মাজার ভাঙ্গা সহজ, তবে ফকির হওয়া সহজকর্ম নয়

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২২ মে ২০২৪, ১৬:৪৩

ছবি: সংগৃহীত

মাজার ভাঙ্গা প্রসঙ্গে কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার বলেছেন, ইসলামে কখনো আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি। আপনি মত দিতে পারেন, ফতোয়া দিতে পারেন, কিন্তু কারও ওপর মত-ফতোয়া বাস্তবায়নের অধিকার আপনার নেই। আপনারা যারা মাজার ভাঙছেন, আপনাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই, এটা আমাদের কাছে পরিষ্কার।

বিশ্বে সাধারণত সুফি বা ধর্মীয় প্রচারকদের কবরকেন্দ্রিক মাজার গড়ে ওঠে। যেখানে অনেকে মনোকামনা পূরণের উদ্দেশ্যে মানত করে থাকেন। উল্টোদিকে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোয় মাজার কেন্দ্রিক ব্যবসা, মাদক ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। তবে মাজারে হামলা করা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত দিয়েছেন ইসলামিক স্কলাররা। তারা বলছেন, মাজার ভাঙা সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে না। বরং মাজারে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটলে, সেসব বন্ধ করা জরুরি।

উগ্রতা ও ধর্মান্ধতা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা নয়

আমরা যেন ভুলে না যাই যে উগ্রতা এবং ধর্মান্ধতা মহানবী (সঃ) এর প্রচারিত ইসলামের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম, যেখানে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা এবং ভালোবাসা রয়েছে। উগ্রতা দিয়ে কখনো সত্য দ্বীনের প্রচার সম্ভব নয়। ইসলামে মাজার জিয়ারত করা একটি সুন্নাত। মহানবী (সঃ) নিজেও তাঁর পিতামাতা এবং অন্যান্য প্রিয়জনদের কবর জিয়ারত করতেন। তবে ইসলামে মাজারে গিয়ে সেজদা করা সম্পূর্ণ হারাম। কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে আল্লাহ ছাড়া কাউকে সেজদা করা যাবে না।

পূজা ও জিয়ারতের পার্থক্য

গবেষকরা বলছেন, যারা মাজার জিয়ারতকে পূজার সঙ্গে তুলনা করেন, তারা কি আসলেই বিয়ে এবং যিনার মধ্যে পার্থক্য বোঝেন। যেমন বিয়ে বৈধ এবং যিনা হারাম, তেমনি মাজার জিয়ারত বৈধ কিন্তু মাজারে সেজদা করা হারাম। ইসলাম এই সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো বুঝতে এবং মানতে শিখিয়েছে। পীরের ভায়া হয়ে, সূত্র ধরে অনেকে আল্লাহর কাছে চান। কারুর উছিলা করে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া যাবে কী না, এই তর্ক বেশ পুরনো। অনেক ইসলামিক তাত্ত্বিক মনে করেন, জীবিত কারুর উছিলা করে চাওয়া যাবে। অনেকে মনে করেন জীবিত ও মৃত দুই ধরনের মানুষের উছিলা করেই চাওয়া যাবে আল্লাহর কাছে।

ইসলামের মৌলিক বিধান অনুযায়ী কবরের পর সেটিকে পাকা করে গম্বুজ করা বৈধ নয়, শরিয়তে অনুমতি নাই। আমাদের দেশে ইসলাম প্রচারে আসা হক্কানী পীর এবং দরবেশরা কেউই তাদের কবর ঘিরে মাজার গড়ে তুলতে নিজেরাও উৎসাহিত করেননি। কিন্তু তাদের ভক্তরা নিজেদের উদ্যোগে এসব গড়ে তুলেছেন। ইসলামের নানা রূপ ও মতাদর্শ আছে। সব মতাদর্শের সহাবস্থান বজায় রাখার জন্য সেক্যুলার ইসলাম বা ইসলামি নিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা জরুরি। ইসলাম প্রতিটি মানুষকে তার বিবেক দিয়ে ধর্ম মেনে নেওয়ার স্বাধীনতা দেয়। আল্লাহর হুকুম মেনে না চললে আখেরাতে বা শেষ বিচারের দিন তার শাস্তির হুঁশিয়ারি দেয়। দ্বীন এর ব্যপারে বাড়াবাড়ি করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে।

হক্কানী পীর ও ফকির কারাঃ

পীর ফকিরি প্রসঙ্গ উঠলেই মনোজগতে ভক্তি শ্রদ্ধার এক নির্মলচিত্র ফুটে ওঠে। জীবনে অনেকে বহু ফকিরের দর্শন পেয়েছেন। ফকির নিয়ে লোকমুখেও রয়েছে অসাধারণ সব কথাবার্তা। ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেওয়া ভিক্ষুকদের অনেকেই অজ্ঞতায়, অজ্ঞাতসারে ফকির সম্বোধন করেন। বস্তুত ‘ফকির’ বিশেষ্যটি অনেক উচ্চস্তরের মানুষের জন্য প্রযোজ্য হয়। এ উপমহাদেশের মানুষ পীর-ফকির, সুফি দরবেশগণকে আদিকাল থেকে সম্মানের চোখে দেখেন। ফকিরগণকে যথাসাধ্য ভক্তি, শ্রদ্ধা করেন। তাদের দর্শন পাওয়াকে সৌভাগ্য মনে করেন। তবে ফকিরদের সংজ্ঞা ঠিক কী রকম হলে যথার্থতা লাভ করবে বলা মুশকিল। তারপরও খানিক প্রচেষ্টা মাত্র।

ফকির গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ঃ

মুসলমানদের এ পদবীটি এসেছে সন্ন্যাসবৃত্তি থেকে। এটি পার্থিব জীবন ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করার প্রক্রিয়া। মরমী সাধকগণ ফকির পদবী গ্রহণ করতেন। পার্শি দরবেশ ব্যক্তিগণ সাধারণত এদেশে ফকির নামে পরিচিত হন। বিশেষ কোন ধর্মমতের একান্ত অনুসারী না হয়ে যারা সকল ধর্মের মূলনীতি নিয়ে আত্মতত্ত্বের সন্ধান করেন তাদেরকেও ফকির বলা হয়। আবার সুফি বা বাউল তত্ত্বের ধারকরাও ফকির নামে পরিচিতি পেয়েছেন। একসময় আরব থেকে যেসব দরবেশ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে এসেছিলেন লোকে তাদেরকেও ফকির বলে সম্বোধন করতেন। তারাও এই পদবী গ্রহণ করেছিলেন।

ফকির শব্দটি মহান আল্লাহর জন্য মানুষের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনকে বোঝায়। মুসলিম বংশোদ্ভূত হলেও, এই শব্দটি ভারতে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে, মূলত গোস্বামীন, সাধু, ভিক্ষু এবং অন্যান্য উপাধির পরিবর্তে। ফকিরগণকে সাধারণত পবিত্র পুরুষ হিসাবে গণ্য করা হয়, যারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হন। 

ফকির শব্দের মানে হলো সর্বহারা, যার কিছুই নেই এমন হতদরিদ্র, এর বহুবচন আরবিতে ফুকারা। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রেরণায় কিছু মানুষ সন্ন্যাসী হয়ে যান, দুনিয়ার কোন ধনসম্পদ তাঁরা চান না। গরিবীয়ানায় তাদের কোনও গ্লানি নেই। মুসলমানের মাঝে সন্ন্যাসী শব্দটা চালু নেই, বরং তাঁরা ফকির শব্দটি বেছে নেন। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী গুরুরা যেভাবে নিজেকে ভিক্ষু বা ভিখারী হিসাবে পরিচয় দেন। পীর ও ফকির এমন ব্যক্তি হতে পারেন যিনি দুনিয়াদারি ছেড়ে দিয়েছেন, আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে স্বেচ্ছায় দরিদ্রতাকে বেছে নিয়েছেন।

একজন ফকির হলেন ইসলামিক এবং দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্যে একজন ধর্মীয় তপস্বী বা পরোপকারী। ফকিরগণ তাদের চরম আত্মত্যাগ এবং তাদের বিশ্বাসের প্রতি ভক্তির জন্য পরিচিত। তারা একটি সরল এবং কঠোর জীবনযাপন করেন।ফকিরগণ তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং মহান আল্লাহর প্রতি উৎসর্গের জন্য সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয়। ফকিরগণ পবিত্র পুরুষ এবং অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী। ফকিরগণ প্রায়শই অলৌকিক কাজ এবং তাকওয়া প্রদর্শনের সাথে যুক্ত থাকেন।

সর্বত্যাগী, অনুরাগী তিনিই হন বৈরাগীঃ

এক সময় একজন হুজুর গাউছে পাকের কাছে ফকির কাকে বলে জানতে চান। উত্তরে তিনি বলেন, যিনি নফছানিয়ত খায়েশ ছেড়ে কেবল আল্লাহমুখি হয়েছেন এবং ফানা ফিশ শায়েখ, ফানাফির রাসুল, ফানাফিল্লাহর মকামে লাভ করেছেন তিনিই ফকির। ফকিরের আভিধানিক অর্থ গরিব, অভাবী, যার কিছুই নাই, যিনি দুনিয়া মুখাপেক্ষী নন। কাশফুল মাহজুব কিতাবে দাতা গন্জে বখশ লাহোরী (কঃ) বলেন, যারা জাহেরী ধনসম্পদের সম্পর্ক ছিন্ন করে রব্বে তায়ালার রেজামন্দি হাসিল করেছেন তিনিই ফকির। 

ফকিরি সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ফকিরী আমার থেকে অর্থাৎ সকল ফকিরী আসে রাসুল (সা.) হতে। ফকিরী, দরবেশী আল্লাহর নিয়ামতের অন্যতম ভান্ডার। ফকির চুপচাপ থাকেন, কিন্তু তার ক্বালব সদা আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকে, ঈমানী নূরে পূর্ণ থাকে। ফকির সম্পর্কে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, এমন অনেক লোক আছেন যাদের মাথার চুল এলোমেলো, যারা মানুষের দুয়ার হতে বিতাড়িত। যদি তারা আল্লাহর নামে শপথ করে কিছু বলেন তা কবুল হয়ে যায় (মুসলিম শরীফ)। তারা একমুহুর্তও আল্লাহর জিকির হতে গাফেল হন না। মজ্জুব পর্যায়ের ওলীআল্লাহগণ এমনই হয়ে থাকেন।।

ফকির (গোষ্ঠী) ইতিহাস এবং উৎপত্তিঃ

ফকির হল ভারতের একটি মুসলিম জাতিগোষ্ঠী। ফকির [সৈয়দ] বা ফকির (আরবি: فقیر (ফকরের বিশেষ্য) শব্দটি ফকর (আরবি: فقر, দারিদ্র) থেকে এসেছে। ফকির, শাহ, আলভি সৈয়দ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। অর্থাৎ তারা শাহ, আলভী এবং সুফি নামেও পরিচিত। তারা সৈয়দ বংশের সূফী সাধকদের বংশধর, আলীর (আলি ইবনে আবু তালিব রা.) কাছে পাওয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার একজন মুসলিম সুফি তপস্বী। 

দক্ষিণ এশিয়ায় ফকিরগণ দরবেশদের ইসলামের  শিক্ষা দিচ্ছিল। এই সম্প্রদায়টি আরব মুসলিম সুফি সাধক বদি আল-দীন দ্বারা গঠিত হয়েছিল এবং তিনি সিরিয়া থেকে ভারতে এসেছিলেন। তার অনুসারীরা শাহ উপাধি ব্যবহার শুরু করেন। ফকিরগণ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর যেমন তুর্কি, আরব, রাজপুত, পাঠান ইত্যাদি।

ফকির একটি বিশেষ্য শব্দ, যার বিভিন্ন অর্থ রয়েছে (যেমন নিঃস্ব, দারিদ্র্য, সর্বহারা)। যারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের ফকির বলা হয়। আবার সংসারত্যাগী মুসলমান ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী বা সাধু পুরুষকেও ফকির বলা হয়। ফকির একটি পদবি এবং উপাধি। এই নামের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্যে রয়েছেন: পদবি: ফকির মোহন সেনাপতি (১৮৪৩–১৯১৮), ভারতীয় লেখক। উপাধি: লালন ফকির (১৭৭২–১৮৯০), আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। আজান ফকির (১৭ শতাব্দী), সুফি সাধক ও কবি।

পশ্চিমবঙ্গের শাহজি ফকিরঃ

পশ্চিমবঙ্গের ফকিরগণ শাহজি নামেও পরিচিত। তারা শাহজি নামটি ধারণ করেছিলেন কারণ তারা বিখ্যাত বাঙালি সুফি সাধক শের আলী শাহজির অনুসারী ছিলেন। বেশিরভাগ ফকির বিখ্যাত সুফি আব্দুল কাদির জিলানীকে তাদের পরামর্শদাতা বলে মনে করেন এবং বাংলার অধিকাংশ ফকির এইভাবে কাদরিয়া সুফি অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত। একটি ছোট সংখ্যা চিশতী, মাদারিয়া, মোজাদিদি এবং নকশবন্দিয়া আদেশের অন্তর্গত।

