাম (মৃত) আবদুর রহমান।এ ঘটনায় আজ শাহবাগ থানায় মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শাহবাগ থানায় অভিযোগটি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ। এরই মধ্যে চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।

 

 



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top