ছেলের স্বপ্ন পূরণে রিকশাচালক বাবার ২০০ কিমি সাইকেল যাত্রা
Nasir Uddin | প্রকাশিত: ৮ জুন ২০২৫, ১৪:০৪

সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে একজন বাবা কী না করেন! গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর রাজু মিয়া (৫৫) প্রমাণ করলেন, ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থাকলে অভাব কোনো বাধা হতে পারে না। কোনো রেকর্ড বইয়ে নাম তুলতে নয়, উদ্দেশ্য নয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া; ঢাকা থেকে সাইকেলে করে ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার এই গল্পটা এক অসহায় বাবার।
ছেলের ইচ্ছা পূরণে রাজধানী ঢাকায় আড়াই মাস রিকশা চালিয়ে পুরোনো একটি বাইসাইকেল কিনে বাড়ি ফিরেছেন রাজু মিয়া। কিন্তু বাড়িতে তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলাদা করে কোনো পরিবহনভাড়া তাঁর সাধ্যের মধ্যে ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই সাইকেল চালিয়ে ঢাকার পথ ধরেন। গন্তব্য, গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে তালুকজামিরা কবিরাজপাড়া গ্রাম। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সেই সাইকেল তিনি তুলে দেন সন্তানের হাতে।
অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন রাজু মিয়া পেশায় দিনমজুর। প্রায় তিন শতক বসতভিটা ছাড়া কোনো সম্পদ নেই। এলাকায় কখনো দিনমজুরি করেন, কখনো রিকশা চালান। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। একমাত্র ছেলে রেজওয়ান মিয়া এ বছর পলাশবাড়ীর তালুকজামিরা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।
তাই ছেলের জন্য এক মাস আগে ঢাকার মহাখালী থেকে একটি পুরানো সাইকেল কেনেন রাজু।
রাজু মিয়া জানালেন, গত রমজান মাসে তিনি কাজের খোঁজে ঢাকায় যান। গিয়ে ওঠেন তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ার একটি মেসে। সেখানে থেকে ভাড়ায় রিকশা চালানোর কাজ বেছে নেন। প্রতিদিন উপার্জন হয় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এর মধ্যে প্রতিদিন রিকশাভাড়া, থাকা–খাওয়াসহ ৭৫০ টাকা খরচ হয়ে যেত। যা বাঁচত তা থেকে কয়েক দিন পরপর বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। আর ছেলের সাইকেল কেনার জন্য কিছু কিছু করে টাকা সঞ্চয় করতেন। ঈদুল আজহার আগে তাঁর সঞ্চয় হয় ৪ হাজার ৩০০ টাকা। নাখালপাড়া থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে একটি পুরোনো বাইসাইকেল কেনেন।
ছেলে রেজওয়ানের জন্য কেনা সাইকেল সমেত বাসে করে আসার জন্য ৩ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল রাজুর। তবে পকেটে সাকুল্যে আড়াই হাজার টাকা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ৫০০ টাকা আর এমন কী! তবে ওই আড়াই হাজারের মধ্যেই যে পরিবারের ঈদের খরচের সমীকরণ মেলাতে হতো রাজুকে। তাই ২০০ কিলোমিটারের কষ্ট সাধ্য যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন রিকশাচালক রাজু।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) ভোর ৫টায় মহাখালী থেকে গাইবান্ধা পলাশবাড়ীর উদ্দেশে রওনা হন। সাইকেল চালিয়ে বগুড়ায় যখন পৌঁছেছেন, তখন ঘড়ির কাঁটা অতিক্রম করেছে ২১ ঘণ্টা। মহাসড়কে মধ্যরাতে একজন সাইকেল আরোহীকে দেখে তল্লাশির জন্য থামানো হয় চেকপোস্টে। সেখানে রাজুর গল্প জেনে সহায়তার হাত বাড়ায় সেনাবাহিনী। একটি ট্রাকে সাইকেলসহ রাজুর যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা। সঙ্গে পথে খাবার জন্য দেন কিছু শুকনো খাদ্যদ্রব্য।
সেনাবাহিনীর তল্লাশি চেকপোস্টে রাজুর সঙ্গে কথা হলে রাজু বলেন, ‘কোনো উপায় না পেয়ে মহাখালী থেকে সাইকেলে করে একটি ব্যাগ নিয়ে রওনা হয়েছি। পথে তিনবার ৫০ টাকা করে দিয়ে কিছুটা পথ ভ্যানে করে পার হয়েছি। যমুনা সেতুতে আসার পর সাইকেল নিয়ে পার হওয়ার অনুমতি পাচ্ছিলাম না। পরে একটি মিনি ট্রাকে ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে সেতু পার হই। ওই ট্রাকটি গাইবান্ধা দিকে আসলেও ভাড়া দিতে পারব না, তাই আমাকে নামিয়ে দেয়।’
রাজু আরও বলেন, ‘দীর্ঘ পথ এভাবে পাড়ি দিতে পারব ভাবিনি বা আগেও এ রকম কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে ছেলের পড়াশোনার জন্য তাকে সাইকেল উপহার দিতে পারব- এটাই আনন্দ। সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে খাবার দেয়ার পাশাপাশি ট্রাকে করে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওনাদের জন্য নির্বিঘ্নে এখন বাড়ি ফিরতে পারব।’
সাইকেল পেয়ে খুব খুশি ছেলে রেজওয়ান। সাইকেল হাতে পেয়ে প্রথমেই বড় বোনের বাড়ি যায়, এরপর নানার বাড়ি। আজ ঈদের দিনেও সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুর বেড়িয়েছে সে।
রেজওয়ান জানাল, তার জন্য বাবার ওই ত্যাগস্বীকার সে কখনো ভুলবে না। লেখাপড়া করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চায় সে।
‘আমার বাবার মতো বাবা সবারই হোক। বাবাকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।’ বলল ভবিষ্যতে প্রকৌশলী হতে চাওয়া রেজওয়ান।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।