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো, ফকিরগণ মূলত সুফিবাদীদের একটি সম্প্রদায় থেকে বিবর্তিত হয়েছে যা একটি অন্তঃবিবাহী জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এরা প্রধানত নদীয়া, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা, বাঁকুড়া, বীরভূম এবং পুরুলিয়া জেলায় বাস করে। পশ্চিমবঙ্গের সিংহভাগ ফকিরগণ এখন চাষী, বহু বর্ণের গ্রামে বসবাস করেন, তাদের নিজস্ব এলাকায় ফকির পাড়া নামে পরিচিত। অল্প সংখ্যক ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকও রয়েছেন। ফকিরগণ ইসলামের সুন্নি সম্প্রদায়কে অনুসরণ করেন। কিন্তু তারা বেশ কিছু লোক বিশ্বাসের চর্চা করেন, যাকে সম্মিলিতভাবে ফকিরমত বলা হয়। এর মধ্যে সুফি সাধকদের বিশেষ শ্রদ্ধা জানানো জড়িত। 

ফকির বলতে বুঝানো হতে পারেঃ

ফকির (আরবি: الفقير) হল একটি ইসলামি পরিভাষা, যা ঐতিহ্যগতভাবে সে সকল সুফি মুসলিম তপস্বীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যারা তাদের পার্থিব সম্পদ ত্যাগ করেন এবং আল্লাহর উপাসনায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। তারা অগত্যা সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং দারিদ্র্যের শপথ নেন। তাদের কেউ বাস্তবে দরিদ্র হতে পারেন এবং কেউ ধনীও হতে পারেন, তবে অস্থায়ী পার্থিব জীবনের উপকরণ আল্লাহর প্রতি তাদের অবিচ্ছিন্ন উৎসর্গ থেকে বিরত হয় না।

তারা জিকিরের প্রতি যত্মবান ও শ্রদ্ধাশীল হন। মুসলিম বিশ্বে সুফিবাদের আবির্ভাব হয় উমাইয়া খিলাফতের সময় (৬৬১-৭৫০) এবং এটি ইসলামের দুটি মূলধারা সুন্নি এবং শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি রহস্যময় ঐতিহ্য হিসেবে বেড়ে ওঠে।

সুফি মুসলিম তপস্বীগণ (ফকির ও দরবেশ) ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ব্যাপকভাবে সফল ছিলেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা, বলকান, ককেশাস, ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে তাদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সুফি মুসলমানগণ দীর্ঘ একটি সহস্রাব্দ ধরে বিভিন্ন মহাদেশ ও সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছেন এবং আরবি, ফার্সি, তুর্কি, ভারতীয় ভাষাসহ বিশ্বের সকল প্রসিদ্ধ ভাষায় ইসলামের প্রচার ঘটিয়েছেন।

ফকির শব্দটি এমন একজন সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যিনি পার্থিব সম্পদ ত্যাগ করেন। এমনকি অমুসলিমদের ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ফকিরদের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে এবং তাদের বিশেষ ঐশী শক্তির অধিকারী মনে করা হয়। শব্দটি প্রায়শই হিন্দু সন্ন্যাসীদের (যেমন: সাধু, গুরু, স্বামী ও যোগী) ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়। এই ব্যবহারগুলি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল যুগে বিকশিত হয়েছিল।

উত্তর ভারতে ফকিরদের একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীও পাওয়া যায়, যারা সুফি মাজারে বসবাসকারী ফকিরদের সম্প্রদায় থেকে এসেছে। প্রথম শিখ গুরু শ্রী গুরু নানক দেব জিও "নানক শাহ ফকির" নামে পরিচিত ছিলেন। মাওলানা মাজদ্দেদ্দিন আলী বাগের শাহ তার একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থে বলেন, "সুফি এমন একজন ব্যক্তি, যার আধ্যাত্মিক তপস্যার কারণে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে এবং যিনি তার আসল পরিচয় জেনেছেন। সুফিরা একেবারে দরিদ্র হন এবং জীবনের সত্য ছাড়া আর কিছুই দেখেন না।"

ফকির শব্দটির ব্যুৎপত্তি ও ইতিহাসঃ

ব্যুৎপত্তিগতভাবে ফকির শব্দটি আরবি। এটি ফকর (আরবি: فقر) শব্দমূল থেকে এসেছে। এর অর্থ হল দরিদ্র হওয়া বা দুঃখী হওয়া। এ হিসেবে ফকির শব্দের বাংলায় অর্থ হয় দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত বা দুঃখী। 

গবেষকরা বলেন, ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবি তালিবের (রা.) পুত্র এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি হুসাইন ইবনল আলী তাসাউফের বিষয়ে মিরাত উল-আরফিন নামে একটি বই লিখেছিলেন। ধারণা করা হয় এটি সুফিবাদের প্রথম বই। বিভিন্ন কারণে উমাইয়াদের শাসনামলে এই বইটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।

হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর পরে দীর্ঘকাল ধরে ফক্‌র, তাসাউউফ ও সুফিবাদের তথ্য ও শিক্ষা হৃদয় থেকে হৃদয়ে স্থানান্তরিত হতে থাকে। তবে এসব কথার কোনও শক্তিশালী, ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় না। সে হিসেবে অনেক গবেষক এসব কথা মেনে নিতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন।

বাংলায় ফকির বলতে দুটি অর্থ প্রকাশ করে, যার একটি মূলত একজন সন্ন্যাসী, সাধু পুরুষ বা দরবেশকে বোঝায়। শব্দটি মুসলিম বংশোদ্ভূত হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে এটি গোস্বামী, সাধু, ভিক্ষুক এবং অন্যান্য উপাধির মতো হিন্দু তপস্বী এবং রহস্যবাদীদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে।

ফকিরগণ সাধারণত অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী পবিত্র পুরুষ হিসেবে বিবেচিত হন। মুসলমানদের মধ্যে ফকিরগণের প্রধান সুফি তরিকা হল: মাদারিয়া শাদিলিয়াহ, চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া এবং সোহরাওয়ার্দিয়া। কেমব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারী ফকির শব্দটিকে "ইসলাম ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য বা একজন পবিত্র মানুষ" হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

লিখেছেন রাজীব রায়হান

ফকিরের গুণাবলী নিয়ে পণ্ডিতদের মতঃ

একজন ফকিরের ঠিক কী গুণাবলী থাকতে হয় সে বিষয়ে অনেক মুসলিম পণ্ডিত মত দিয়েছেন। বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আবদুল-কাদির জিলানি সুফিবাদ তাসাউউফ ও ফকরকে চূড়ান্তভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। ফকিরের গুণাবলী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ফকির সে নয় যে কিছু করতে পারেন না এবং তার আত্মসত্তায় কিছুই নেই। ফকিরের খোদাপ্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে এবং তা তার থেকে প্রত্যাহার করা হয় না।

ইবনে আরাবী ফকিরসহ সূফীবাদকে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি এই বিষয়ে ৫০০ টিরও বেশি বই লিখেছেন। তিনিই প্রথম মুসলিম পণ্ডিত যিনি খোলাখুলিভাবে ওয়াহদাত আল-ওজুদের ধারণাটি প্রবর্তন করেছিলেন। তার লেখা এই বিষয়ে একটি চমৎকার উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়।

প্রসিদ্ধ মুসলিম সাধক সুলতান বাহু একজন ফকিরকে ‘আল্লাহর কাছ থেকে পূর্ণ কর্তৃত্ব অর্পণ করা হয়েছে‘ বলে বর্ণনা করেছেন। একই গ্রন্থে তিনি বলেন, ফকির আল্লাহর একত্বে বিলীন হয়ে অনন্তকাল লাভ করেন। সে যখন নিজেকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছ থেকে মুছে ফেলেন, তখন তার আত্মা ঐশ্বরিকতায় পৌঁছে যায়।

ফকিরতন্ত্রের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণঃ

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল ফাক্করু ফাক্করি আল ফাক্করু মীন্নি” অর্থাৎ ফকির আমার ভিতর আর আমি ফকিরের ভিতর ৷ ফকির অতি সূক্ষ্ম শব্দ, চারটি আরবি হরফের (ফা, ক্বফ, ইয়া, র) সমন্বয়। এই চারটি অক্ষরে আল্লাহর আটটি গুণবাচক বা বিশেষ শক্তির বহি:প্রকাশ বুঝায়। এই চারটি বর্ণ বিশ্লেষনে কী পাওয়া যায় ৷

(ফা- ফানাফিল্লাহ) ফানা বা একান্ত ইচ্ছাশক্তি। অর্থাৎ নিজেকে মহান আল্লাহর প্রেমে বিলীন করে দেওয়া ৷ নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছার উপর ফানা করে দেওয়া। ফানা ফিল্লাহ অর্থ আল্লাহতে বিলীন হয়ে নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দেওয়া। যেমন লবণ পানিতে মিশে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে, তেমনিভাবে সাধক আল্লাহর মাঝে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেন। যখন লোহাকে আগুনের মধ্যে রাখা হয় তখন আগুনের গুণাগুণ লোহাতে বিলীন হয়। ঠিক তেমনিভাবে সাধক যখন আল্লাহর মোরাকাবা-মোশাহেদা করতে করতে এস্কের মধ্যে ডুবে যান, তখন মাবুদের গুণাবলি ওই সাধকের মধ্যে চলে আসে, কিন্তু জাহেরী লোকজন তা বুঝতে পারেন না।

(ক্বফ- কানাআত) রবের ক্বাফশক্তি। অর্থাৎ জিকির এর মাধ্যমে কালবকে জিন্দা রাখা ৷ ক্বফ দ্বারা বুঝায় অন্তরকে আল্লাহর প্রেমে পরিশুদ্ধ করা, তার রেজামন্দির কাজে মগ্ন থাকা। ক্বফ শক্তি অর্থাৎ আধ্যাত্মিক মহাশক্তির ভেতর ছয়টি ভাবের অবস্থান পাওয়া যায়। অর্থাৎ কাফ অক্ষর দ্বারা মহান আল্লাহ ছয়টি নামের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। হাকীকতের কাইউমিয়াতকে সৃষ্টির মধ্যে স্থায়িত্ব দান করবার জন্য ‘কাফ'। ‘কাফ' দ্বারা মহান আল্লাহর যে কয়টি নাম পবিত্র কোরআনে পাওয়া যায়, তার সবই শক্তিধর নাম। যথাঃ কাইউমুন, কুদ্দুসুন, কাবিউন, কাদিরুন, কাবিদুন, কাহ্ হারুন।

১। কাইউমুন- চিরস্থায়িত্বের শক্তি, (স্থায়িত্ব নির্ধারিত করা হলো)। ২। কুদ্দুসুন- দুর্বল ও অধঃপতিতকে উন্নত মর্যাদা দানকারী শক্তি। ৩। কাবিউন- চিরঞ্জীব শক্তির উৎস। ৪। কাদিরুন- শক্তিশালী, (সৃষ্টিকে শক্তি দেওয়া হলো)। তকদীর কিংবা ভাগ্য নয় বরং কর্মবৃত্ত দানকারী শক্তি। সৃষ্টিজীব নিজ ক্ষমতায় এই বৃত্ত বদলাতে পারে না। নেক আমলের দ্বারা কাদির শক্তির নির্ধারিত নিয়মেই পরবর্তী কর্মবৃত্ত প্রাপ্ত হয়। বস্তুজগতের সীমা ডিঙ্গিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে হয়।

৫। কাবিদুন- নিয়ন্ত্রক, (সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করা হলো)। ভাঙ্গন ক্রিয়ার শক্তি বর্ধন করে সৃষ্টি হতে কোন কিছু নিশ্চিহ্ন করে ফেলার শক্তি সৃষ্টিকে দান করা হলো। আর এই সকল কাফ শক্তি অর্জন করার পরে তিনি হন মহান সাধক। ৬। কাহ্ হারুন- অপ্রতিহত ক্ষমতা, ধ্বংসকারী, (যা ক্ষণস্থায়ী ও মিথ্যা, তা ধ্বংস করা হলো)। 

(ইয়া- ইয়াদে ইলাহি) নির্দিষ্টতা। অর্থাৎ আল্লাহর ধ্যানে সর্বদা মগ্ন থাকা ৷ আল্লাহর ভয় অন্তরে রেখে তার নিকট চাওয়া। (র- রব বা রিয়াযত) রাক্কাতে কালব। অর্থাৎ আল্লাহর প্রেমরসে নিজেকে সর্বদা ডুবিয়ে রাখা ৷ (র) দ্বারা আন্তরিক নম্রতা, কোমল চিত্ততা বুঝায়। রেসালাত বা রেয়াজত করে রসুলতত্ত্বের সাথে মিলিয়ে যাওয়া। 

