বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ফকিরদের যে আন্দোলন ভারতবর্ষের জমিনে ঝড় তুলেছিলো

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২২ জুন ২০২৪, ১৭:২৯

ছবি: সংগৃহীত
একজন পীর ফকির এর কাজ কি? কেবল সৃস্টিকর্তার আরাধনা করা, তার প্রসংশা প্রচার করা ও মানুষকে সংশোধনের পথে আহ্বান করা। কিন্তু জানেন কী, ধর্মীয় আন্দোলন  ছাড়াও এই পীর ফকির দরবেশদের একটি আন্দোলন ঝড় তুলেছিলো ভারতবর্ষের জমিনে। আজ হতে অন্তত ২৫৯ বছর পূর্বে। ১৭৫৭ সালের পরে প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হিসেবে এই আন্দোলনকে গণ্য করা হয়।
 
১৭৬০ সাল থেকে ১৮০০ সাল অবধি এই ৪০ বছর ধরে চলেছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সুফিসাধকদের আন্দলন। এদের সাথে যোগ দিয়েছিলো সনাতন ধর্মের সন্যাসীগণ এবং আন্দোলন গতিপ্রাপ্ত হয়ে কোনও কোনও অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সৃস্টি হয়েছিলো।
 
আন্দলনের নেতৃত্বে ছিলেন প্রখ্যাত সুফী সাধক হযরত ফকির মজনু শাহ (রঃ)। এজন্য ইতিহাসে এই আন্দলনকে ফকিরী আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়। সন্যাসীরা যোগ দানের পরে অনেকে এটিকে ফকিরী সন্যাসী আন্দলন বলে সম্বোধন করতেন। 
 
সংক্ষেপে ফকির মজনু শাহ (রঃ) এর পরিচয় দিলে বলা যায়, ওনার পুরো নাম হযরত ফকির মজনু শাহ বোরহান (রঃ)। ভারতের মিরাট শহরের অধিবাসী এই সুফীসাধকের জন্ম সাল জানা না গেলেও ওনার লোকান্তর হয় ১৭৮৭ সালে।
 
সৈয়দ বদিউদ্দিন কুতুবউল শাহ মাদার (রঃ) এর অনুসারী ছিলেন মজনু শাহ। কানপুরের নিকট মাকানপুরে শাহ মাদারের মাজারে তার কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল। যদিও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলনের কর্মকাণ্ড তিনি বাংলা প্রদেশেই বেশি পরিচালনা করেছিলেন। আর দিনাজপুরের বালিয়াকান্দিতে দীর্ঘদিন বসবাস করেছিলেন।
 
পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সমাজ সংসার হতে অব্যাহতি নিয়ে সৃস্টিকর্তার আরাধনায় মশগুল একজন সুফী তরিকার পীর সাহেব কেন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন? জবাবে বলা যায়, ১৭৫৭ সালে মীরজাফর আলী খান, উমিচাঁদ, রাজা রায়র্দূলভ, রাজা রাজবল্লভ, মহারাজা কৃষ্ণ, জগৎ শেঠ, ইয়ার লতিফ খান, খাদেম হোসেন আর ঘসেটি বেগমদের প্রসাদ ষড়যন্ত্রে পলাশীর প্রান্তরে বাংলা, বিহার, উরিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ-দৌলার পরাজয় ঘটে।
 
এর মধ্য দিয়ে এ জনপদে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে বৃটিশ শাসন সুদৃঢ করছিল, মুসলমান এবং সনাতন ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃস্টি করে সুযোগ নিচ্ছিলো, অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনাসহ অন্যান্য অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেয়াল রচনা করেছিলেন ফকির মজনু শাহ্।
 
ওনার মুরিদ অনুসারী এবং বাংলা মুলুকের বিভিন্ন অঞ্চলের পীর দরবেশগণের সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুরু করেন। এর মধ্যে সনাতন ধর্মের সন্যাসীরাও তার সাথে যোগ দেন। রংপুর, দিনাজপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বগুড়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভুম, মালদহ ইত্যাদি অঞ্চলে ফকিরি আন্দলনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়।
 
ফকির মজনু শাহের আন্দোলনের ধারাবাহিকতার ফল হচ্ছে মাওলানা নিসার আলী ওরফে তিতুমীরের ১৯২৫ সালে বারাসাত বিদ্রোহ ও ১৯৩১ সালে নারিকেল বাড়িয়ার বাঁশের কেল্লার প্রতিরোধ সংগ্রাম, হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তার পুত্র মাওলানা নেসার উদ্দিন দুদু মিয়ার ফরায়েজি আন্দোলন।
 
উল্লেখ থাকে যে, ১৭৬১ সালে উধুয়ানালার যুদ্ধ এবং ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মজনু শাহ বৃহৎ সংখ্যক মুসলিম ফকির ও হিন্দু সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিম অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মৈত্রী বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিলো মজুন শাহের ফকির বাহিনী।
 
