ভালোবাসা দিবসের নোংরা স্রোত আর উন্মাতাল ঢেউয়ে কী হারিয়ে গেল স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস?

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০৮:১৬

শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রতিবাদী ছাত্র সমাজের বুকের রক্তে রক্তিম হয় ঢাকার রাজপথ। ফাল্গুনের অগ্নিঝরা দিনের সাথে মিশে একাকার হয় রক্তস্নাত আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নতুন একটি শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান। সেখানে প্রথম শ্রেণি থেকে আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা কিংবা ৫০ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা।

সেই ধর্মভিত্তিক ও বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৭ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্রসংগঠনগুলো। তারপর শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, যেটি রূপ নেয় গণ-আন্দোলনে। মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, ছাত্রবন্দীদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে জমায়েত হয় ছাত্রজনতা। দাবি ছিল একটাই- অবৈতনিক, বৈষম্যহীন ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, মজিদ খান শিক্ষানীতিতে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় প্রতিফলন ঘটেছে।

শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শ্লোগানে প্রকম্পিত হয় ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আকাশকাঁপানো স্লোগানে ছাত্রসমাজ নেমে আসেন রাজপথে। স্মারকলিপি প্রদানে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে সচিবালয়ের দিকে এগিয়ে যায় মিছিল। হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়।

উত্তেজনার একপর্যায়ে ছাত্রনেতারা ব্যারিকেডের কাঁটাতারের ওপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন। কোনো রকম উসকানি ছাড়াই রায়ট কার ঢুকিয়ে গরম পানি ছিটাতে শুরু করে পুলিশ। লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। ব্যর্থ হয়ে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ।

প্রথম গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে গেলে পুলিশ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করে। ওইদিনই শিশু একাডেমিতে যোগ দিতে আসা দীপালী গুলিতে মারা যায়। পুলিশ দীপালীর মরদেহ গুম করে ফেলে। আন্দোলনে জাফর, কাঞ্চনসহ মোট ১০ জন শহীদের হদিস পাওয়া যায়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে বাতিল হয় কুখ্যাত মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতি। আটক তিন ছাত্রনেতা (শীবলি কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান ও আব্দুল আলী) মুক্তি পান। ঘরোয়া রাজনীতির অধিকার দিতে বাধ্য হয় সামরিক সরকার। ১ হাজার ২১ জনকে ছেড়ে দেয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি,  আটক রাখা হয় ৩১০ জনকে।

রাজীব রায়হান

সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের দেশে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’। তবে ৯০দশকে স্বার্থান্বেষী একটি মহলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য দেশে প্রচলন করা হয় ভালোবাসা দিবস। ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসাবে পালনের জন্য শুরু হয় ইনতেজাম। দেশের ছাত্র-যুব সমাজকে জনগণের সেবক হিসাবে গড়ে না তুলে, নৈতিক অবক্ষয়ের চরমে ঠেলে দেয়ার আয়োজন চলে।

বাংলাদেশের এক বুদ্ধিজীবীর হাত ধরে প্রেম-ভালোবাসার মতো স্বাভাবিক সম্পর্ককে অতিপ্রাকৃত বিষয়ে পরিণত করার আয়োজন সম্পন্ন হয়। ইউরোপীয় সংস্কৃতির আদলে ভালোবাসা দিবস নিয়ে শুরু হয় মাতামাতি। কর্পোরেট ভালবাসার নামে চলে নোংরা ব্যবসা আর লাভবান হয় শোষক শ্রেণি। এই দিবসের নোংরা স্রোত আর উন্মাতাল ঢেউয়ে ভেসে যায় ১৪ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’।

ভালবাসার চাইতে কোন মরণাস্ত্র শক্তিশালী হতে পারে না। ভালবাসার উত্তাপে উজ্জীবিত হয় মানবিকবোধ। নির্মূল হয় সকল নষ্ট-ভ্রষ্ট চিন্তা। আমাদের ভালোবাসা কি এতই ক্ষুদ্র? যেটি দেশের মানুষকে ভালোবাসতে কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখায় না! ভালোবাসা কি কেবল একজন ব্যক্তিকে ঘিরেই গড়ে উঠবে?

এই গৌরবগাঁথা ইতিহাস ভুলে, অপসংস্কৃতির জোয়ারে গা না ভাসিয়ে আসুন আমরা প্রকৃত ইতিহাস জানি। ভালবাসা দিবস পালনের ডামাডোলে সংগ্রামের ইতিহাসকে চাপা না দেই। শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই বীর আত্মত্যাগীদের।

 

 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top