ফকিরীতত্ত্ব আয়ত্ত্ব করার প্রয়োগসংক্রান্ত ক্রিয়াকরণঃ

'ফক্বীর' এর আক্ষরিক অর্থ 'ফে' অর্থ ফানা, 'ক্বফ' অর্থ খোদায়ী শক্তি এবং 'রে' অর্থ রাজি থাকা। যাঁরা সর্বাবস্থায় খোদায়ী শক্তির মধ্যে রাজি-খুশি থাকেন তাঁরাই ফক্বীর। যাঁরা কেবল আল্লাহ মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটান তারাই ফকির।

আভিধানিক অর্থ হলো তত্ত্বজ্ঞানী, খোদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ব্যক্তি, সরল মনের অধিকারী, শুভ চিন্তার ধারক-বাহক, কলন্দর, সৎ গুণসম্পন্ন ব্যক্তি, চারিত্রিক সৌন্দর্যের অধিকারী। ফারসি দরবেশ শব্দটি এর সমার্থক, তাই ফকির-দরবেশ জোড়া শব্দ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

ফকির অর্থ হলো অভাবী, যিনি দরজায় অপেক্ষমান থাকেন। তবে যারা মানুষের দরজায় অপেক্ষা করেন তারা হলেন ভিক্ষুক। আর সাধু পুরুষগণ যেহেতু সদা আল্লাহর দরবারে (দরজায়) নিজেকে অপেক্ষমান রাখেন তাই তাদের ফকির নামে অভিহিত করা হয়। ফকিরের ক্রিয়ারূপ হলো ফকিরী।

কোরআনুল কারিমের ৪৭ নম্বর সূরা মুহাম্মদের ১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'ইয়া আইয়ুহান নাস! আন্তুমুল ফুকারাউ ইলাল্লাহ, ওয়াল্লাহু হুওয়াল গনিয়ুল হামিদ।' অর্থ-হে মানব, নিশ্চয়ই তোমরা সবাই আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী তথা ফকির (রিক্ত ও নিঃস্ব); আর আল্লাহ তায়ালাই হলেন একমাত্র ধনী ও স্বনির্ভর এবং সদা প্রশংসিত।

বিলাসিতাহীন, অনাড়ম্বর ও অনাসক্ত জীবনের প্রতীকঃ

ধর্মের বাহ্য আচারে ফকিরদের তেমন আস্থা নেই। লোকদেখানো আন্দাজি পথ তাদের অপছন্দ। তারা আত্মমগ্ন উদাসীন ও আত্মতৃপ্ত। তাদের কিছুমাত্র ভোগসুখ বা ভালভাবে বাঁচার বাসনা নেই। উপাস্যকে তারা অন্তরে চান বলে পার্থিব কিছু চান না।

চাহিদা নেই, প্রতিষ্ঠাকামী নন, অথচ বিনীত, অকৃত্রিম ও অনাড়ম্বর। সবকিছু ত্যাগ করে তবেতো ফকির হওয়া যায়। আসল ফকিরী মতে বাহ্য আলাপ থাকে না, অর্থাৎ তার সবটাই অন্তর্জগতের ব্যাপার, ধ্যানময় ও নীরবতালব্ধ। 

ধর্মনিষ্ঠ মোমিন মুসলমান চান বেহেস্ত, হিন্দুরা চান স্বর্গ। ফকির এর কোনওটাই কামনা করেন না। তিনি চান আত্মস্থ হতে। জপ ধ্যান জিকির তার কাম্য, কাম্য আল্লাহ। তাই তাঁর ধ্যানে তিনি ‘ফানা’ হতে চান, হতে চান দিওয়ানা। তাঁর কাছে পার্থিব সবকিছু ম্লান, তাৎপর্যহীন, অসার। সবার অধম হয়ে দীনাতিদীন হয়ে খোলামেলা নিসর্গের মধ্যে তাদের উপাস্যসন্ধান।

নিজের শরীর-মন-সত্তাকে উত্তরণের পথে নিয়ে যেতে হলে পার্থিবভাবে ভারমুক্ত হতে হবে— অর্থাৎ বিষয়বৈভব সাজসজ্জা ত্যাগ করতে হবে। ফকিরীপন্থার সুচনাই হয়েছে একরকম দ্রোহ বা প্রতিবাদ থেকে। নির্জন সাহসে আড়ম্বরপূর্ণ, বিলাসপ্রিয়, ভোগাসক্ত জীবনের বিপরীত মেরুতে নম্র প্রতিবাদ।

‘জিক্‌র্‌’ অর্থাৎ জপ, ‘রাবিতা’ অর্থাৎ সংযোগসূত্র এবং ‘মুরাক্কিবহ্‌’ অর্থাৎ সতত জপ করার সঙ্গে সংসার অনাসক্ত মনকে শুদ্ধ করে রাবিতা অর্থাৎ সংযোগসূত্র বা গুরুর মাধ্যমে বিশুদ্ধ মনে শান্ত হয়ে আল্লার ধ্যান (মুরাক্কিবহ্‌) করে আলোকময় পরমে (নূর) নিজেকে বিলীন করতে অহংলোপ হলো সবিশেষ জরুরি। অহং লুপ্ত ‘ফনা ফিল্‌লাহ্’ অবস্থাও শেষ নয়, সেই অবস্থার ভেতর শাশ্বত হয়ে থাকা অর্থাৎ ‘বক্কা বিল্‌লাহ্‌’ হল শেষ পরিণতি। 

অর্জন করতে হয় দেহের ওপর মনের কর্তৃত্বঃ

সুফিদের রহস্যভাবনা, ধ্যান-জপ-অনুভবের একান্ত আত্মস্থ জগৎ। সেই আত্মস্থতা অর্জনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হল দেহ। দেহ মানে কামনাবাসনাবদ্ধ অস্তিত্ব, লোভে মোহে বন্দিসত্তা, আলস্যপ্রবণ, বিরামপ্রয়াসী, ভোগী আর ইহজগতের দাস। অথচ এই দেহকে ঘিরেই কায়াবাদীদের সাধনা। সুফিরা যে নিরন্তর জিকির আর মুরাকাবার সাহায্যে স্থিত হতে চান ‘ফানা’ স্তরে এবং তাকেই শাশ্বত করে হতে চান ‘বাকা’, তার জন্যে দেহের নিয়ন্ত্রণ দরকার। অর্জন করতে হয় দেহের ওপর মনের কর্তৃত্ব।

ফকিরিতন্ত্র— সুফিতত্ত্ব থেকেই সম্ভবত আত্মতত্ত্ব উদ্‌বোধনে ব্রতী হয়েছে। ফকিরদের স্বরূপ তথা ফকিরিয়ানা বুঝতে গেলে ইসলাম বুঝতে হবে প্রথমে, তারপরে অনুধাবন করতে হবে সুফিতত্ত্ব।

দরবেশের প্রতিশব্দ রূপে নানাভাবে নানা শব্দ এসেছে। ফকির, কলন্দর, আজাদি বা মিসকিন। কোনটা আরবি, কোনটা বা ফারসি।… দরবেশিয়ানায় ব্যাখ্যায় আছে, ‘ফকিরিয়ানা, গরিবিয়ানা, দরবেশিয়ানা গুজরান ইয়া মেজাজ।’ ফকির, গরিব, মিসকিন শব্দের মধ্যে দারিদ্র, নিঃসম্বলতা, নিঃস্ব অবস্থাও বোঝায়। সেটা যে আদৌ আধ্যাত্মিক তা কিছু নয়। গরিব সাধারণ প্রতিশব্দ ফকির। কিছু না থাকা যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানোই যেন এদের চিহ্ন, আস্তানা তো মানুষকে আটকে দেবে।

হয় দীনদারি না হয় দুনিয়াদারিঃ 

তলিয়ে ভাবলে মনে হতে পারে ফকিরিয়ানার দুটো চেহারা। একটা হল দীন দরিদ্র নিঃসম্বল নিঃস্ব মানুষ। আরেকটা হল একরকম ত্যাগব্রতী প্রবণতা, স্বেচ্ছায় মেনে নেওয়া দরিদ্র ঠাঁইনাড়া জীবন। এক্ষেত্রে বোঝা দরকার, জীবনকে গ্রহণ করবার দুটো ছক আছে— হয় দীনদারি না হয় দুনিয়াদারি। দুনিয়াদারি হল ভোগসুখ সহায় সম্পদ সম্পত্তি কর্তৃত্ব এবং তার পরিণামে অনিবার্য দুঃখ শোক বেদনা। আর দীনদারি মানেই বাহ্য উপভোগের সম্পদ আহরণের পথ ছেড়ে স্বেচ্ছায় দরিদ্র নিরুপাধি জীবনকে মেনে নেওয়া। 

অনেকে মনে করেন শরিয়তের পথ ছেড়ে যাঁরা মারফতির পথে এসেছেন তাঁরাই বুঝি ফকির। কিন্তু হিন্দু ফকিরও বহু আছেন। ফকিরিয়ানা একটা Life style বা জীবনপ্রবণতা বলাই ভাল। সুফিপন্থীরা ও সাধকরা পদব্রজে ঘুরে বেড়াতেন সর্বত্র। তাঁদের বাণী ও উপদেশ অনেক ব্যাপ্ত ছিল। ফকির, দরবেশরা তো স্বভাবেই ভ্রাম্যমাণ। তারা জমির টানে কোথাও স্থায়ী বাস্তু স্থাপনের নেশায় ছিলেন উদাসীন। ফকিরদের স্বর্গকামনা নেই, মানবদেহেই বেহেস্ত তাদের। ফকিরিয়ানার শেষ কথা হল গোপনীয়তা। জাহির নয় বাতুন, তাকে তালাশ করতে হবে অতলতার গোপনে। 

ফকির হওয়া সহজ কর্ম নয়ঃ

গবেষকদের অনেকে বলেন, যিনি প্রকৃত ফকিরী নিবেন তার জায়গা জমি, ধন দৌলতের প্রতি মোহ ত্যাগ করতে হবে। তাকে এসব কিছু বিসর্জন দিতে হবে। আমাদের রাসুল (সা.) ছেঁড়া মাদুরে ঘুমাতেন। কখনও প্রিয় নবী (সা.) দিনে দুবেলা খেয়েছেন আবার না খেয়েও থেকেছেন।

অদ্বিতীয় রবের প্রতি ফানাফিল্লাহ হয়ে (স্বীয় অস্তিত্ব বিলীন করলে) রবের ক্বাফশক্তিসমূহ অর্জিত হলে তাকে ফকির বলা যাবে। ইহকাল ও পরকালের সকল কিছুর (নেয়ামতের) স্বাদ, কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্খা পরিত্যাগ করতে হবে। স্বীয় অস্তিত্বকে (নফসকে) বিলীন করে আল্লাহ্‌র মধ্যে বিলীন বা ফানা (ফানাফিল্লাহ) হয়ে যাওয়াকে ফকিরী বলে। যে ব্যক্তির ফকিরী হাসিল হয়েছে তাকে ফকির বলে। ফকির যখন ফানায় পূর্ণতা লাভ করে বা বাকা লাভ করে, তখন এক অদ্বিতীয় সত্ত্বা আল্লাহ্‌ এবং ফকিরের মধ্যে কোনো অন্তরায় থাকে না।

যিনি নিজেকে যিকিরের মাধ্যমে ধ্যানের ঘরে আল্লাহর জাতের সাথে বিলীন করে দিয়েছেন, নিজেকে আল্লাহর প্রেম রসে সর্বক্ষণ ডুবিয়ে রেখেছেন, তিনিই ফকির ৷ মহান আল্লাহ বলেন, আল ফাক্করু ফাক্করি আল ফাক্করু মীন্নি। অর্থ: ফকির আমার ভিতর আর আমি ফকিরের ভিতর।

সাধনার চারটি পথঃ জীবাত্মা ও পরমাত্মার তত্ত্ব

সুফিবাদের চারটি স্তর হচ্ছে শরীয়াহ,ত্বরীকত,হাকীকত ও মারিফাত। ''শরীয়ত একটি বৃক্ষ, তরীকত তার শাখা-প্রশাখা, মারিফত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল।

শরিয়ত মানে যা শরাসম্মত। ধার্মিক মুসলমানরা দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যেসব বিধান মেনে চলেন সেগুলি ‘কোরান’ ও ‘হাদিস’ থেকে পাওয়া। এ ধরনের বিধানগুলিকে একত্রে বলে ‘শরিয়ত’। ‘তরিকত’ মানে যা বিভিন্ন তরিকা বা মার্গসম্মত। ‘হকিকত’ অর্থে যা হক (ন্যায়) সম্মত। আর ‘মারফত’ বা মারিফত হল অধ্যাত্ম জ্ঞানের পথ। সুফিরা নেন তরিকতের মার্গ। এ পন্থায় জিকির সহযোগে মুরাকিবা বা সতত সাধনার সাহায্যে পরম প্ৰেয়র সঙ্গে অভেদ হওয়ার প্রয়াস পান সাধক। এই প্রয়াসে ‘ফানা’ বা অহং লুপ্ত হওয়াই চরম নয়, শেষ কথা হল ‘বাকা’ অর্থাৎ ফানায় চিরন্তন হয়ে যাওয়া।