১৭৬৩ সালে ঢাকা ও বরিশালে অবস্থিত ব্রিটিশদের বেশ কয়েকটি কুঠিবাড়ি দখলে নিয়েছিলেন মজনু শাহ এবং ১৭৬৪ সালে রাজশাহীর বোয়ালিয়ার ব্রিটিশ কুঠি দখল করেন তিনি। ১৭৭১ সালে ব্রিটিশ কতৃক ১৫০ জন নিরীহ সুফী সাধককে কামানের গোলার মুখে উড়িয়ে দেওয়ার খবর জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে ফকিরি আন্দোলন।
 
এসময় ঢাকার ব্রিটিশ প্রসাশনকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিলেন মজনুশাহের সুফীঘরানার সৈনিকেরা। যদিও ব্রিটিশ সৈনিকেরা ঢাকা পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নিলেও ১৭৭৩ সালে পুনরায় মজনুশাহের দল বড় একটি আক্রমনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন, এসময় ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড এর মৃত্যু হয়। এর পরপরই তারা রংপুরে ব্রিটিশ কুঠিতে আক্রমন করলে ব্রিটিশ সেনাপতি লেফটেন্যান্ট কিং পরাজয় ও মৃত্যুবরণ করেন।
 
১৭৭৩ সালে ক্যাপ্টেন টমাস বিশাল এক সৈন্য বহর নিয়ে রংপুরে ফকির মজনু শাহকে আক্রমন করলে যুদ্ধে ক্যাপ্টেন টমাসের পরাজয় ও মৃত্যু হয়। তুলনামুলকভাবে কম (মাত্র ১৫০০ জন) সুফীঘরানার যোদ্ধা নিয়ে তিনি এ বিজয় লাভ করেছিলেন।
 
ব্রিটিশদের কুঠি বাড়ি ও তাদের দোসর জমিদারদের রত্নভান্ডার লুণ্ঠন করে দরীদ্র কৃষকদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন ফকির মজনু শাহ। ফকিরি আন্দোলনের যোদ্ধারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন, বর্শা, তরোবারী, ত্রিশুল, পেতলের বাট অলা লাঠি, গাদাবন্দুক ইত্যাদি । যদিও ফকির মজনু শাহের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র মুশা শাহ আধুনিক রকেট ও মাস্কেট ব্যবহার করেছিলেন তার যুদ্ধে।
 
১৭৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি পাঁচশত সৈন্যসহ বগুড়া জেলা থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করার পথে কালেশ্বর নামক স্থানে ইংরেজ বাহিনীর সম্মুখীন হন। এই যুদ্ধে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হলে তাঁর অনুচরেরা রাজশাহী ও মালদহ জেলা অতিক্রম করে তাকে নিয়ে বিহারের সীমান্তে চলে যায়। এরপর ১৭৮৭ সালে মাখনপুর নামে এক পল্লিতে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের এই নায়কের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে।
 
তার মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র মুশা শাহ ফকিরদের নেতৃত্ব দেন এবং অত্যন্ত অবাক করার বিষয় হলো, নির্জন স্থানে সৃষ্টিকর্তার সাধনায় মগ্ন থাকা এই সাধু সমাজের লোকেরা মাস্কেট ও রকেটের সাহায্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন। ১৭৯২ সালে এক লড়াইয়ের সময় মুশা শাহ মৃত্যুবরণ করলে ফকিরি আন্দোলন স্তিমিত হতে শুরু করে।
 
যেসকল মুসলমান সুফী সাধক পীর সাহেব ও সনাতন ধর্মের সন্যাসী ও গুরুত্বপুর্ণ মানুষ ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে এই আন্দলনে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে, পরাগ আলী শাহ ও চেরাগ আলী শাহ ছিলেন অন্যতম যোদ্ধা।
 
রাজনৈতিক কলাকৌশল ও পরামর্শক হিসেবে ছিলেন ভবানী পাঠক তার বিচক্ষণতায় সর্বদা বিচলিত ছিলো ব্রিটিশরা, আর পুরো আন্দোলনের জোয়ান অফ আর্ক এর ভুমিকায় ছিলেন দেবী চৌধুরানী। পাঠক, ইনি সেই দেবী চৌধুরানী যাকে নিয়ে কথাসাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দেবী চৌধুরানী নামে উপন্যাস রয়েছে।
 
মূলত ১৭৫৭ সালের পরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস না পাওয়া জাতীকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির আঘাতের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যই এই আন্দোলনের নেতৃত্বদান করেছিলেন ফকির মজনু শাহ (রঃ)। 
 
সমাজমাধ্যমে লিখেছেন রাফাত নুর। সম্পাদনা: রায়হান রাজীব


বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top