হাজার ছাড়ালো ডেঙ্গুতে প্রাণহানি, বাঁচার উপায় কী?
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৩:৩২
সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে এক হাজার ৬ জনের মৃত্যু হলো। এই সময়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৮৮২ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ছয় হাজার ২৮৮ জন। রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফর জানায়, শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৮৮২ জন। এদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬২৯ জন ও ঢাকার বাইরের ২ হাজার ২৫৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা নয়জন ও ঢাকার বাইরের আটজন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ছয় হাজার ২৮৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৩ হাজার ৮৫১ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ২২ হাজার ৪৩৭ জন। একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১ লাখ ৯৫ হাজার ৯২৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮০ হাজার ৮৩ জন এবং ঢাকার বাইরের ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৪২ জন।
বর্তমানে সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৯ হাজার ৩৫৭ জন ডেঙ্গুরোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩ হাজার ১২০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬ হাজার ২৩৭ জন। এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সাথে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন।
২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সরকারি পরিসংখ্যান গত ২৪ বছরের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২১ জন মারা গেছেন, যা একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু। এর আগেও গত ২ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে একদিনে সর্বোচ্চ ২১ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেভাবে গতানুগতিক পদ্ধতিতে কাজ করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ ও আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ঠেকাতে সমন্বিত কোনো ব্যবস্থায় গড়ে তোলেনি এই দুই মন্ত্রণালয়।
পুরো বিষয়টি তারা পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এতে কোনোকিছুই আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকেনি। এমন উদাসীন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
মশক নিয়ন্ত্রণে কেবল ক্র্যাশ প্রোগ্রাম কিংবা চিরুনি অভিযানের নামে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যে তৎপরতা চালানো হয়েছে, তা যথেষ্ঠ ছিল না বলে মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, স্বাস্থ্যবিভাগ বোধহয় একটা আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। তারা মনে করছে আমরা তো হাসপাতালে সেবা দিচ্ছি। কিন্তু সঙ্কটাপন্ন রোগী আসাটা তো ঠেকাতে হবে। স্তরভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে না পারলে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ তার এক প্রবন্ধে বলেন, ডেঙ্গু নগরায়ণের রোগ, বিশেষত অপরিকল্পিত নগরায়ণের। আমাদের নগরায়ণের উপাদানের মধ্যে আছে এডিস মশার প্রজনন স্থান। পাকা বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরির সময় জমে থাকা স্বচ্ছ পানি এডিস মশার আঁতুড়ঘর।
নগরায়ণে গাড়ির চাকা বেশি ঘোরে, টায়ার পুরনো হয়, ফেলে রাখা পুরনো টায়ারে দিব্যি ঘর-সংসার পাতে এডিস মশা। এখনকার জীবনে ব্যবহৃত হয় সীমাহীন ডিসপোজাবল প্লাস্টিক কন্টেইনার; পচে না, ধরে রাখে পানি যেখানে আরামে বংশবিস্তার করে এডিস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু ও মশাবাহিত ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট অন্যান্য রোগ বিশেষ করে চিকুনগুনিয়া দ্রুত ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় এখনও পর্যন্ত কোনো টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার হয়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, যথাযথ প্রতিরোধের অভাবে ডেঙ্গু বহনকারী মশা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০০-২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকি শুধু ঢাকা শহরেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে সেটি বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছর সেই ঝুঁকি গ্রামাঞ্চলেও স্থানান্তরিত হয়।’
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার ডেঙ্গু হলে এর তীব্রতা বেড়ে যায়। মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে প্রবল। এছাড়া, অনেকেই আমাদের কাছে দেরি করে আসছেন। সেক্ষেত্রে তাদের চিকিৎসায় জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।
ডেঙ্গুর উপসর্গ হলো- উচ্চমাত্রায় জ্বর, মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, পেশী বা জয়েন্টে ব্যথা ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছালে রক্তপাতও হতে পারে।
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।