সুফিরা ভাবসাধক ও আত্মস্থ। ইসলামের নানা কর্মকাণ্ড ও আকিদা-র বাড়াবাড়ির চেয়ে তাঁরা নিভৃত নির্জনে একক ধ্যানে ও অনুভবে একীভূত হতে চান এবং সেই একীভূত অবস্থাতেই থেকে যেতে চান বরাবরের জন্য। আসলে সুফিবাদ ইসলামের এক ভিন্ন দিশা, যা মুক্তমনা ও বিচারশীল মুসলমানদের ভাবাশ্রয় দিয়েছে বহুদিন ধরে। এদেশে ফকিরি মত গড়ে উঠেছে বহুলাংশে সুফিবাদের অনুপ্রেরণায়।

পরমতসহিষ্ণুতায় জিরো টলারেন্স নয়ঃ

প্রচলিত ফকির সমাজ ও তাদের কার্যক্রম নিয়ে আলেমদের একাংশ সমালোচনা করেন। তারা বলেন, বর্তমান ফকিরদের কেউ কেউ ইসলামের ঐশী স্প্রিট থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন।

তাদের মতে, ফকির ও সুফি একই স্তরের নয়। সুফিবাদ মূলত ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে শরিয়ত মেনে চলে আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের শিক্ষা দেয়। বিপরীতে প্রচলিত ফকিরগণ শরিয়ত থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন মনগড়া পন্থা অবলম্বন করে আত্মিক মুক্তির জন্য সাধনা করেন। 

তবে গবেষকদের অনেকে বলেন, বৈষয়িক জ্ঞান দিয়ে ভেদজ্ঞানকে বুঝা কঠিন ব্যাপার। ভাসা ভাসা এক বস্তা ধর্মশাস্ত্রের পাণ্ডিত্য দিয়ে এই বিষয়টি বুঝবার কোন ব্যবস্থাপত্র নেই। যেসব আলেমের বাহ্যিক তথা পুস্তকের জ্ঞান ছাড়া ভেদজ্ঞানের অভাব ছিল, তাদের যুক্তি ইলমে গায়েব তথা মারেফত দর্শনের কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছিল।

তাঁদের একটা কথা হল আল্লার অনুভব হতে পারে ‘সিনা’-য় অর্থাৎ হৃদয় দিয়ে, ‘সফিনা’-য় অর্থাৎ শাস্ত্রগ্রন্থ মাধ্যমে নয়। তাই অন্তরঙ্গ অনুশীলনই মারেফত। ‘সাধারণ প্রথাগত শাস্ত্রীয় পথে মানসিক শান্তি, আত্মগত জ্ঞানলাভ, আত্ম-উৎসর্গ ও আত্ম-সংযম সম্ভব নয়।’ তাই শরিয়তকে পেরিয়ে তবে মারেফতে পৌঁছতে হয়।

মারেফত মানে প্রকৃত জ্ঞান, যার নির্দেশ জাহেরি কোরানে নেই, আছে অতি গোপনে। সেটা জানতে হয় মুর্শেদের কাছে দীক্ষা নিয়ে। সেই জ্ঞান শাস্ত্রপথে আসেনি, চলে আসছে বহুকাল থেকে সিনায় সিনায়। মারফতি ফকিরদের আলেমরা সহ্য করতে পারেন না, তার কারণ, মারফতিরা শরিয়তকে চরম বা পরম বলে মানেন না— আরও এগোতে চান আত্মদীপনের গহন পথে। সেই দীপন বা দর্শন তো মানুষকে দেখানো যায় না, উপলব্ধি করতে হয়। শরিয়তের মধ্যেই অন্তঃশীল হয়ে আছে মারেফত, যেমন দুধের মধ্যে মাখন। কিন্তু মাখন তুলে নিলে দুধ যেমন মূল্যহীন ঘোলে পরিণত হয় তেমনই মারফতি তত্ত্বে নিষ্ণাত (পারদর্শী) হলে শরিয়ত হয়ে পড়ে নগণ্য।

পীর-সুফীগণ, ভক্তদের আধ্যাত্মিক গুরুঃ

পীর’ ফার্সি শব্দ। প্রবীণ, জ্ঞানী, পরিপক্ক, অভিজ্ঞসম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয় প্রদানে ‘পীর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আর ব্যবহারিক অর্থে ইসলামের নিগূঢ় তত্ত্বে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিই পীর। আরবী ভাষায় ‘পীর’ শব্দের পরিবর্তে ‘সুফী’ ব্যবহৃত হয়। এই পীর-সুফীগণ, ভক্তদের আধ্যাত্মিক গুরু।

কারণ, দেহকে বলিষ্ট রাখার জন্য যেমনি খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি আত্মাকে সজীব রাখার জন্য আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজন হয়। পীর-সুফীগণ সেসব দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সুফীগন নিজের আমিত্বকে বিলীয়ে দিয়ে বিশ্ব পালকের সান্নিধ্য লাভের জন্য কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে স্থায়ীত্ব-অমরত্ব লাভ করেন।

ফকির বংশ: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য

ঐতিহাসিকভাবে, ফকিরগণ ছিলেন ধর্মীয় ব্যক্তিরা যারা জাগতিক সম্পদ ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করতেন। তারা প্রায়শই ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন ও ধ্যানে সময় কাটাতেন। বাংলাদেশে, ফকিররা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ফকির বংশ ছিল বাংলার বিখ্যাত মুসলিম পরিবারগুলির মধ্যে একটি। 

ফকির বংশের কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বঃ

শাহ মখদুম রুপসান: তিনি ছিলেন বাংলার একজন বিখ্যাত ধর্মীয় পণ্ডিত এবং আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি ইসলাম ধর্মের প্রসারে এবং বাংলার মুসলিম সমাজের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

শাহজালাল: তিনি ছিলেন বাংলার একজন বিখ্যাত ধর্মপ্রচারক এবং আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি সিলেট অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ফকির লালন শাহ: তিনি ছিলেন বাংলার একজন বিখ্যাত লোককবি এবং আধ্যাত্মিক সঙ্গিত শিল্পী। তিনি সুফিবাদী গানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

ফকির বংশের অবদানঃ

ধর্ম ও সমাজ: ফকিররা ইসলাম ধর্মের প্রসারে এবং বাংলার মুসলিম সমাজের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ফকিররা ধর্মীয় পণ্ডিত, সমাজ সংস্কারক এবং আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা জনগণের কাছে শ্রদ্ধা পেত এবং তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্য সম্মানিত হত।

শিক্ষা ও সংস্কৃতি: ফকিররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চায় অবদান রেখেছিলেন।

সামাজিক সংস্কার: ফকিরগণ সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং সমাজে ন্যায়বিচার ও সমতার প্রচার করেছিলেন। ফকিরগণ বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের অবদান আজও স্মরণীয়।

পীর (সুফিবাদ) 

পীর বা পির (ফার্সি:پیر, অনুবাদ 'বয়োজ্যেষ্ঠ') সূফি গুরু বা আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের একটি উপাধি। তাদের হজরত (আরবি:  حضرةপ্রতিবর্ণীকৃত: হাদরা থেকে) এবং শাইখ নামেও ডাকা হয়, যা মূলত এর আরবি প্রতিশব্দ। একে প্রায়সময় ইংরেজীতে সেইন্ট বা সাধু এবং খ্রিস্টান পরিভাষা এল্ডার হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।

সুফিবাদে কোন পীরের ভূমিকা হল তার শিষ্যদের সুফি পন্থায় নির্দেশনা দেওয়া। যা অনেকসময় সহবত নামক সাধারণ পাঠদান ও ব্যক্তিগত দিকনির্দেশনার মাধ্যমে করা হয়৷ পীর বলতে অপর যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয় সেগুলো হল মুর্শিদ (আরবি: مرشدঅনুবাদ 'শিক্ষক, নির্দেশক') ও সরকার (ফার্সি: سرکار অনুবাদ 'গুরু, প্রভু')। আলেভি মতবাদে, পীরদেরকে সরাসরি আলীর উত্তরসূরী বলা হয়।

ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, সাত শ’ শতাব্দীর দিকে এই উপমহাদেশে ইসলামের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু ইসলামের মূল প্রসার শুরু হয় ১১ শ’ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। সেই সময়ে একদিকে মোহাম্মদ ঘুরির (মুইজুদ্দীন মোহাম্মদ) যুদ্ধ বিজয়, অন্যদিকে মঈন উদ্দীন চিশতির (রহঃ) খানকার প্রভাব ইসলামী আদর্শের প্রচার ত্বরান্বিত করে। সেই থেকে ১৮শ’ শতাব্দীতে মুঘল সাম্যাজ্যের পতন পর্যন্ত তথা মোজাদ্দেদ ই আলফেসানী (রহঃ) পর্যন্ত এ দেশে সুফি দরবেশরাই ইসলাম প্রচার করেন। এর মাঝে ১২শ’ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ১৪ শ’ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত খান জাহান আলী থেকে শুরু করে শাহ মাখদুম, শাহাজালাল, শাহ পরান (রহঃ) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

বাংলাদেশে পীর, ফকির, দরবেশ, অলি-আউলিয়া ও সুফি-সাধকদের আবির্ভাবকাল সঠিকভাবে বলা কঠিন। ২৬১ হিজরির ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে মহান অলি সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) ইরানের বোস্তান নগরে ইন্তেকাল করেন।

তবে চট্টগ্রামে বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) কখন আগমন করেন তার সঠিক কোনো দিন-তারিখ জানা যায় না। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে তিনি চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কঠোর সাধনা ও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সেখানে তাঁর আস্তানা গড়ে তোলেন এবং পরে ইরানের বোস্তান নগরে আবার ফিরে যান। তাই ধারণা করা যায়, বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) ইন্তেকালের আগে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর মধ্যভাগে এ দেশে আগমন করেন।

এরপর একে একে আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে পীর, ফকির, দরবেশ, অলি-আউলিয়া ও সুফি-সাধকদের এ দেশে আগমন ঘটতে থাকে। তবে ১১ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত এ দেশে ইসলামের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়েছে বলে জানা যায়। 

দরবেশ 

দরবেশ (ফার্সি: درویش)হল এমন একজন ইসলাম ধর্মীয় ব্যক্তি যিনি বস্তুগত দারিদ্র্যকে বেছে নিয়েছেন বা গ্রহণ করেছেন। দরবেশ বা দারভেশ শব্দটি ফার্সি এবং তুর্কি ভাষায় পাওয়া যায়। এটি আরবি শব্দ ফকির -এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অহংকার ও নফসের বিভ্রম পরিত্যাগ করে আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর জন্যে তাদের মূল ফোকাস হয় ভালবাসা এবং সেবার সার্বজনীন মূল্যবোধের উপর।

বেশিরভাগ দরবেশ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্যে বিভিন্ন শারীরিক পরিশ্রম বা ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে যিকির অনুশীলন করার জন্য পরিচিত।তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুশীলন হল সামা, যা ১৩ শতকের বিশিষ্ট দরবেশ রুমির সাথে সম্পর্কিত। লোককাহিনীগুলোতে দরবেশদের প্রায়শই অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতা এবং অলৌকিক ক্ষমতার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ঐতিহাসিকভাবে দরবেশ শব্দটি বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলন বা সামরিক সত্তার উপাধি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।

শাহ 

শাহ (ফার্সী: شاه) ফার্সী শব্দ। প্রাচীন পারসিক ভাষায় শব্দটির রুপ ছিল "রাজা" আর পারসিক ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় এর রুপ ছিল "রাজশক্তি বা সমরশক্তি"। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় kṣatra (ক্ষত্র) মানে ও ছিল সমরশক্তি, ক্ষত্র থেকে ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা) শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। আধুনিক ফার্সী ভাষায় শাহ অর্থ বাদশাহ বা রাজা। ভারতবর্ষের সুলতানী আমলের শাসকেরা এবং মোগল শাসকেরা নিজেদের নামের সাথে শাহ পদবী ব্যবহার করতেন। পীর, দরবেশদের নামের পদবীতেও শাহ এর বহুল ব্যবহার হয়। শাহ বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের পদবি হিসেবে ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

শাহ পদবি যুক্ত বিখ্যাত ব্যক্তিগণঃ
আউলিয়া কেরামগণঃ শাহ জালাল, শাহ পরান, শাহ মখদুম, শাহ আমানত, অলিমান দেওয়ান শাহ্, লালন শাহ, পীরে কামেল কদম আলী শাহ্ উল্লেখযোগ্য।

