বাংলাদেশে এক এগারোর সরকারের কথিত সংস্কার কতটুকু অর্জিত হয়েছে

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:২৯

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সমর্থনে একটি অরাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতা নেওয়ার যে ঘটনা ঘটেছিল সোমবার ছিল তার ১৪ বছর। সেনা সমর্থিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথম থেকেই দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বদল বা সংস্কারের কথা শুরু করে এবং এজন্য রাজনৈতিক দল এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে।

কিন্তু ১৪ বছর পর কথিত সেসব সংস্কারের কোনো ছিটেফোঁটা কি চোখে পড়ে-বিশ্লেষকদের অনেকে এই প্রশ্ন তুলেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধীদল বিএনপি- প্রধান দুই দলের নেতারাই বলেছেন, জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার করা যায় না। তারা মনে করেন, এক এগারোর সরকার হিসাবে পরিচিত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই উদ্যোগ সে সময়ই ব্যর্থ হয়েছে।

টার্গেট ছিল দুই দল

১৪ বছর আগে ১১ই জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছিল ড: ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই সরকার রাজনৈতিক সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তাতে রাজনৈতিক দলগুলোতে শীর্ষ নেতার কর্তৃত্ব খর্ব করে গণতান্ত্রিক চর্চার কথা বলা হয়েছিল। এই উদ্যোগে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বড় দুই দলকেই টার্গেট করার বিষয়টি দৃশ্যমান ছিল।

সংস্কারপন্থী হিসাবে একটি অংশ তৈরি করে বিএনপিতে বিভক্তি আনা হয়েছিল। আওয়ামী লীগেও সংস্কারপন্থী একটা অংশ তৈরি করা হয়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রওনক জাহান বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর থেকে সংস্কারের বিষয়টি আসেনি। ফলে চাপের মুখে দলগুলো তখন সংস্কারের কথা বললেও তা হয়নি বলে তিনি মনে করেন।

"প্রথম কথা হচ্ছে, দলগুলো স্বত:প্রণোদিত হয়ে সংস্কারের কথা বলেনি। বাইরে থেকে দলগুলোতে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দলগুলো তখন চাপের মধ্যে ছিল, ফলে চাপের মুখে দলগুলোও সংস্কারের কিছু কথা সে সময় বলেছিল," তিনি বলেন।

অধ্যাপক রওনক জাহান আরও বলেছেন, "ক্রমাগত বাইর থেকে দলগুলোর ওপর চাপ দেয়ার মতো কোন শক্তি আর নেই। অতএব দলগুলো তাদের নিজেদের ইচ্ছামত আগে যেভাবে চলতো, এখনও সেভাবে চলছে।"

চাপ দিয়ে সংস্কার হয় না

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলে সেই কথিত সংস্কারের পক্ষে নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা এখন রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে কোন কথা বলতে চাননি।

তবে এখন এই দুই দলের মূল নেতৃত্বের অনেকে বলেছেন, সেনা সমর্থিত তত্ত্ববধায়ক সরকার, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবং বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার বা মাইনাস করার কিছু তৎপরতা নিয়েছিল, যা তখন দৃশ্যমান হয়েছিল।

তারা উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জনসমর্থনের কারণে ''সেই সরকারের চাপিয়ে দেয়ার সেই চেষ্টা তখনই ব্যর্থ হয়েছে''। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, চাপিয়ে দিয়ে রাজনীতিতে সংস্কার করা যায় না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং রাজনীতিতে তার নিজস্ব গতিতে সংস্কার হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

"যারা এই ধরনের কথা বলেন, তারা এসে আবার আরেক পার্টি করেন,'' এই মন্তব্য করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, জরুরি একটা সঙ্কেত "অ্যালার্ম" জারি করার প্রক্রিয়া দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি তো চলে না। ''তারা হালে পানি তো পায় নাই। কারও ডিক্টেশনে তো সংস্কার হয় না" তিনি বলেন।

মতিয়া চৌধুরী আরও বলেছেন, "আমাদের দলে নিয়মিত সম্মেলন হচ্ছে। গ্রাম-ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে আমাদের কমিটি আছে। আলোচনার মাধ্যমে সব সিদ্ধান্ত হয়। এখানে সংস্কারের কী আছে?" তিনি প্রশ্ন করেন।

বন্দুকের নলঃ বিরাজনীতিকরণ

এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার খর্ব করা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠাসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে বিরোধীদল বিএনপির।

কিন্তু সেনা সমর্থিত তত্ত্ববধায়ক সরকারের ১৪ বছর আগের রাজনৈতিক সংস্কারের কথিত উদ্যোগের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি নেতারাও প্রায় একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, "বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে যদি এ ধরণের উদ্যোগ নেয়া হয়, সে উদ্যোগ কখনই সফল হয় না। মইনউদ্দিন এবং ফখরুদ্দিনের যে সরকার এসেছিল, সেই সরকার অবৈধ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের এ বিষয়টা ছিল বাংলাদেশকে বিরাজনীতিকরণের একটা প্রক্রিয়া" তিনি মনে করেন।

মি: আলমগীর আরও বলেছেন, "কেন জানি না, আমাদের দেশে যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন- সুশীল সমাজ, তারা সেদিন এক এগারোর সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল যে এখান থেকে নতুন একটা গণতান্ত্রিক ধারা বের হবে। কিন্তু সেটা হয় না।"

পরিবর্তন

বিএনপি নেতা মি: আলমগীরের বক্তব্য হচ্ছে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার কারণে সংস্কারের প্রশ্নে কিছুই হয়নি। "দুভার্গ্যজনক হলো, এখন যারা দেশ শাসন করছে, তারা ঐ একইভাবে পরিচালিত হচ্ছে।"

তিনি এখন বিরোধী মতকে দমন, নির্বাচন কমিশনসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল করা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠাসহ নানা অভিযোগ তোলেন টানা তিন মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এসব অভিযোগ মানতে রাজি নয়।

আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, "গত নির্বাচনে বিএনপি যে আসন পেয়েছে, তাতে সংসদে তাদের কোন গ্রুপ বা দল গঠনের মতো অবস্থা ছিল না। এরপরও তাদের এমপিরা সামনের সারিতে বসার আসন পেয়েছেন। এটা সংসদ নেত্রীর উদারতার কারণে (সেটা) হয়েছে।"

তিনি আরও বলেছেন, "এখন বিরোধীদলের সমাবেশ মিছিল সব হচ্ছে। সেখানে কর্তৃত্ববাদী হলো কোথায়?" তিনি প্রশ্ন করেন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে দুই দলের মধ্যেও যে বিতর্ক রয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা কতটা সম্ভব হবে- তা নিয়ে বিশ্লেষকরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top