বৃহঃস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১

বিপিএলে ফিক্সিং গুঞ্জন, যে কারণে বাড়ছে সন্দেহ

রাহুল রাজ | প্রকাশিত: ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১৭:০৯

ফাইল ফটো

একের পর এক সন্দেহজনক ওয়াইড, উইকেটের পেছনে বল লুফে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বয়ং জাতীয় দলের উইকেটরক্ষককে। অন্যদিকে, ব্যাটারের ব্যাট থেকে আসছে চার-ছয়ের মার। গ্যালারিতে থাকা দর্শকরা আনন্দে উদ্বেলিত। উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে কমেন্ট্রি বক্স আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। সবার মাঝে বিপিএলে রান দেখার স্বস্তি!

ঠিক একই সময়ে দেশে কিংবা দেশের বাইরে সবার অজান্তে হয়তো চলছে লাখ লাখ টাকার লেনদেন। কখনও কখনও সেটা কোটি টাকার অঙ্কেও চলে যাচ্ছে— এমন সংশয় কারও কারও। কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে ক্রিকেট, তার সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। তবে, কিছু একটা হচ্ছে সেটা যেন অনেকের চোখে স্পষ্ট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিক্সিংয়ের কালো থাবা বিপিএলে এর আগেও ছিল। ২০১৩ সালে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার মোহাম্মদ আশরাফুল।

ফিক্সিং বিতর্কটা এবারও যেন জেঁকে বসেছে। একের পর এক অস্বাভাবিক ওয়াইড, খেলোয়াড়দের শরীরী আচরণে অস্বাভাবিক শিথিলতা, একেবারেই ভিন্ন ঘরানার গেম প্ল্যান– সবকিছু এবারের বিপিএলকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। যে আসর হওয়ার কথা ছিল পরিবর্তনের, সেখানে এখন কলঙ্কের দাগ খুঁজছেন অনেকে।

ঢাকা পোস্টের ক্রীড়া বিভাগের সাম্প্রতিক সময়ের এক অনুসন্ধানে বিপিএলের ফিক্সিংকাণ্ডের খুঁটিনাটি খুঁজে বের করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, যা কিছু পাওয়া যায় তা কেবলই ‘Tip of the Iceberg’ অর্থাৎ একটি বৃহত্তর ঘটনার ছোট একটি অংশ। এর নিচে ফিক্সিং কেলেঙ্কারি কতটা বিস্তৃত, সত্যিকার অর্থে বিপিএলে এমন কিছু চলছে কি না— তার সন্ধান পাওয়া বেশ কঠিন।

“বিপিএল নিয়ে আমাদের উদ্বেগ অনেক বছর ধরেই চলছে। এর কারণ, এটি যে কোনো ‘প্রধান’ টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতার সবচেয়ে অনিয়মিত বাজার। এখানকার বেশিরভাগ ম্যাচেই ক্রিকেটিয় প্যাটার্ন মানা হয় না। অনেক পেশাদার বাজিকর ও সিন্ডিকেট তাই এখানে যুক্ত থাকেন না।”

ক্রিকেটের বেটিং অড তৈরি এবং বাজির দর নির্ধারণ করা এক প্রতিষ্ঠানের প্রধান রব ব্যারন। সঙ্গত কারণেই উহ্য থাকছে প্রতিষ্ঠানটির নাম। যদিও তার প্রতিষ্ঠানের ২০২৪ সালের পরিসংখ্যানটা দেখার মতো।

বিগত বছরে প্রতিষ্ঠানটি ক্রিকেটের বিভিন্ন আসরের আট হাজার ৮৭৩টি ম্যাচের ৩০ লাখ বলের ওপর প্রায় ৪২৪ মিলিয়ন বেটিং অডস তৈরি করেছে। এগুলোর মাঝে বিপিএল ঠিক কোথায় অবস্থান করছে, তা যোগাযোগ করে জানা সম্ভব হয়নি।

 

তবে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সাধারণ ক্রিকেটিয় প্যাটার্ন না থাকায় বাজিকরের দল বিপিএলের জন্য বেছে নেন ভিন্ন এক পদ্ধতি। এখানে ফিক্সিংয়ের ঘটনাগুলো হয় খুব ছোট ছোট আকারে। যেখানে ৩, ৬, ৮, ১০ কিংবা ১২ ওভারের ওপর নির্ভর করে বেটিং অডস নির্ধারণ করা হয়। এর মাঝে ৬, ১০ কিংবা ১৫ ওভারের জন্য মিলিয়ন ডলার খরচের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

সন্দেহজনক কিছু চিত্র
দেশের এক শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, বিপিএলের ২৬তম ম্যাচ পর্যন্ত হিসেব করলে, মোট ১০টি ম্যাচে ১৬টি ওয়াইড বাউন্ডারি হয়েছে। মানে ১৬ বার ওয়াইড থেকে পাঁচ রান এসেছে। কখনও একই ওভারে টানা ওয়াইড থেকে সাত রান পর্যন্ত দেখা গিয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিজ্ঞ কোনো বোলারের কাছ থেকে এমন বোলিং দেখতে পাওয়ার পরই দানা বেঁধেছে সন্দেহ।

