সঞ্জীব চৌধুরী উন্মোচন করেছেন পৃথিবীর মুখোশ
গানের আঙিনায় এক ক্ষণজন্মা কিংবদন্তি সঞ্জীব চৌধুরী
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৯:২৫
পৃথিবীর আলো দেখেছিল এক মানবশিশু:
১৯৬৪ সাল, ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ। হবিগঞ্জের মাকালকান্দির গোপাল চৌধুরী ও প্রভাষিনী চৌধুরী দম্পতির কোল আলোকিত করে পৃথিবীর আলো দেখেছিল এক মানবশিশু। নাম তার সঞ্জীব চৌধুরী। বাড়িতে ডাকনাম ছিল কাজল৷ বসতভিটা বানিয়াচংয়ে হলেও জানা যায় তাঁদের মূল বাড়ি ছিল সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার দশঘর গ্রামে৷ তাঁর পিতামহ শরৎ রায় চৌধুরী সেখানকার জমিদার ছিলেন।
রাজনীতির পাঠ শুরু:
স্কুলে পড়ার সময়ই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ঢাকা কলেজে পড়াকালে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৯-৮০ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্ররাজনীতির নিবেদিতপ্রাণ, সঞ্জীব চৌধুরী দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক সম্পাদকেরও।
তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ও যুক্তিবাদী বক্তৃতার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ছাত্রাবস্থায় সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ বহুবার আলোড়িত হয়েছে তাঁর কণ্ঠের কবিতা ও বক্তৃতায়। তাৎক্ষণিক গান লেখার পর তখনই সুর বসিয়ে তিনি রাজপথ কাঁপাতেন স্বৈরাচার পতনের গানে গানে।
১৯৮৫তে তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বরশ্রুতিতে যুক্ত হন এবং তার হাতেই গড়ে ওঠে স্বরশ্রুতির গণসংগীতের স্কোয়াড। নেতৃত্ব দেন স্বরশ্রুতির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখাকে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনে রয়েছে তার অবদান।
গণিত ছেড়ে সাংবাদিকতায়:
১৯৭৮-এর মাধ্যমিকে দখল করেন জাতীয় মেধা তালিকার ১২তম স্থান। ১৯৮০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। সেই বছরই স্নাতকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হন৷ পরে সেই বিভাগ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করেন। এবং সেখান থেকেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে মাস্টার্স পাশ করেন৷
লেখক বানানোর কারিগর:
ফিচার সাংবাদিকতার ধারা বদলে দেওয়া সঞ্জীব চৌধুরীর সাংবাদিকতা শুরু সাপ্তাহিক উত্তরণ পত্রিকা দিয়ে। দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে ফিচার বিভাগ চালু করার ক্ষেত্রে সঞ্জীব চৌধুরীর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার হাত ধরেই মূলত দৈনিক পত্রিকায় ফিচার বিভাগের যাত্রা শুরু। তিনি ছিলেন লেখক বানাবার কারিগর।
নব্বইয়ের দশকের আগে সকল সংবাদপত্র ভর্তি ছিলো শুধু সংবাদ আর সংবাদ। ভোরের কাগজে কাজ করার সময় সঞ্জীব চৌধুরী প্রথমবার ফিচার লেখা শুরু করেন। এবং তার এই পদক্ষেপে সংবাদপত্রের কাটতি নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে থাকে। দেশের আধুনিক সাংবাদিকতায় সঞ্জীবের বিরাট ভুমিকা রয়েছে।
তার লেখা কবিতা নিয়ে প্রকাশ হয়েছে রাশপ্রিন্ট নামের একটি কাব্যগ্রন্থ। এটি তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ। ১৯৮৩ সালে একুশে বইমেলায় তিনি মৈনাক নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন।
বাংলার বব ডিলান:
শঙ্খচিল নামে একটি ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পথচলার শুরু। এরপর ১৯৯৬ সালে বাপ্পা মজুমদার ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করেন দলছুট ব্যান্ড। তারপর থেকে সঞ্জীবের গান হয়ে ওঠে রুচিশীল তরুণদের মনের খোরাক। তিনি পিংক লয়েড, বব ডিলানের গানে প্রভাবিত। তার গানেও এদের ছায়া পড়েছে। বিশেষ করে ফোক গানের প্রতি ছিলো তার ব্যাপক ভালো লাগা।
মানুষের অন্তরের কথা, স্বপ্নের কথা উচ্চারিত হতো তাঁর কণ্ঠে। মানুষের হৃদয়ের ব্যথা অনুধাবন করতে পারতেন। প্রেম-বিরহ কিংবা জীবনবোধ সবই উঠে এসেছে তার গানে। পথে পথে তিনি গান করতেন মানুষের জন্য, মানুষের বিবেক জাগ্রত করার জন্য।
