মিরপুর-আশুলিয়া মহাসড়ক চোরাই তেল বেচাকেনার অভয়ারণ্য
মনির হোসেন জীবন | প্রকাশিত: ৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:৩৬

রাজধানীর সর্বউত্তর ও পশ্চিমে ৫ থানার সীমানা নিয়ে গঠিত উত্তরা, তুরাগ, বিমানবন্দর, শাহআলী ও মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়কটি চোরাই তেলের বেচাকেনার অভয়ারণ্য হিসাবে গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার তেল চুরি হচ্ছে।
১৯৮৮ সালে নগরবাসীরকে ভয়াবহ বন্যার কবল থেকে বাঁচাতে বিগত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের শাসনামলে এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেরি বাঁধটি নির্মাণ করা হয়।
বর্তমানে এ বাঁধ হয়ে উঠেছে চোরাই তেলের নিরাপদ হাট। বাঁধের ওপর ঢাকা থেকে টঙ্গী ও আশুলিয়া- সাভার মুখী সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে সরকারি -বেসরকারি যানবাহনের চুরি করা তেল কেনার বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা।
এলাকাবাসি ও তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরাই তেলের আস্তানায় পরিনত হয়েছে এই রোড। প্রতিরাতে চোরাই তেল ব্যারেল ব্যারেল সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুর, টঙ্গী, উত্তরা, তুরাগ, বিমানবন্দর ও বিভিন্ন এলাকার বিক্রি করছে অনেক ব্যবসায়ীরা।
চোরাই তেলের এসব কারবারি বিক্রেতা গাড়িচালকদের একদিকে তেলের দাম যেমন কম দেন, অন্যদিকে বেশি তেল নিয়ে মাপেও কম ধরেন। এভাবে চোরাই তেল কারবারিরা দুদিক থেকেই লাভ করে পকেট ভারী করছেন। আর চোরাই এ তেল কারবারিদের কাছ থেকে প্রতি রাতে ব্যারেল ব্যারেল নিয়ে যান সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। তারা স্থানীয় খোলাবাজারে এ তেল সরবরাহ করে থাকেন।
গত কয়েক দিন ধরে সাভার, আশুলিয়া, রূপনগর ও শাহ আলী থানাধীন বেড়িবাঁধ এলাকা ঘুরে অন্তত ডজনখানেক তেল চুরির অবৈধ স্থাপনা দেখা গেছে।
এই রোডে কয়েকটি চোর চক্র সক্রিয় রয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনায় দিনের বেলায় তেমন কোনো গাড়ি চোখে না পড়লেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ভিড় জমে বিভিন্ন যানবাহনের। যার মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি ডাম্প ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যান, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস।
ঢাকা মহানগর পুলিশের রূপনগর ও শাহ আলী থানা পুলিশের সহায়তায় চোরাই তেল কারবারিরা অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ করেছেন বেড়িবাঁধের আশপাশের লোকালয়ের বাসিন্দারা।
এছাড়া বাঁধের কিছু অংশ সাভার, আশুলিয়া ও তুরাগ থানার মধ্যে পড়েছে। চোরাই তেল কারবারিরা বাঁধের ওপর কোথাও প্লাস্টিকের কাগজ, কোথাও কালো কাপড় আবার কোথাওবা ভাঙা টিনের বেড়া দিয়ে ছোট ছোট টং ঘর বা দোকান তৈরি করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চোরাই তেল কারবারি নিউজ ফ্ল্যাশ ৭১ ডটকমকে বলেন, চালকদের কাছ থেকে প্রতি লিটার অকটেন তারা কেনেন ১১৫ টাকায় আর ডিজেল বা পেট্রোল কেনেন ১১০ টাকা করে। এবিষয়ে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সাংবাদিকদের বলেন, এগুলো উচ্ছেদের দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের ওপরও বর্তায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিরুলিয়ার এক বাসিন্দা নিউজ ফ্ল্যাশ ৭১ ডটকমকে জানান, একসময় অপরাধীরা বেড়িবাঁধে মানুষের লাশ ফেলে যেত। সেটা বন্ধ হওয়ার পর অসামাজিক কার্যকলাপের নানা ধরনের আস্তানা গড়ে তুলেছিল একশ্রেণির ব্যবসায়ী।