সিলেট পর্বের সেই ম্যাচে ঢাকা ক্যাপিটালস খেলছিল টেবিলের ওপরের দিকের এক দলের বিপক্ষে। সেখানে কিছু ওয়াইডের ক্ষেত্রে বোলারের আচরণ ছিল সন্দেহজনক। বল যখন অন্য পিচে চলে যায় তখন সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ না করাও হয়তো অন্যায়। আবার ব্যাকআপ ফিল্ডার না থাকায় ওভার থ্রো থেকে রানের হিসাবও নেহাত কম না।

 

সিলেট পর্বের আরেক ম্যাচে ঢাকা ক্যাপিটালসের বোলিং ইনিংস নিয়ে প্রশ্ন ছিল। যেখানে বলা হচ্ছিল, ব্যাটিংয়ে থাকা দল ছয় ওভার শেষে অন্তত ৬৬ রান নেবে। কিন্তু দলের মূল দুই বিদেশি তারকা আউট হয়ে যাওয়ায় সেটা হয়ে পড়ে অনেকটা কঠিন। এখানে বলে রাখা দরকার, বেটিংয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি বলের ওপর আলাদা নজর রাখা হয়।

সেই প্রমাণও কিছুটা এসেছে ঢাকা পোস্টের কাছে। বিতর্কিত সেই ম্যাচে চার ওভার শেষে রান ছিল ৪২। পরের দুই ওভারে দরকার ২৪ রান। এরই মাঝে পঞ্চম ওভারের প্রথম বলে আউট হন ব্যাটিং দলের আরেক বিদেশি তারকা। উল্লেখ্য, পাওয়ার প্লেতে সেদিন ঢাকার হয়ে শেষ দুই ওভার করেন দুই অখ্যাত বিদেশি। যেখান থেকে একের পর এক ওয়াইড আসে। আবার শেষ ওভারে নিয়ে আসা হয় এমন একজনকে যিনি অখ্যাত বটেই, সঙ্গে পার্ট টাইম বোলার।

তিন ওভার শেষে ৩০ না পার করা দলটা শেষ পর্যন্ত পাওয়ার প্লের ছয় ওভারে ৭০ রান পেরিয়ে যায়। শেষ দুই ওভারে নয় রান এসেছিল অতিরিক্ত থেকে। আর শেষ ওভারে ছিল একাধিক বাজে বল থেকে বাউন্ডারির ঘটনা।

 

কে কী বলছেন?
ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে এমন ফিক্সিং ইস্যুতে কথা হয় ক্রিকেটসংশ্লিষ্ট চারজনের সঙ্গে। তাদের একজন বিপিএলে ম্যাচ পরিচালনা করা আম্পায়ার, দুজন সাবেক ক্রিকেটার এবং অন্যজন সরাসরি ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত। তবে, একজন সাবেক অধিনায়ক ছাড়া আর কেউ এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি।

বিপিএলে আম্পায়ারিং করা এক আম্পায়ার বলেন, ‘এ বিষয়ে তার কিছু বলার নেই। পুরা বিষয়টি আইসিসির দুর্নীতি দমন বিষয়ক ইউনিট আকসু এবং বিপিএলের টেকনিক্যাল কমিটি দেখবে।’ সাবেক অধিনায়কদের একজন বলেন, ‘আমি বিপিএলের কোনো ম্যাচই দেখি না। এমনকি চলতি বিপিএলের কোনো খেলাই দেখিনি।’

বিসিবির এক পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ বিষয়টি আকসু দেখছে। সব তারাই দেখবে। এ ছাড়া আইসিসিও পর্যবেক্ষণ করছে। নো বল বা যা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেগুলো আকসু মনিটর করছে।’

 

দেশের আরেক সাবেক অধিনায়ক অবশ্য সংশয়বাদীদের দলে। সরাসরি তিনি বলেন, ‘অস্বাভাবিক তো লাগছেই। এবার একটু বেশিই লাগছে। এটা নোংরামির পর্যায়ে চলে গেছে।’ বিপিএলের চলতি আসর এরই মাঝে দেখে ফেলেছে ‘বেতনহীন’ থেকে খেলোয়াড়দের ‘অনুশীলন বর্জনের’ মতো ঘটনা। দেখেছে টিকিট নিয়ে ভাঙচুর এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। উদ্বোধনী ম্যাচে প্র্যাকটিস কিট পরেই টস করতে চলে আসা, ছোট বাউন্ডারি থেকে শুরু করে অনেক ইস্যুতে চলেছে বিতর্ক। তবে, এসব পার করে ফিক্সিং গুঞ্জনের বিষয়টি যেন ২০২৫ আসরের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক।

সূত্র : ঢাকা পোষ্ট




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top