প্লাবিত উপকূল, পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২৬ মে ২০২১, ১৮:২১

প্লাবিত উপকূল, পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে গত রাত থেকেই দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। মঙ্গলবার থেকে বেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরসহ উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীগুলো। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে কয়েক ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, শঙ্কা রয়েছে জলোচ্ছ্বাসের। উপকূল সংলগ্ন বিভিন্ন জেলার নানা স্থানে ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাটে পানি উঠছে, ভেঙে যাচ্ছে বাঁধ। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে লক্ষাধিক মানুষ।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাঠানো প্রতিনিধিদের তথ্যে রিপোর্ট:

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতায় উঠে উপকূলে আছড়ে পড়ছে। বাগেরহাটে ইয়াসের প্রভাবে মঙ্গলবার সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্নসহ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। শরণখোলার বলেশ্বর, মোরেলগঞ্জের পানগুছি, মোংলার পশুর, বাগেরহাটের ভৈরব, দড়াটানাসহ সব নদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে কয়েক ফুট বেড়েছে।

এরই মধ্যে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে মোরেলগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকাসহ সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম। মোরেলগঞ্জ উপজেলার পানগুছি নদীর তীরে থাকা শানকিভাঙ্গা ও বদনী ভাঙ্গা গ্রামে বেড়িবাঁধ না থাকায় আতঙ্কিত বাসিন্দারা। ঝড়ের প্রভাব শুরুর আগেই তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মোরেলগঞ্জ সদরের গাবতলা গ্রামের সালেহা বেগম বলেন, ‘সকাল থাইক্কা গাঙ্গের পানি বাড়তেছে। সহাল ১০টার দিকে পানিতে মোগো বাড়ি-ঘর তলাই গেছে।’ একই গ্রামের জামাল ফজলু হাওলাদার বলেন, ‘জোয়ারে গাঙ্গের পানি যেভাবে বারতিছে, তাকে দুপুরে আসতে আসতে মোগা ভাইসা যামু।’

বাগেরহাটে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতায় উঠেছে পানি

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৌদ্ধ বলেন, ‘পূর্ণিমার ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে উপকূলীয় এলাকায় নদী-খালের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। দুপুর নাগাদ এ পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভাটিতে এ পানি আবার নেমে যাবে।’

সাগর উত্তাল হয়ে ওঠায় এবং ঝড়ো বাতাস বয়ে যাওয়ায় সুন্দরবনের বিভিন্ন সাইক্লোন শেল্টারসহ কোস্টগার্ডের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নতুন করে সিগনাল না বাড়ায় এবং আবহওয়া এখনও বেশি খারাপ না হওয়ায় মোংলা বন্দরে অবস্থানরত ১১টি বিদেশি জাহাজের পণ্য ওঠানামা ও পরিবহনের কাজ স্বাভাবিক রয়েছে। বন্দরের হারবার মাস্টার কমান্ডার শেখ ফখরউদ্দীন বলেন, সিগনাল ৪ নম্বর না হওয়া পর্যন্ত বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকবে।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মঈনুদ্দিন খান বলেছেন, সুন্দরবন ও খুলনা অঞ্চলে ইয়াস সরাসরি আঘাত না করলে ম্যানগ্রোভ বনটি ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা অনেকটাই ঠেকিয়ে দেবে। তাতে বাংলাদেশের উপকূলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম হবে। তবে পূর্ণিমার সময় ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়লে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন তিনি।

ভোলা

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে গতকাল রাত থেকে দ্বীপজেলা ভোলায় বেশ বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। উত্তাল হয়ে উঠেছে উপকূলী সংলগ্ন নদ-নদী। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়ে কূলে আঘাত হানছে জোয়ার। ভোলার সর্বদক্ষিণের চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন চর ইউনিয়ন ঢালচর ও চরকুকরি মুকরি ইউনিয়ন চার থেকে পাঁচ ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে করে দুই ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

ঢালচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল সালাম হাওলাদার জানান, সকাল থেকে হঠাৎ করেই পানি বাড়তে শুরু করে। এতে করে ওই চরটিতে থাকা অন্তত ৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। মানুষের বাড়িঘরে পানি উঠে ঘরের আসবাবপত্রসহ খাবার-দাবার নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া জোয়ারের পানিতে রাস্তাসহ চলাচলের পথ ডুবে গেছে। রাতে পানি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে এমন আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের কোস্ট ট্রাষ্টের অফিস ও পুলিশ ফাঁড়ির ভবনে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

ভোলায় প্লাবিত লোকালয়

অপরদিকে কুকরি মুকরি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম মহাজন জানান, সকাল থেকে তার ইউনিয়নের কুকরি মুকরি ও চর পাতিলা ৪ থেকে ৫ ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সেখানে প্রায় ৮ হাজার লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিকেলে এসব বাসিন্দাদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে নদীতে থাকা মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার তীরবর্তী এলাকায় নিরাপদে চলে আসতে শুরু করেছে। ঘূর্ণিঝড় থেকে উপকূলের বাসিন্দাদের সতর্ক করতে মাইকিং করছে কোস্টগার্ডসহ সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো।

এরই মধ্যে বিকেল ৪টার দিকে ঝড়ের কবলে পড়ে ভোলার মেঘনা নদীতে নয়জন জেলে নিয়ে বাহার মাঝির একটি মাছধরা ট্রলার ডুবে গেছে। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মেঘনা নদীর ভোলা-দৌলতখান সীমান্তবর্তী এলাকায় এ ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ডুবে যাওয়া ট্রলারসহ ৯ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।

ভোলা জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী পানিবন্দির বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ঝুঁকিপূর্ণ চরগুলোতে আটকে পড়া বাসিন্দাদের উদ্ধারে ইতিমধ্যে কোস্টগার্ড ও জেলা প্রশাসনের দুটি ইউনিট ঢালচরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবধরনের গ্রহণ করা হয়েছে। ভোলার উপকূলের ৪০টি দ্বীপচরকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে সেখান থেকে ৩ লাখ ১৮ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে আনার প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে জেলার ৭০৯ টি আশ্রয় কেন্দ্র । জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে ৮টি কন্ট্রোল রুম। পাশাপাশি ৭৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।

পানি বৃদ্ধি পেয়ে ডুবছে বাজারের দোনানপাট

অন্যদিকে সিপিপি'র ১৩ হাজার সেচ্ছাসেবী ছাড়াও রেডক্রিসেন্ট এবং স্কাউটস কর্মীদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিবন্ধী, নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায়ও আলাদা টিম গঠন করা হবে। প্রস্তুত থাকবে ফায়ার সার্ভিসের ১৪ টিম ও স্বাস্থ্য বিভাগের ২০০ কমিউনিটি ক্লিনিক।

এনএফ৭১/আরএইচ/২০২১




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top