ফকিরগণের নামের শেষে "শাহ" ব্যবহারঃ

১. সম্মান: "শাহ" শব্দটি ফার্সি শব্দ "শাহ" থেকে এসেছে যার অর্থ "রাজা" বা "নেতা"। ফকিররা ধর্মীয় পণ্ডিত এবং আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে সমাজে সম্মানিত ছিলেন। তাদের নামের শেষে "শাহ" ব্যবহার করা তাদের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করার একটি উপায় ছিল।

২. ধর্মীয় পরিচয়: ইসলামে, "শাহ" শব্দটি প্রায়শই সুফি সাধকদের জন্য ব্যবহৃত হয়। সুফিবাদ ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক ধারা যা ঈশ্বরের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর জোর দেয়। ফকিররা প্রায়শই সুফিবাদের অনুসারী ছিলেন এবং তাদের নামের শেষে "শাহ" ব্যবহার করে তাদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতেন।

৩. বংশগত পরিচয়: কিছু ক্ষেত্রে, "শাহ" শব্দটি একটি নির্দিষ্ট বংশ বা পরিবারের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। এই বংশগুলি প্রায়শই ধর্মীয় পণ্ডিত এবং আধ্যাত্মিক নেতাদের বংশধর ছিল। ফকিররা এই বংশগুলির সদস্য ছিলেন এবং তাদের নামের শেষে "শাহ" ব্যবহার করে তাদের বংশগত পরিচয় প্রকাশ করতেন।

৪. ঐতিহ্য: ফকিররা ঐতিহাসিকভাবে তাদের নামের শেষে "শাহ" ব্যবহার করে আসছেন। এই ঐতিহ্যটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে এসেছে এবং এখনও অনেক ফকির দ্বারা অনুসরণ করা হয়।

ফকির কোন ভাষার শব্দঃ

জেমিনি থেকে পাওয়া

ফকির শব্দটি মূলত আরবি ভাষার শব্দ। শব্দটি আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত। আরবি ভাষায় فقير  শব্দের অর্থ গরিব বা দরিদ্র। এটি পরে ফার্সি ভাষায় গৃহীত হয়েছে (ফার্সি ও অন্যান্য ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে)। এবং তারপর বাংলা ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

ফার্সি ভাষায় ফকির শব্দের অর্থ হল একজন দরবেশ বা সুফি সাধক। যারা সাধারণত দারিদ্র্য এবং পরহেজগারির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন সংস্কৃতিতে একজন দরিদ্র কিন্তু ধার্মিক ব্যক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত সুফি প্রথায় একজন ধার্মিক ও দরিদ্র সাধকের অর্থে ব্যবহৃত হয়, যিনি আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভের জন্য পৃথিবীর ভোগ-বিলাস ত্যাগ করেছেন।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে সুফি সাধকদের জন্য এই শব্দটি ব্যবহৃত হত। যারা পার্থিব সম্পদ ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করতেন। কালক্রমে, ফকির শব্দটির অর্থ প্রসারিত হয়ে এমন যেকোনো ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে যিনি সাধারণ জীবনযাপন করেন এবং আধ্যাত্মিকতার উপর জোর দেন।

আজকের দিনে, ফকির শব্দটি সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে। এটি এমন ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যিনি ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করেন এবং পার্থিব সম্পদের প্রতি আগ্রহী নন।

ফকির শব্দটির সাথে দরবেশ শব্দটিও প্রায়শই ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ একই রকম। ফকির শব্দটির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় অর্থই রয়েছে। ইতিবাচক অর্থে, এটি একজন ধার্মিক, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। নেতিবাচক অর্থে, এটি একজন গরিব, ভিক্ষুক ব্যক্তিকে বোঝাতে পারে।

ফকির এবং ভিক্ষুকের মধ্যে কিছু পার্থক্যঃ

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেঃ (ফকির) ইসলাম ধর্মের সুফি মতবাদের অনুসারীদেরকে ফকির বলা হয়। তারা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য জাগতিক জীবন ত্যাগ করেন। যেমন রুমি ছিলেন একজন বিখ্যাত ফকির। যিনি ইসলাম ধর্মের সুফি মতবাদ অনুসরণ করেছিলেন। তিনি জাগতিক সম্পদ ত্যাগ করে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিতে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। (ভিক্ষুক) যেকোনো ধর্মের অনুসারী হতে পারেন। যারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

জীবনধারাঃ (ফকির) সাধারণত সাদা পোশাক পরিধান করেন, মসজিদে থাকেন এবং ধ্যান ও প্রার্থনায় সময় কাটান। যেমন বায়েজিদ বোস্তানি ছিলেন একজন ফকির। যিনি সাধারণ পোশাক পরিধান করতেন, মসজিদে থাকতেন এবং ধ্যান ও প্রার্থনায় সময় কাটাতেন। আসলে পোশাক একজন ব্যক্তির চরিত্র নির্ধারণ করে না। ফকির দরবেশগণের সাধারণ পোশাক পরিধান করা তাদের ভিক্ষুক করে তোলে না। (ভিক্ষুক) যেকোনো পোশাক পরিধান করতে পারেন এবং যেকোনো স্থানে থাকতে পারেন।

সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেঃ (ফকির) সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। যেমন শাহ জালাল ছিলেন একজন ফকির। যিনি বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাকে সমাজের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হত। (ভিক্ষুক) সমাজে নিম্ন স্তরের ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

মতাদর্শঃ (ফকির) ঈশ্বরের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং জাগতিক আকাঙ্ক্ষা ত্যাগে বিশ্বাস করেন। যেমন হাফিজুল আজিম ছিলেন একজন ফকির। যিনি ঈশ্বরের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং জাগতিক আকাঙ্ক্ষা ত্যাগে বিশ্বাস করতেন। (ভিক্ষুক) জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল হন। জাগতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি আগ্রহী হতে পারেন।

এই পার্থক্যগুলো সর্বজনীন নয়, কেবল ধারণা প্রদানের জন্য। অনেক ফকির এবং ভিক্ষুকের জীবনধারা ও মতাদর্শ এই উদাহরণগুলোর সাথে নাও মিলতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের আধ্যাত্মিকতা ও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি বিষয়।

ফকির এবং ভিক্ষুকের মধ্যে আরও কিছু পার্থক্যঃ

ফকিরঃ (ধর্মীয় সংযোগ) ফকিররা সাধারণত সুফি ধর্মের অনুসারী হন এবং তারা ধর্মীয় অনুশীলন ও জীবনযাপনের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করেন। (সাধনা) ফকিররা আধ্যাত্মিক সাধনা ও ঈশ্বরের সাথে মিলনের উপর জোর দেন। তারা প্রায়শই ধ্যান, প্রার্থনা, এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক অনুশীলনে লিপ্ত থাকেন। (জীবনযাপন) ফকিররা সাধারণত সাধারণ জীবনযাপন করেন এবং বস্তুগত সম্পদের প্রতি তাদের আগ্রহ কম থাকে। তারা প্রায়শই ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বসবাস করেন।

ভিক্ষুকঃ (ধর্মীয় সংযোগ) ভিক্ষুকরা যেকোনো ধর্মের অনুসারী হতে পারেন। (সাধনা) ভিক্ষুকদের আধ্যাত্মিক সাধনার উপর জোর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। (জীবনযাপন) ভিক্ষুকরা বিভিন্ন কারণে ভিক্ষা করতে পারেন, যেমন দারিদ্র্য, অসুস্থতা, বা অক্ষমতা। তারা যেকোনো ধরণের জীবনযাপন করতে পারেন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বসবাস করতে পারেন বা নাও পারেন।

সারসংক্ষেপেঃ ফকিরগণ ধর্মীয়ভাবে অনুপ্রাণিত ব্যক্তি যাঁরা আধ্যাত্মিক সাধনার উপর জোর দেন, যখন ভিক্ষুকরা এমন ব্যক্তি যারা বিভিন্ন কারণে ভিক্ষা করেন। ফকিরগণ সাধারণত সুফি ধর্মের অনুসারী হন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বসবাস করেন, যখন ভিক্ষুকরা যেকোনো ধর্মের অনুসারী হতে পারেন এবং যেকোনো ধরণের জীবনযাপন করতে পারেন।

উদাহরণঃ (ফকির) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস গোরায় লাল মোহন বাবু একজন ফকির চরিত্র, যিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় নিবেদিত। (ভিক্ষুক) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস দেবদাসে চন্দ্রমুখী একজন ভিক্ষুক চরিত্র যিনি দারিদ্র্যের কারণে ভিক্ষা করেন।

ফকিরগণ সাধারণত জাগতিক সম্পদ ত্যাগ করে দারিদ্র্যের জীবনযাপন করেন। দারিদ্র্য ফকিরদের সংজ্ঞায়িত করে না। ফকিরগণের মূল লক্ষ্য হল ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি। সামাজিক অবস্থান ফকিরগণের মূল্য নির্ধারণ করে না। ফকিরগণ তাদের আধ্যাত্মিকতা ও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির জন্য (নিবেদিতপ্রাণতার জন্য) সম্মানিত।

মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, সকল ফকির দরবেশ ভিক্ষা করেন না। অনেক ফকির দরবেশের নিজস্ব জীবিকা থাকে। (যেমন কৃষি, কারুশিল্প বা ব্যবসা)।

ফকির গোষ্ঠীঃ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সমাজে ভূমিকা

ফকির গোষ্ঠী বা ফকির সম্প্রদায় হলো এমন এক গোষ্ঠী যারা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতিকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকভাবে, তারা সুফি মতাদর্শ অনুসরণ করেন এবং দারিদ্র্য, সরলতা এবং আত্মত্যাগের জীবনযাপন করেন।

ফকিরদের বৈশিষ্ট্যঃ (ঈশ্বরের প্রতি অটুট বিশ্বাস) ফকিররা বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরই একমাত্র সত্য এবং তাদের জীবনের সকল দিকে ঈশ্বরের ইচ্ছাই প্রভাব ফেলে। (জাগতিক আকাঙ্ক্ষার ত্যাগ) ফকিররা জাগতিক সম্পদ, খ্যাতি এবং ক্ষমতার প্রতি আগ্রহ ত্যাগ করে। (দারিদ্র্য ও সরল জীবনযাপন) ফকিরগণ সাধারণত সাধারণ পোশাক পরিধান করেন, মসজিদে থাকেন এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চেয়ে বেশি কিছু রাখেন না। (আধ্যাত্মিক অনুশীলন) ফকিররা ধ্যান, প্রার্থনা, মন্ত্রপাঠ এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। (সমাজ সেবা) অনেক ফকির দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করার জন্য কাজ করেন।

ফকিরদের ধরণঃ (মালাঙ্গা) যারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। (কওয়াল) যারা ঈশ্বরের প্রশংসায় গান গায় এবং নাচ করে। (পীর) যারা আধ্যাত্মিক শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন। ফকিরদের ভূমিকাঃ ফকিররা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তারা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার জীবন্ত উদাহরণ স্থাপন করেন। তাঁরা দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করেন এবং সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচার করেন।

ফকিরদের ঐতিহ্যঃ ফকিরদের ঐতিহ্য দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। তারা ইসলামের সুফি মতাদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঐতিহাসিকভাবে, ফকিরগণ ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা বিভিন্ন সুফি তরিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মীয় শিক্ষা ও বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে ফকিরগণ বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও বর্ণের অন্তর্ভুক্ত।

ফকির ও কালান্দরঃ

ফকিরঃ সাধারণত ফকির শব্দটি দিয়ে এমন এক ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যিনি ধর্মীয় কাজে নিজেকে নিবেদিত করেছেন, সাধারণত ইসলামে। তারা সাধারণত দুনিয়ার মায়া-মমতা ত্যাগ করে ধর্মীয় জীবন যাপন করেন। ফকিররা সাধারণত দরিদ্র ও সাধারণ জীবনযাপন করেন এবং তাদের লক্ষ্য হল আধ্যাত্মিক উন্নতি।

কালান্দরঃ কালান্দর শব্দটিও এক ধরনের সাধু বা ফকিরকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। তবে ফকিরের তুলনায় কালান্দররা সাধারণত আরও ভ্রমণশীল এবং স্বতন্ত্র জীবনযাপন করেন। তারা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান এবং ধর্মীয় গান বা কবিতা পাঠ করেন। কালান্দররা সাধারণত সঙ্গীত যন্ত্র বাজাতে পারেন এবং তাদের নিজস্ব এক ধরনের সংস্কৃতি থাকে।

