মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

কোটা সংস্কার যেভাবে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে পরিণত হলো

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২০ আগষ্ট ২০২৪, ১৮:৫৪

ছবি: সংগৃহীত

কোটা আন্দোলনের উত্থান পর্বঃ

বাহান্ন থেকে দুহাজার চব্বিশ। দ্রোহ প্রতিবাদে যে দেশের জন্ম। সেখানে সবকিছুর জবাব আসে রাজপথ থেকে। বাংলাদেশে কেউ ছেড়ে কথা বলে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও, পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় ছাত্রজনতা। কোটা আন্দোলন রূপ নেয় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে।  

কোটাভিত্তিক পদ কমানো, শূন্য পদে মেধাভিত্তিক নিয়োগ ও সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণের দাবিতে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার। সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের জন্য খোলা থাকে কেবল ৪৪ শতাংশ।

আন্দোলনকারীরা প্রশ্ন তোলেন, স্বাধীনতার পরেও কী মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর? আর যদি মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর হন, তাহলে তাদের নাতি-নাতনিরা কীভাবে সেই যুক্তিতে অনগ্রসর হবেন? একজন যদি সংরক্ষণের সুবিধে পান, তার পরিবার কী তাহলে আর পিছিয়ে থাকেন? 

বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণিকে সুবিধা দেওয়ার কথা রয়েছে। রয়েছে নারীদের সুযোগসুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কথা আলাদা করে কিছু লেখা নেই। এই নানাবিধ সংরক্ষণের বেড়াজালে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। আর এতেই কার্যত আগুনে ঘি পড়ে। বৃহত্তর ক্ষেত্রে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নামে ছাত্রছাত্রীরা।    

আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম করে এভাবে কোটাকে ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি পর্যন্ত বাড়ানোর পিছনে আসলে অন্য এক রাজনৈতিক হিসেব রয়েছে। কোটা ব্যবহার করে সরকার তার অনুগত লোকদের সব খাতে বসাচ্ছে যেন সব ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে।

উত্তাল ক্র্যাকডাউন পর্বঃ

কোটাপ্রথা নিয়ে এবারের আন্দোলন ছিল শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দফা আন্দোলন। মূল আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে। ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপনও জারি করে সরকার। এর পর কেটে যায় ৬ বছর। ৫ই জুন, ২০১৮ তে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং কোটা পুনর্বহাল করা হয়। আবারও ফুঁসে ওঠে ছাত্র সমাজ। উত্তপ্ত হতে থাকে শিক্ষাঙ্গন।

ছাত্রদের অভিযোগ, এটা সরকারের কোটা পুনর্বহাল করার কৌশল মাত্র। কারণ বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব ক্ষেত্রই আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত। তাই তাদের দাবি ছিলো সংসদে আইন পাশ করে কোটা প্রথা সংস্কার করা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে বিক্ষোভকারীদের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানান এবং হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেন। অনুপ্রবেশকারীরা যাতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসে। কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় ৯৩ শতাংশ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে করার ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা বিক্ষোভে হতাহতদের বিচার দাবি করেন। কোটা আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।

সারা দেশে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে শুরু হয় ক্র্যাক ডাউন। বিভিন্ন বাহিনীতে থাকা সরকারের অনুগত লোকদের নামিয়ে দেয়া হয় রাস্তায়। অহিংস এই আন্দোলন ক্রমান্বয়ে সহিংস রূপ নেয় ১৫ জুলাই থেকে। যতই ভয় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা জয় করে জনতা হয়ে উঠে দ্বিগুণ দুর্দম।

শুরুতে কিছুটা পিছুপা হলেও, অনেকটা পাবজি স্টাইলে পালটা আক্রমণ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ৩ অগাস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে সরকার পদত্যাগের একদফা ঘোষণা দেওয়া হয়। ৪ অগাস্ট ঘোষণা করা হয় লং-মার্চের।

লিখেছেন রাজীব রায়হান

গণঅভ্যুত্থানে অবসান পর্বঃ

৫ আগস্ট সকাল থেকেই থমথমে ছিলো রাজধানী ঢাকার পরিবেশ। সকাল সাড়ে ১০ টায় শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে জড়ো হওয়া শুরু করলে আবারও অ্যাকশনে নামে পুলিশ। ছোড়া হয় টিয়ার শেল, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড।

সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের উপদেশ দেন এবং বলেন পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আইজিপিও বলেন, পুলিশও বেশি সময় কঠোর অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও বলেন পদত্যাগ করতে। পরে তিনি পদত্যাগে রাজি হন, এবং জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ রেকর্ড করতে চান।

পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে শাহাবাগে তৈরি হয় এক জনসমুদ্র। এবং সেই জনসমুদ্র যাত্রা শুরু করে গণভবনের দিকে। পরিস্থিতি ও দূরত্ব বিবেচনা করে সেনা প্রধান শেখ হাসিনাকে ৪৫ মিনিটের সময় বেঁধে দেন। তার ভাষণ রেকর্ডের প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়।

গণভবন থেকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে শেখ হাসিনা চলে আসেন তেজগাঁও পুরনো বিমান বন্দরে। সেখান থেকে তিনি বঙ্গভবনে এসে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দেন। আবারো ফিরে আসেন পুরাতন বিমানবন্দরে। বিমানবাহিনীর একটি পরিবহণ বিমানে ভারতে চলে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ।

বাঁধ ভাঙা উল্লাসে ঢাকার প্রতিটি রাস্তায় নামে আনন্দ মিছিল। লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় সারাদেশের সব রাজপথ। বিজয় উল্লাসের ধ্বনিতে কম্পিত হয় পুরো দেশ। জনতা গণভবনের দখল নেয়, নিয়ে যায় বিভিন্ন জিনিসপত্র। থানায় থানায় হামলা হয়, আক্রান্ত হয় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ভবন, আওয়ামী লীগ কার্যালয় এবং বহু নেতাকর্মীর বাড়ি। সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেয় দুর্বৃত্তরা।

কোনো সরকার যখন ছাত্রদের বুকে গুলি চালায় তখনই তার পতনের দিন গণনা শুরু হয়। জেনারেশন জেড বা জেন-জি দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে অধিকার কেড়ে নিতে হয়। এখন দায়িত্ব সজাগ থেকে পবিত্র মাতৃভূমি রক্ষা করা।

আন্দোলনের শিক্ষাপর্বঃ

ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো, কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। আসলে এই পতনের পিছনে শুধু কোটা সংস্কার ছিলো না। দীর্ঘ ১৫ বছরে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, বিরোধীদের দমনপীড়ন, সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ও গুম একত্রে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ফলে জনমনে যে ক্রোধের বারুদ জমা হয়, সেই বারুদেই আগুন দেয় কোটা সংস্কার আন্দোলন।

অনেক দিন ধরেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল চূড়ান্তভাবে এককেন্দ্রিক। মানুষের মনে সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায়, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় জনজীবনে কোন স্বস্তি নেই। সবমিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা হতাশা তৈরি হয়েছে।

সেখানেই একটা বিক্ষোভ কিংবা আন্দোলন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এবার কোটা নিয়ে একটা রেশনাল সিদ্ধান্ত দেখতে চেয়ে তারা মাঠে নামে। মুহূর্তের মধ্যে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা একে সমর্থন দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সরকারের অতি নার্ভাসনেস, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শক্তি প্রয়োগের দিকে ধাবিত করে। ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের। চলবে



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top