অনন্য প্রতিভা ছিলো তার, গান লেখার এবং গাওয়ার। নব্বইয়ের হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। তাৎক্ষণিক গান লেখার পর তখনই সুর বসিয়ে তিনি রাজপথ কাঁপাতেন স্বৈরাচার পতনের গানে গানে।
সঞ্জীবের গাওয়া- বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না, ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও, আমি তোমাকেই বলে দেবো, হৃদয়ের দাবি, আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো চাঁদ, রিকশা ইত্যাদি সব শিরোনামের গানগুলো আজও নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে।
সঞ্জীবের জীবনদর্শন:
বড্ড বেশি অভিমানী ছিলেন সঞ্জীবদা, তার জীবন দর্শন, তার চিন্তা ছিল অন্য রকম। সঞ্জীব চৌধুরী ছিলেন চির বোহেমিয়ান৷ জীবনের পরতে পরতে অন্বেষণ আর স্বাধীনতার চিন্তায় সঞ্জীব কখনো জীবনকে জটিল করেননি।
সঞ্জীব চৌধুরী যেমন ছিলেন কোমল হৃদয়ের মানুষ, ঠিক ততটাই সোচ্চার ছিলেন তিনি অত্যাচারীর বিরুদ্ধে। মানুষ হিসেবে সঞ্জীব চৌধুরীর ছিল সম্মোহনী ক্ষমতা, মানুষকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা। তিনি ভালোবাসতে পারতেন মানুষকে। সবার সঙ্গে তার ছিল দারুণ সখ্য।
সাম্যবাদে বিশ্বাসী সঞ্জীব দৃঢ় আশাবাদী ছিলেন যে একদিন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবেই এই সমাজে। তাই তার সকল আবেগ ঢেলে সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। সঞ্জীব চৌধুরী এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি এক নিমেষেই নিজেকে শ্রেণিচ্যুত করে ফেলতে পারতেন। তিনি সব শ্রেণির মানুষের সাথে কথা বলতে পারতেন, মিশতে পারতেন তাদের মতো করে।
যে দেশে অধিকাংশ মানুষ প্রতিবাদ না করে নিশ্চুপ থাকে সেখানে তিনি অমিতাভ হয়ে কথা বলেছেন স্পষ্টবাদী চিত্তে। তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন নিপীড়িত মানুষের বেদনা। কনাসার্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ইয়াসমিন-তাজুল ইসলাম-দীপালী-নূর হোসেন-ইলা মিত্র-কর্নেল তাহেরের কথা। গানে কিংবা কবিতায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নেকড়ের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত এক ধারালো সময়কে। সঞ্জীব চৌধুরী উন্মোচন করেছেন পৃথিবীর মুখোশ। আমাদের তিনি দেখিয়েছেন দুর্বৃত্তদের রংমঞ্চ।
মৃত্যুই শেষ কথা নয়:
২০০৭ সালের আজকের (১৯ নভেম্বর, প্রথম প্রহরে) দিনে মারা গেছেন তিনি। বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই তার জীবনাবসান হয়। সঞ্জীব চৌধুরী ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন খন্দকার আলিমা নাসরিন শিল্পীকে। সেই সংসারে কিংবদন্তি নামে এক কন্যা রয়েছে তার।
সঞ্জীবরা কখনও মরে না:
সঞ্জীব চৌধুরী একটা মন খারাপের নাম, বুকের ভেতর জমানো এক চাপা দীর্ঘশ্বাস- একটি হাহাকার। সঞ্জীব চৌধুরীর শারীরিক উপস্থিতি নেই। কিন্তু তার সৃষ্টি সদা চলমান, সদা প্রাসঙ্গিক। গানের আঙিনায় ক্ষণজন্মা কিংবদন্তি তিনি। মৃত্যুর এত বছর পেরিয়েও গানে-গল্পে শ্রোতা ও অনুরাগীদের কাছে সজীব হয়ে আছেন তিনি।
এক যুগ চলে গেছে সঞ্জীব চৌধুরীবিহীন, তবু মনে হয়, আমাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি আমাদের মাঝেই আছেন। তিনি তাঁর ভক্তদের কাছে বাংলার বব ডিলান কিংবা প্রিয় সঞ্জীবদা হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
এই ঠাঠা-মরার দেশে সঞ্জীব চৌধুরী বড় বেশি অপরাধী, কারণ তার ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল। কারণ, সে ভালোবাসত। কারণ এই পোশাকি সিস্টেমের দেশে সঞ্জীব চৌধুরী আপন অস্তিত্বের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। এই ফাঁকা-ফাঁকা মন্দির-মসজিদ-গির্জার দেশে, সঞ্জীব চৌধুরী ছিন্নমুল মানুষের বাসস্থানের ভাবনা মাথায় রেখেছে। নিরন্নের, অন্ন ও পানীয়ের অধিকারের কথা বলার জন্য, সাহসে, বুক টানটান করে রাজপথে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিংবদন্তী একদিন জানবে, মেডিকেল কলেজের গবেষণায় তার বাবার শরীর কাজে লেগেছিল।
বিষয়: সঞ্জীব চৌধুরী সাংবাদিকতা সঙ্গিত রাজনীতি
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।