সেটাও এখন আর দেখা যায় না। কিন্তু এখন এ বাঁধ ঘিরে গড়ে উঠেছে চোরাই তেল কেনাবেচার সিন্ডিকেট। যারা প্রতি রাতে এসব দোকান থেকে ব্যারেল ব্যারেল চোরাই তেল কম দামে কিনে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে থাকে। অনেক সময় এ তেলে ভেজালও থাকে।
ডিএমপি রূপনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নিউজ ফ্ল্যাশ ৭১ ডটকমকে বলেন, এ বাঁধে অনেক আগে চোরাই তেল কেনাবেচার আস্তানা ছিল। সেগুলো আমরা উঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন নতুন করে যদি কেউ এ ধরনের অবৈধ আস্তানা তৈরি করে তেল কেনাবেচা করে থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের বিরুদ্ধে মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করে ওসি (তিনি) বলেন, থানা পুলিশকে জানিয়ে কখনো কি কেউ অবৈধ কাজ করতে পারে? এটা কখনোই হতে পারে না। বাঁধের সীমানা অনেক থানা এলাকায় পড়েছে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের পাশাপাশি এগুলো উচ্ছেদের দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের ওপরও বর্তায়।
সংশ্লিষ্ট একটি মহল নিউজ ফ্ল্যাশ ৭১ ডটকমকে জানান, মুদির দোকানেও খুচরা বিক্রির জন্য সরবরাহ করা হয় এসব ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোল। বিভিন্ন এলাকা থেকে ভ্যান নিয়ে এসে এ তেল নিয়ে যান তারা। মুদি দোকানেও বিক্রি হয় এসব চোরাই তেল।
বেড়িবাঁধে তেল বিক্রি করতে আসা একটি কাভার্ড ভ্যানের (রেজিস্ট্রেশন নম্বর : ঢাকা-মেট্রো-গ-৫৪৬২৩৩) চালক এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, চুক্তিতে ভাড়া মারার পর যে তেল বাঁচে সেটাই তিনি বিক্রি করেন। কারও তেল চুরি করে বিক্রি করেন না। উল্টো তিনি তেল কারবারদের চোর আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ওরা পাইপ দিয়ে ট্যাংকি থেকে এক টানেই পাঁচ লিটার বের করে নিয়ে যায়। দাম দেয় মাত্র তিন লিটারের। এখন বলেন চোর কে?’
তেল বিক্রি করতে আসা এ চালকের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চোরাই তেল কারবারি মান্নান বলেন, ‘রাইতের কামে একটু এদিক-সেদিক অইবোই। যার দরকার সেই বিক্রি করে। জোর করে তো নেই না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইস্টার্ন হাউজিংসংলগ্ন বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে পঞ্চবটী পর্যন্ত বেড়িবাঁধ পড়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রূপনগর থানা এলাকায়। তামান্না পার্কের সামনে থেকে দিয়াবাড়ী পর্যন্ত বেড়িবাঁধ এলাকাটি পড়েছে শাহ আলী থানা এলাকায়। বিরুলিয়া ব্রিজসংলগ্ন বেড়িবাঁধের একপাশ পড়েছে সাভার থানায়। বিপরীত পাশের প্রিয়াঙ্কা শ্যুটিং স্পট এলাকা পড়েছে রূপনগর থানায়। আর ধউর থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত তুরাগ থানায়।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দীন মোল্লা মোবাইল ফোনে বলেন, চোরাই তেলের স্পটগুলোর নাম পাঠিয়ে দেন, ব্যবস্থা নেব।’
সম্পাদনা : রাহুল রাজ
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।