দুয়ের মধ্যে মূল পার্থক্যঃ (জীবনযাপন) ফকিরগণ সাধারণত এক জায়গায় থাকেন এবং ধর্মীয় অনুশীলন করেন। কালান্দররা ভ্রমণশীল এবং বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। (সাংস্কৃতিক পরিচয়) কালান্দরদের নিজস্ব এক ধরনের সংস্কৃতি থাকে, যেমন সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদি। ফকিররা সাধারণত ধর্মীয় অনুশীলনকেই প্রাধান্য দেন।(সামাজিক মর্যাদা) কালান্দররা সাধারণত ফকিরদের তুলনায় সামাজিকভাবে আরও স্বাধীন এবং মুক্ত চেতনার অধিকারী হিসেবে পরিচিত।

ফকির ও কালান্দর দুটি শব্দ যা প্রায়শই একই অর্থে ব্যবহৃত হয়, তবে তাদের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। উভয়ই ধর্মীয় কাজে নিজেকে নিবেদিত করেছেন এবং সাধারণত দুনিয়ার মায়া-মমতা ত্যাগ করেছেন। তবে তাদের জীবনযাপন, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য রয়েছে।

বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ফকিরদের মধ্যে পার্থক্যঃ

ধর্মঃ (বৌদ্ধ ভিক্ষু) বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। (ফকির) ইসলাম ধর্মের সুফি মতাদর্শের অনুসারী। মূল লক্ষ্যঃ (বৌদ্ধ ভিক্ষু) দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ এবং নির্বাণ অর্জন। (ফকির) ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি। জীবনযাপনঃ (বৌদ্ধ ভিক্ষু) বৌদ্ধ মঠে থাকে এবং নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলে। (ফকির) সাধারণত মসজিদে থাকে অথবা ভ্রমণ করে। পোশাকঃ (বৌদ্ধ ভিক্ষু) লাল, কমলা বা বাদামী রঙের পোশাক পরিধান করে। (ফকির) সাধারণত সাদা বা লাল রঙের পোশাক পরিধান করে।

খাদ্যঃ (বৌদ্ধ ভিক্ষু) ভিক্ষা করে খাবার সংগ্রহ করে। (ফকির) ভিক্ষা করে বা অন্য কাজ করে খাবার সংগ্রহ করে।আধ্যাত্মিক অনুশীলনঃ (বৌদ্ধ ভিক্ষু) ধ্যান, প্রার্থনা, অধ্যয়ন এবং অন্যান্য বৌদ্ধ অনুশীলনে অংশগ্রহণ করে। (ফকির) ধ্যান, প্রার্থনা, মন্ত্রপাঠ এবং অন্যান্য সুফি অনুশীলনে অংশগ্রহণ করে। সমাজে ভূমিকাঃ (বৌদ্ধ ভিক্ষু) ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করে এবং মানুষকে আধ্যাত্মিক পথে নির্দেশনা দেয়। (ফকির) দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করে এবং সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচার করে।

হিন্দু সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের মধ্যে পার্থক্যঃ

ধর্মঃ (হিন্দু সন্ন্যাসী) হিন্দু ধর্মের অনুসারী। (ফকির) ইসলাম ধর্মের সুফি মতাদর্শের অনুসারী। মূল লক্ষ্যঃ (হিন্দু সন্ন্যাসী) মোক্ষ অর্জন (ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়া)। (ফকির) ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি। জীবনযাপনঃ (হিন্দু সন্ন্যাসী) আশ্রমে থাকে এবং নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলে। (ফকির) সাধারণত মসজিদে থাকে অথবা ভ্রমণ করে। পোশাকঃ (হিন্দু সন্ন্যাসী) সাধারণত কমলা বা গেরুয়া রঙের পোশাক পরিধান করে। (ফকির) সাধারণত সাদা বা লাল রঙের পোশাক পরিধান করে।

খাদ্যঃ (হিন্দু সন্ন্যাসী) নিরামিষ খাবার খায়। ফকির: যেকোনো ধরণের খাবার খেতে পারে। আধ্যাত্মিক অনুশীলনঃ (হিন্দু সন্ন্যাসী) ধ্যান, প্রার্থনা, যজ্ঞ এবং অন্যান্য হিন্দু অনুশীলনে অংশগ্রহণ করে। (ফকির) ধ্যান, প্রার্থনা, মন্ত্রপাঠ এবং অন্যান্য সুফি অনুশীলনে অংশগ্রহণ করে। সমাজে ভূমিকাঃ (হিন্দু সন্ন্যাসী) ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করে এবং মানুষকে আধ্যাত্মিক পথে নির্দেশনা দেয়। (ফকির) দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করে এবং সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচার করে।

এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয় এবং কিছু ব্যতিক্রমও থাকতে পারে। তবে হিন্দু সন্ন্যাসী, বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ফকিরগণের মধ্যে অনেক মিলও রয়েছে, যেমন তাদের ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি, আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতি আকাঙ্ক্ষা এবং সরল জীবনযাপন প্রবণতা।

সন্ন্যাসবৃত্তি শব্দটির ধর্মীয় অর্থঃ

হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মে, সন্ন্যাসবৃত্তি শব্দটি পার্থিব জীবন ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করার প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি সাংসারিক জীবনের সকল সুখ, সম্পদ এবং আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে একটি নতুন জীবনধারা গ্রহণ করে। এই নতুন জীবনধারা আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং মোক্ষ অর্জনের উপর কেন্দ্রিত হয়।

সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য একজন ব্যক্তি কিছু নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করেঃ প্রথম ধাপ হলো গুরু বা সাধু খুঁজে পাওয়া যিনি তাকে পথ দর্শন করবেন, দ্বিতীয় ধাপ হলো গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করা, তৃতীয় ধাপ হলো সন্ন্যাস ব্রত পালন করা।

সন্ন্যাস ব্রত গুলো হলোঃ (অহিংসা) অন্য কোন জীবের ক্ষতি না করা। (সত্যবাদ) সত্যবাদী হওয়া এবং মিথ্যা না বলা। (অস্তেয়) অন্যের জিনিস চুরি না করা। (ব্রহ্মচর্য) যৌন বিষয় থেকে বিরত থাকা। (অপরিগ্রহ) অতিরিক্ত জিনিসপত্র না চাওয়া।

সন্ন্যাসী রা সাধারণত আশ্রমে বাস করে এবং ধ্যান করা, যোগাভ্যাস করা এবং ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে তাদের সময় কাটায়। তারা সাধারণত সরল জীবনযাপন করে এবং মাংস খাওয়া, মদ্যপান এবং অন্যান্য অসৎ কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে।

অ্যাসেটিসিজম বা বাংলায় সন্ন্যাসব্রত (মূল গ্রীকঃ অ্যাস্কেসিস; অর্থঃ অনুশীলন, প্রশিক্ষণ) হচ্ছে ঐন্দ্রিক ভোগবিলাস থেকে বিরত থেকে আধ্যাত্মিকতা অর্জনের লক্ষ্যে জীবনধারণ করা। সন্ন্যাসীরা জাগতিক জীবনাচার পরিত্যাগ করতে পারে বা সমাজের সাথে যুক্তও থাকতে পারে। কিন্তু মূলত তারা স্থাবর সম্পত্তি ও দৈহিক বাসনা ত্যাগ করে মিতব্যয়ী জীবন ধারণ করে। এবং তারই সাথে উপবাস করার মাধ্যমে ধর্ম বা আধ্যাত্মিক সাধনাতে মগ্ন থেকে জীবনাতিপাত করে থাকে।

ঐতিহাসিকভাবে নানা ধর্মে - যেমন বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু, খ্রিস্টান ও ইহুদিতে সন্ন্যাসব্রতের নিদর্শন পাওয়া যায়। সম্প্রতি মূলধারার ইসলাম ধর্মে আরবি রমযান মাসে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা রাখার মাধ্যমে মুসলিমরাও সন্ন্যাসব্রত পালন করে থাকে।

সুফি ঐতিহ্য বছরের পর বছর ধরে তীব্রভাবে সন্ন্যাসব্রত অনুসরণ করে আসছে। এই মতাবলম্বীরা মোক্ষ, পরিত্রাণ ও আধ্যাত্মিকতা লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় ইহজাগতিক বাসনা থেকে বিরত থাকে। প্রাচীন ধর্মতত্ত্বে সন্ন্যাসব্রতকে এক ধরনের আত্মিক রূপান্তরের মাধ্যম বা যাত্রা হিসেবে দেখা হয় যেখানে সাধারণই যথেষ্ট, শান্তি পুরোপুরি আভ্যন্তরীণ এবং মিতাচারই প্রয়োজনের অধিক।

অপরদিকে, জরাথ্রুস্টবাদ, প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম, ডায়োনিসিয়ান ধর্মমতের মত বেশ কিছু প্রাচীন ধর্মমতে, এমনকি বামহস্তরীতির মত কিছু আধুনিক ধর্মমতে সন্ন্যাসব্রতকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের ভোগ-সুখবাদে জোর দেয়া হয়েছে।

তান্ত্রিক ও ফকিরের মধ্যে পার্থক্যঃ

তান্ত্রিকদের আধ্যাত্মিকতা নিয়ে বিতর্ক অনেকদিন ধরে চলে আসছে। তান্ত্রিকরা বিভিন্ন আধ্যাত্মিক অনুশীলন অনুসরণ করে, যার মধ্যে রয়েছে যজ্ঞ, মন্ত্রোচ্চারণ, ধ্যান এবং যৌনতার সাথে যুক্ত আধ্যাত্মিক অনুশীলন। এই অনুশীলনগুলির কিছুকে নেতিবাচক ও বিপথগামী বলে মনে করা হয়, অন্যদিকে অনেকে মনে করেন এগুলো আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ।

ধর্মীয় বিশ্বাস: (তান্ত্রিক) তান্ত্রিকরা সাধারণত হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হয়। তারা তন্ত্র নামক একটি ধর্মীয় গ্রন্থের অনুসারী, যা আধ্যাত্মিকতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন রীতিনীতি ও অনুশীলন নির্দেশ করে।(ফকির) ফকিররা সাধারণত মুসলিম হয়। তারা ইসলাম ধর্মের নীতি ও শিক্ষার অনুসারী।

আধ্যাত্মিক অনুশীলন: (তান্ত্রিক) তান্ত্রিকরা বিভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিক অনুশীলন করে, যার মধ্যে রয়েছে যজ্ঞ, মন্ত্রোচ্চারণ, ধ্যান এবং যৌনতার সাথে যুক্ত আধ্যাত্মিক অনুশীলন। (ফকির) ফকিররা সাধারণত ধ্যান, প্রার্থনা, সূফিবাদী গান গাওয়া এবং ইসলামী শিক্ষা অধ্যয়ন করার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা অর্জন করে।

জীবনধারা: (তান্ত্রিক) তান্ত্রিকরা বিভিন্ন ধরনের জীবনধারা অনুসরণ করতে পারে। কিছু তান্ত্রিক গৃহস্থ হয়, অন্যরা সন্ন্যাসী হয়। (ফকির) ফকিররা সাধারণত সরল জীবনযাপন করে। তারা প্রায়শই ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং ধর্মীয় বিষয়ে অন্যদের শিক্ষা দেয়।

সমাজে ভূমিকা: (তান্ত্রিক) তান্ত্রিকরা সমাজে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে পারে। কিছু তান্ত্রিক পুরোহিত বা গুরু হয়, অন্যরা ঔষধিবিদ বা জ্যোতিষী হয়। (ফকির) ফকিররা সমাজে ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা প্রায়শই জনগণের কাছে শ্রদ্ধা পেত এবং তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্য সম্মানিত হত।

ফকিরি ধারণাটি ব্যাপক এবং এর একক সংজ্ঞা নেই। ঐতিহাসিকভাবে, ফকিরদের সাধারণত ধর্মীয় পথিক, ভিক্ষুক বা সাধু হিসেবে বিবেচনা করা হত, যারা ঐশ্বরিক জ্ঞান ও আলোক লাভের জন্য দুনিয়ালি সম্পদ ত্যাগ করেছেন। আধুনিক সময়, ফকিরি ধারণাটি আরও ব্যাপক হয়ে উঠেছে। যারা বিভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিক অনুশীলন ও জীবনযাত্রার সাথে যুক্ত হন।

ফকিরি ধারণাটি জটিল এবং ব্যাপকঃ

কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা ফকিরদের সাথে যুক্তঃ

(সাধুজীবন) ফকিরগণ সাধারণত সরল জীবনযাপন করে, অল্প ইচ্ছা ও চাহিদা নিয়ে। (আধ্যাত্মিক অনুশীলন) ফকিররা নিয়মিত ধ্যান, প্রার্থনা, যোগব্যায়াম বা অন্যান্য আধ্যাত্মিক অনুশীলনে লিপ্ত থাকেন।(ভ্রমণ) কিছু ফকির তীর্থস্থানে ভ্রমণ করে বা জ্ঞান ও আলোকের সন্ধানে ভ্রমণ করেন। (সামাজিক সেবা) কিছু ফকির দরিদ্র ও অভাবীদের সাহায্য করে বা সমাজের সেবা করেন।

ফকিরি গ্রহণ করার কারণগুলি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু লোক ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে ফকিরি গ্রহণ করেন, অন্যরা আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও আলোক লাভের আকাঙ্ক্ষায় ফকির হন। আবার অন্যরা হয়তো দুনিয়ালি জীবনের সাথে হতাশ হয়ে ফকিরি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে ফকিরগণের বিভিন্ন ধরণের সম্প্রদায় রয়েছে। কিছু সম্প্রদায় সুফিবাদের অনুসারী, অন্যরা হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের সাথে যুক্ত।

ফকিররা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদেরকে প্রায়শই জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মনে রাখবেন, ফকিরি ধারণাটি জটিল এবং ব্যাপক।

ভিক্ষুক ও ভিখারী শব্দটি মূলত সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। বাংলা ভাষায়, ভিক্ষুক শব্দটি সংস্কৃত এবং পালি ভাষা থেকে ঋণ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃত ভাষায়, ভিক্ষা শব্দটির অর্থ অনুগ্রহ করে দেওয়া। ভিক্ষুক শব্দটি কেবল দরিদ্র ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় না, বরং ধর্মীয় ভিক্ষুদেরও বোঝাতে পারে যারা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষা করেন।

ভিক্ষুক এবং ভিখারী শব্দদুটির মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। ভিক্ষুক শব্দটি সাধারণত একজন ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি ধর্মীয় কারণে ভিক্ষা করেন। ভিখারী শব্দটি সাধারণত একজন ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি দারিদ্র্যের কারণে ভিক্ষা করেন। ভিক্ষাবৃত্তি ঐতিহাসিকভাবে অনেক সমাজেই একটি সাধারণ অনুশীলন ছিল।

ঐতিহাসিকভাবে, ভিক্ষা শব্দটি শুধু ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হত, যেখানে সাধু বা সন্ন্যাসীরা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যদের কাছে ভিক্ষা করতেন। কালক্রমে, ভিক্ষা শব্দটির অর্থ প্রসারিত হয়ে এমন যেকোনো ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে যে অন্যদের কাছে টাকা, খাবার বা অন্যান্য জিনিসপত্র ভিক্ষা করেন। আজকের দিনে, ভিক্ষারী শব্দটি সাধারণত এমন ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যে দারিদ্র্যের কারণে অন্যদের উপর নির্ভরশীল।

ফকির এবং ভিক্ষুক শব্দ দুটির মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। বাংলা ভাষায়, ভিক্ষুক শব্দটি সাধারণত এমন ব্যক্তিদের সাথে যুক্ত যারা অভাবী এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যদের উপর নির্ভর করে।অর্থাৎ, ফকির শব্দটি ভিক্ষুক শব্দটির চেয়ে ব্যাপক। সকল ভিক্ষুক ফকির হতে পারে, তবে সকল ফকির ভিক্ষুক হয় না। কারণ, কিছু ফকির তীর্থস্থানে ভ্রমণ করে বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান অনুসন্ধান করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা ভিক্ষা করার উপর নির্ভরশীল নন। এই পার্থক্যগুলি সবসময় স্পষ্টভাবে মেনে চলা হয় না ।

ফকির ও ভিক্ষুক দুটি শব্দই বাংলা ভাষার শব্দ, তবে তাদের উৎস ভিন্ন। ফকির শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ দরিদ্র। এটি ১৩ শতকের দিকে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে। ভিক্ষুক শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ যিনি ভিক্ষা করেন। এটি প্রাচীন কালে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছিল। উভয় শব্দই বাংলা ভাষায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এদের অর্থ ও ব্যবহারে কিছু পরিবর্তনও এসেছে।

ঐতিহাসিকভাবে, ফকির শব্দটি সাধারণত ধর্মীয় পথিক, ভিক্ষুক বা সাধুদের সাথে যুক্ত ছিল। যারা ঐশ্বরিক জ্ঞান ও আলোক লাভের জন্য দুনিয়ালি সম্পদ ত্যাগ করেছিল। ভিক্ষুক শব্দটি সাধারণত এমন ব্যক্তিদের সাথে যুক্ত ছিল যারা অভাবী এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যদের উপর নির্ভর করে।

আধুনিক সময়ে, এই পার্থক্যগুলি কিছুটা ঝাপসা হয়ে গেছে। ফকির শব্দটি এখনও ধর্মীয় সাধুদের সাথে যুক্ত হতে পারে, তবে এটি এমন ব্যক্তিদের সাথেও ব্যবহৃত হতে পারে যারা দরিদ্র বা অভাবী। ভিক্ষুক শব্দটি এখনও এমন ব্যক্তিদের সাথে যুক্ত, যারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মনে রাখবেন, এই শব্দগুলির ব্যবহার ব্যক্তি ও প্রসঙ্গের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।

ফকির হলেন একজন ব্যক্তি যিনি ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য জাগতিক জীবন ত্যাগ করেছেন। তারা সাধারণত সুফি মতাদর্শ অনুসরণ করেন এবং দারিদ্র্য, সরলতা এবং আত্মত্যাগের জীবনযাপন করেন। ফকিরদের সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকে ভাবেন যে তারা ভিক্ষুক। কিন্তু বাস্তবতা হল যে ফকিররা ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি, যারা জাগতিক আকাঙ্ক্ষার চেয়ে আধ্যাত্মিক উন্নতিকে বেশি গুরুত্ব দেন।

ফকির এবং ভিক্ষুক একই শ্রেণীর নয়ঃ

পার্থক্যঃ (উদ্দেশ্য) ফকিররা সাধারণত ধর্মীয় কারণে ভিক্ষা করে, আধ্যাত্মিক উন্নতির লক্ষ্যে। অন্যদিকে, ভিক্ষুকরা জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষা করে। (জীবনধারা) ফকিররা প্রায়শই সরল জীবনযাপন করে, অল্প সম্পদ নিয়ে থাকে। অন্যদিকে, ভিক্ষুকদের জীবনধারা পরিবর্তিত হতে পারে। (সামাজিক অবস্থান) ঐতিহাসিকভাবে, ফকিরদের সমাজে সম্মানিত করা হত, তাদের ধর্মীয় জ্ঞানের জন্য শ্রদ্ধা করা হত। অন্যদিকে, ভিক্ষুকদের প্রায়শই সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষ হিসেবে দেখা হত।

মিলঃ (দারিদ্র্য) উভয় গোষ্ঠীর মানুষই প্রায়শই দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। (সামাজিক বৈষম্য) উভয় গোষ্ঠীর মানুষই সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতে পারে। (কলঙ্ক) উভয় গোষ্ঠীর মানুষই কলঙ্কের সম্মুখীন হতে পারে।

এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিটি ব্যক্তি আলাদা এবং তাদের সাথে সম্মানের সাথে আচরণ করা উচিত। আমাদের উচিত নয় যে কেউ ফকির বা ভিক্ষুক সেই ভিত্তিতে তাদের সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা। বরং, আমাদের তাদের ব্যক্তিগত পরিস্থিতি এবং চ্যালেঞ্জগুলি বুঝতে চেষ্টা করা উচিত এবং তাদের প্রয়োজনে সহায়তা প্রদান করা উচিত।

লালন শাহ একজন ফকির ছিলেনঃ 

তিনি ঐশ্বরিক জ্ঞান ও আলোক লাভের জন্য দুনিয়ালি সম্পদ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি সরল জীবনযাপন করতেন এবং ধ্যান-ধ্যানা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনে লিপ্ত থাকতেন। তিনি অন্যদের আধ্যাত্মিক পথে মার্গদর্শন করতেন এবং তাদের শিক্ষা দিতেন। লালন শাহ ছিলেন একজন সত্যিকারের ফকির, যিনি তার জীবন ঈশ্বরের অনুসন্ধানে ও অন্যদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নে উৎসর্গ করেছিলেন।

লালন শাহের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিছু গবেষক মনে করেন তিনি হিন্দু ছিলেন, অন্যরা মনে করেন তিনি মুসলমান ছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন তিনি ছিলেন সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী যিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মেরই নীতি ও বিশ্বাস গ্রহণ করেছিলেন।

লালন শাহের সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী হওয়ার পক্ষে কিছু যুক্তিঃ

তার রচনাগুলিতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মেরই নীতি ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা প্রচার করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সকল ধর্মের মূলে একই সত্য রয়েছে। তার কিছু অনুসারী তাকে একজন ‘সর্বধর্ম গুরু হিসেবে বিশ্বাস করেন।

সত্যি বলতে গেলে, লালন শাহের ধর্মীয় পরিচয় কী ছিল তা স্পষ্টভাবে বলা অসম্ভব। তিনি সম্ভবত একজন জটিল ব্যক্তি ছিলেন যিনি বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার ধর্মীয় বিশ্বাস তার নিজস্ব অনন্য আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দ্বারা গঠিত হয়েছিল।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো লালন শাহ ছিলেন একজন মহান কবি, সঙ্গীতজ্ঞ এবং ধর্মীয় পথিক, যিনি বাংলা সংস্কৃতিতে অমূল্য অবদান রেখেছেন। তার রচনাগুলি আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এবং তাকে বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

লালন শাহের ধর্মীয় পরিচয় জটিল এবং বিতর্কিত। যদিও তিনি একজন হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার রচনা ও জীবনধারায় হিন্দু, মুসলিম এবং সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী ধারণার মিশ্রণ দেখা যায়।

শাহঃ একটি সম্মানসূচক উপাধি যা সাধারণত মুসলিম ধর্মগুরুদের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিছু লোক বিশ্বাস করেন লালন শাহের পীর ছিলেন একজন মুসলিম সুফি সাধু, তাই তিনি "শাহ" উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। অন্যরা মনে করেন লালন শাহ নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক বা "পীর" হিসেবে দেখেছিলেন, তাই তিনি "শাহ" উপাধি ব্যবহার করেছিলেন।

ফকিরঃ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ দরিদ্র। এটি সাধারণত সুফি সাধুদের জন্য ব্যবহৃত হয়, যারা ঐশ্বরিক জ্ঞান লাভের জন্য দুনিয়ালি সম্পদ ত্যাগ করেছেন। লালন শাহ সরল জীবনযাপন করতেন এবং ঐশ্বরিক জ্ঞানের অনুসন্ধানে ভ্রমণ করতেন, তাই তিনি ফকির উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।

লালন শাহ নিজেকে কখনো হিন্দু, মুসলিম বা সুফি হিসেবে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেননি। তিনি ছিলেন একজন সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী, যিনি বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে জ্ঞান ও অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছিলেন। তার রচনাগুলি ঈশ্বরের প্রেম, মানবজীবনের বিভিন্ন দিক এবং সমাজের সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করে।

শাহ ও ফকির উপাধি ব্যবহারে ভিন্ন ব্যাখ্যাঃ

শাহ্ ও ফকির-এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে, যদিও উভয়ই সুফিবাদের সাথে সম্পর্কিত।আধ্যাত্মিক অবস্থাঃ (শাহ্) শাহ্ হলেন সুফিবাদের উন্নত আধ্যাত্মিক অবস্থায় থাকা ব্যক্তি। তারা ঈশ্বরের সাথে গভীর সম্পর্ক অনুভব করেন এবং তাদের জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে অন্যদের "মার্গদর্শন" করেন।

(ফকির) ফকির হলেন এমন ব্যক্তি যিনি ঐশ্বরিক জ্ঞান ও আলোক লাভের জন্য দুনিয়ালি সম্পদ ত্যাগ করেছেন। তারা সাধারণত সরল জীবনযাপন করেন, ধ্যান-ধ্যানা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনে লিপ্ত থাকেন এবং প্রায়শই ভ্রমণ করে জ্ঞান ও আলোকের সন্ধান করেন।

ভূমিকাঃ (শাহ্) শাহ্-দের প্রাথমিক ভূমিকা হলো অন্যদের আধ্যাত্মিক পথে মার্গদর্শন (পথ দেখানো বা দিক নির্দেশনা দেওয়া)  করা। তারা শিষ্যদের গ্রহণ করেন, তাদের শিক্ষা দেন এবং তাদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নে সহায়তা করেন। (ফকির) ফকিররা সাধারণত নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন। তারা অন্যদের শিক্ষাদান বা "মার্গদর্শন"  করতে পারেন, তবে এটি তাদের প্রাথমিক ভূমিকা নয়।

জ্ঞানঃ (শাহ্) শাহ্-দের উন্নত আধ্যাত্মিক জ্ঞান থাকে। তারা দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার মাধ্যমে এটি অর্জন করে। (ফকির) ফকিররা ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করে। জীবনযাপনঃ (শাহ্) শাহ্-দের জীবনযাপন বিভিন্ন রকম হতে পারে। কিছু শাহ্ সাধারণ জীবনযাপন করেন, আবার অন্যরা সম্পদশালী হতে পারেন। (ফকির) ফকিরগণ সাধারণত সরল জীবনযাপন করেন। তাদের খুব কম সম্পদ থাকে এবং তারা প্রায়শই ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে।

মনে রাখবেন যে, এই পার্থক্যগুলি সবসময় স্পষ্টভাবে মেনে চলা হয় না এবং শাহ্ ও ফকির শব্দগুলি কখনও কখনও একে অপরের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও, সুফিবাদের বিভিন্ন ধারা ও সম্প্রদায় রয়েছে এবং তাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও অনুশীলন থাকতে পারে।

ফকিরগণকে ভিক্ষুক ভাবার পরিবর্তে, ফকির দরবেশগণের সম্পর্কে আরও জানা, তাদের আধ্যাত্মিক জীবনধারা ও ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিতপ্রাণতার জন্য সম্মান করা উচিত। অনেক মানুষ ফকির দরবেশদের ধর্মীয় অনুশীলন সম্পর্কে অজ্ঞ এবং তাদের ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন।

ফকির হওয়ার পথঃ ঐতিহ্য ও আধুনিক প্রেক্ষাপট

ঐতিহ্যবাহী ধারণাঃ

ঐতিহ্যগতভাবে, ফকির ছিলেন এমন ব্যক্তিরা যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞান, সঙ্গীত এবং কবিতা অনুশীলন করতেন। তারা সমাজের ত্যাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যারা ভৌতিক জগতের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক উন্নয়নের পথে নিবেদিত ছিলেন।

ফকির হওয়ার জন্য, অনেকেই গুরু বা পীরের শরণাপন্ন হতেন, যারা তাদেরকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন। সঙ্গীত ও কবিতা অনুশীলনের মাধ্যমে তারা আত্ম-প্রকাশ করতেন এবং সমাজের সাথে সংযোগ স্থাপন করতেন।

আধুনিক প্রেক্ষাপটঃ

আধুনিক সময়ে, ফকির ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। আধ্যাত্মিকতা, সঙ্গীত এবং কবিতা অনুশীলনের পাশাপাশি, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং পরিবেশ রক্ষার মতো আধুনিক বিষয় নিয়েও অনেক ফকির কাজ করছেন। ফকির হওয়ার কোন নির্দিষ্ট পন্থা নেই। আগ্রহ, প্রতিশ্রুতি এবং নিজের সাথে সততা থাকলেই যে কেউ এই পথে এগিয়ে যেতে পারেন।

ফকিরী পদক্ষেপঃ (আধ্যাত্মিক শিক্ষা) গুরু, পীর, ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন, ধ্যান ইত্যাদির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন। (সঙ্গীত ও কবিতা) গান, বাদ্যযন্ত্র, কবিতা রচনা ও আবৃত্তির মাধ্যমে আত্ম-প্রকাশ ও সৃজনশীলতা বিকাশ। (সামাজিক সেবা) দরিদ্র, অসহায়, বঞ্চিত মানুষের সেবা ও সহায়তা। (মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার) মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শব্দ উত্থাপন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ।(পরিবেশ রক্ষা) পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন।

মনে রাখবেন, ফকির হওয়া একটি জীবনধারা, পেশা নয়। এটি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি ও কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নিজের আন্তরিকতা ও বিশ্বাস।

ফকিরীঃ বংশ পরম্পরা নাকি অর্জন?

ফকিরী একটি ধর্মীয় ধারণা যা সাধারণত ধর্মীয় নিষ্ঠা, সরল জীবনযাপন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের সাথে যুক্ত। ফকিরী বংশ পরম্পরায় আসে কি না, এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। কিছু ক্ষেত্রে, ফকিরী বংশ পরম্পরায় চলে আসতে পারে। যারা ফকির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন সম্পর্কে জানতে পারেন।

ফকিরী বংশ পরম্পরায় আসতে পারে, তবে, ফকিরী অর্জিতও হতে পারে। যেকোনো ধর্মের মানুষ ধর্মীয় নিষ্ঠা, সরল জীবনযাপন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ফকির হতে পারেন। ফকির হওয়ার জন্য কোন নির্দিষ্ট নিয়ম বা পদ্ধতি নেই। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক যা একজন ব্যক্তিকে ফকির হিসেবে চিহ্নিত করে।

ধর্মীয় নিষ্ঠা: ফকিররা তাদের নিজ নিজ ধর্মের প্রতি গভীরভাবে নিবেদিত। তারা নিয়মিত প্রার্থনা করে, ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন করে এবং ধর্মীয় নীতি মেনে চলে। সরল জীবনযাপন: ফকিররা সাধারণত সরল জীবনযাপন করে। তারা বস্তুগত সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয় না এবং দান-ধ্যানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। আধ্যাত্মিক জ্ঞান: ফকিররা আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে। তারা ধ্যান, যোগব্যায়াম এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক অনুশীলন করে।

ফকির হওয়াঃ বংশ নির্ভর নাকি অন্য কিছু?

ফকির বংশের সদস্যরা ঐতিহাসিকভাবে ফকির হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন সম্পর্কে জানার সুযোগ তাদের ছিল।ফকির হওয়া ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছা, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান এবং কঠোর পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে। তবে, ফকির হওয়া কেবল বংশের উপর নির্ভর করে না। ধর্মীয় নিষ্ঠা, সরল জীবনযাপন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে যেকোনো ধর্মের মানুষ ফকির হতে পারেন।

এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটি ব্যক্তি আলাদা এবং তাদের সাথে সম্মানের সাথে আচরণ করা উচিত। আমাদের উচিত নয় যে কেউ ফকির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে সেই ভিত্তিতে তাদের সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা। বরং, আমাদের তাদের ব্যক্তিগত পরিস্থিতি এবং চ্যালেঞ্জগুলি বুঝতে চেষ্টা করা উচিত।

‘বংশ গৌরব’ বর্ণবাদী গোঁড়ামিঃ

আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে (গোত্রে) বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা একে অপরকে (পরস্পরকে) চিনতে পারো। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার (তাকওয়া অবলম্বনকারী) সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত। (হুজুরাত ৪৯ : ১৩) ইসলাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার ভিত্তি হল তাকওয়া বা খোদাভীতি। 

কারো বংশ তুলে গালি দেওয়া কুফরিতুল্যঃ

হাদিসে এসেছে, কারো বংশ তুলে গালি দেওয়া কুফরিতুল্য। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুটো স্বভাব মানুষের মধ্যে আছে, যা কুফর বলে গণ্য বংশের প্রতি কটাক্ষ করা এবং মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করা।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৩০)

বংশের প্রতি কটাক্ষ করা, যেমন—কাউকে বলা যে তুমি নিচু বংশের, অভদ্র কিংবা তোমার বংশ খারাপ ইত্যাদি বলা গুনাহের কাজ। এগুলো বলা কাফিরদের অনুকরণতুল্য। কারণ জাহেলি সমাজে বংশ-গৌরব খুব প্রচলিত ছিল। ইসলাম এ ধরনের প্রথা বিলুপ্ত করেছেন।

বংশ নিয়ে অন্যের সাথে গর্ব করাঃ

বংশ নিয়ে অন্যের সাথে গর্ব করা হারাম ও কবীরা গুনাহ্। আবূ মালিক আশ্‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমার উন্মাতের মধ্যে জাহিলী যুগের চারটি কু-প্রথা রয়ে গেছে, যা লোকেরা পরিত্যাগ করতে চাইবে না। (১) বংশ নিয়ে গৌরব করা (২) অন্যের বংশে আঘাত, খোটা দেয়া (৩) নক্ষত্রের উদয়াস্তের কারণে বৃষ্টি হয় বলে বিশ্বাস, নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা (৪) মৃতের জন্য বিলাপ করে কান্নাকাটি করা। 

আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) বলেন, নবী (সা.)ইরশাদ করেছেন: নিজেদের মৃত বাপ-দাদাদেরকে নিয়ে গর্বকারীদের সতর্ক হওয়া উচিত তারা যেন তা দ্বিতীয়বার না করে। কারণ, তারা তো মূলতঃ জাহান্নামের কয়লা। অন্যথায় তারা আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মলকীটের চাইতেও অধিক মূল্যহীন বলে বিবেচিত হবে।

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদেরকে জাহিলী যুগের হঠকারিতা তথা নিজেদের বাপ-দাদাদেরকে নিয়ে গর্ব করা থেকে পবিত্র করেছেন। মূলতঃ মানুষ তো শুধুমাত্র দু’ প্রকার: মুত্তাকী ঈমানদার অথবা দুর্ভাগা ফাসিক। সকল মানুষই তো আদম সন্তান। আর আদম (আঃ) কে তো মাটি থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং এতে একের উপর অন্যের গর্বের কীই বা রয়েছে ?! (তিরমিযী ৩৯৫৫)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অনারবিদের ওপর আরব দেশের লোকের, আরব দেশের লোকের ওপর অনারবিদের কোনো মর্যাদা নেই। কৃষ্ণাঙ্গের ওপর লাল বর্ণের লোকের, লাল বর্ণের লোকের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সম্মান মর্যাদা কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। (মুসনাদে আহমদ ২৩৪৮৯) রাসুল (সা.) বলেছেন, মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা কোন ব্যক্তির নিকৃষ্ট হওয়ার জন্যে যথেষ্ট।  (সহিহ মুসলিম ২৫৬৪) 

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের থেকে জাহেলি যুগের অহংকার, বাপদাদাদের নিয়ে অহমিকা দূর করে দিয়েছেন। হয়তো মুমিন মুত্তাকি, নয়তো দুর্ভাগা পাপী। তোমরা সবাই আদম সন্তান। তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। লোকেরা যেন তাদের সম্প্রদায়কে নিয়ে অহমিকা ত্যাগ করে! (সুনানে আবু দাউদ ৫১১৬)

রাসূল (সা.) বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের দেহ ও আকার-আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন। (বুখারী ও মুসলিম)। রাসূল (সা.) তার চাচা আব্বাস, তার মেয়ে ফাতিমা, তার বংশ বনু হাশিম এর লোকদেরকে ডেকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আখিরাতে বংশীয় মর্যাদা কোন কাজে লাগবে না বরং প্রত্যেককে তার আমল অনুযায়ী বিচার করা হবে।

বংশের গর্বঃ নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ জাহিলী যুগের গর্ব ও অহংকারকে তোমাদের থেকে দূর করেছেন। একজন মু'মিন হলেন আল্লাহভীরু ও তাকওয়া সম্পন্ন, আর একজন ফাসিক হলেন দুষ্ট ও অধার্মিক। সকল মানুষ আদমের সন্তান, আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছেন। (তিরমিযি ৩৯৫৫)। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জাহিলী যুগের গর্বের উপর ভিত্তি করে মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে, সে আল্লাহর অভিশাপে পতিত হবে। (আবু দাউদ ৫১১৭)।

বংশের ভিত্তিতে বিবাহঃ নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, নারীদেরকে তাদের ধর্ম, চরিত্র ও সম্পদের ভিত্তিতে বিয়ে করো। যদি তুমি তাদের সৌন্দর্যের ভিত্তিতে বিয়ে করো, তাহলে তুমি পস্তাবাসী হবে এবং বিপদে পড়বে। (তিরমিযি ১০৮৬)। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কেবল বংশের ভিত্তিতে একজন নারীকে বিয়ে করে, সে আল্লাহর অভিশাপে পতিত হবে। (আবু দাউদ ৫১১৮)।

বংশের ভিত্তিতে বৈষম্যঃ নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু। (সূরা আল-হুজরাত, ১৩:১)। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আরব ও অ-আরবের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, কেবলমাত্র আল্লাহভীরুতা ও তাকওয়ার ভিত্তিতেই পার্থক্য করা হবে। (মুসলিম ২৩৭৮)।

হাদীসে বংশের গর্ব, বংশের ভিত্তিতে বিবাহ এবং বংশের ভিত্তিতে বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একজন ব্যক্তির মর্যাদা তার বংশের উপর নির্ভর করে না, বরং তার কাজ, ঈমান এবং নীতিবোধের উপর নির্ভর করে।

 

 

 

আমি কোনও ধর্মবিশেষজ্ঞ, ধর্মগুরু কিংবা সূফীসম্রাট নই। একজন অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক কেবল। ইন্টারনেট অবলম্বনে, ধর্মবিষয়ক পত্রিকা, ব্লগ ও উইকিপিডিয়া, জেমিনি থেকে তথ্য (কুড়ানো মানিক) নিয়ে শব্দের বুননে (একত্রীকরণ) লেখাটি সম্পাদনা করে পরিবেশন করেছি মাত্র।

 

 

 

 

 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top