মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

জুজুৎসুতে রফিকুলের ধর্ষণকাণ্ড

মিথ্যা মামলায় ১২ দিন জেলেও ছিলেন সেই নারী ক্রীড়াবিদ

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২০ মে ২০২৪, ১৪:৫০

ছবি: সংগৃহীত

মিথ্যা মামলায় ১২ দিন জেলেও ছিলেন সেই নারী ক্রীড়াবিদ, এ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক সমকাল। প্রতিবেদনটি নিউজফ্ল্যাশের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো:

ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে প্রায় আড়াই বছর ধরে নারী ক্রীড়াবিদকে ধর্ষণ করেন বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের (জাপানি মার্শাল আর্ট) সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম নিউটন (৬৫)। ২০-২২ বছরের মেয়েটি একাধিকবার তাঁর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি চলে যেতে চাইলেই তাঁর সামনে উপস্থাপন করা হতো মোবাইল ফোনে ধারণ করা ধর্ষণের ছবি-ভিডিও।

তবে এক পর্যায়ে মেয়েটির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে গত ২ এপ্রিল অ্যাসোসিয়েশন থেকে বের হয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান তিনি। ঢাকা ছেড়েও শেষরক্ষা হয়নি। তাঁকে নিজের কাছে রাখতে রফিকুল তাঁর সহযোগী আরেক নারী ক্রীড়াবিদকে দিয়ে চুরির মামলা দেন মেয়েটির বিরুদ্ধে। ওই মিথ্যা মামলায় ১২ দিন জেলও খাটেন মেয়েটি।

রোববার ‍সেই ভুক্তভোগী নারী ক্রীড়াবিদ জানান, রাজধানীর শ্যামলীর ২ নম্বর রোডের ৩৫ এফ/৬-এর আশানুর রহমান টাওয়ারের নিচতলায় জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশন। নানা বয়সী মেয়েরা জুজুৎসুর প্রশিক্ষণ নেন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে ভবিষ্যতের বড় ক্রীড়াবিদ তৈরি করছেন রফিকুল। আসলে এই সংগঠনকে নিজের ভয়ংকর যৌন আকাঙ্ক্ষার পাঠশালা বানিয়ে ফেলেছেন তিনি।

ভুক্তভোগী তরুণী জানান, তিনি ২০২১ সালের শেষের দিকে জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রফিকুলের হাতে নির্যাতিত হন। তাঁর মতো আরও কিছু নারীর একই অবস্থা হয়েছে। ১৬ বছরের এক কিশোরী ক্রীড়াবিদ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। পরে এক নারী চিকিৎসকের বাসায় কিশোরীর গর্ভপাত করানো হয়। মানসম্মানের ভয়ে রফিকুলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি ওই কিশোরী।

ধর্ষণের শিকার তরুণী গত ১৮ মে রফিকুলের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। ধর্ষণে রফিকুলকে সহায়তা করায় এক নারী ক্রীড়াবিদকেও আসামি করা হয়েছে। গত শনিবার র‍্যাব রফিকুল ও তাঁর সহযোগী নারী ক্রীড়াবিদকে গ্রেপ্তার করে। ওই দিনই তাদের শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। গতকাল তাদের এক দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

তরুণী জানান, রফিকুল জোরপূর্বক মেয়েদের পোশাক বদলের কক্ষে গিয়ে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন করতেন। মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে পরবর্তী সময়ে মেয়েদের অনৈতিক সম্পর্ক রাখতে বাধ্য করতেন। তাঁকে সহযোগিতা করতেন আরেক নারী খেলোয়াড়।

জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশন প্রশিক্ষক রফিকুলের বিরুদ্ধে মানব পাচারেরও অভিযোগ উঠেছে। খেলোয়াড় ছাড়া অন্য ব্যক্তিদের নিয়ে টিম গঠন করে তাদের বিদেশ পাঠিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি।

ভুক্তভোগী নারী ক্রীড়াবিদ জানান, আড়াই বছর আগে তিনি জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনে ভর্তি হন। সেখানেই একটি কক্ষে পাঁচ তরুণী থাকতেন। পাশের কক্ষে থাকতেন তাদের প্রশিক্ষক রফিকুল। ভর্তির সপ্তাহখানেক পরে একদিন দুপুরে তরুণী পোশাক বদল কক্ষে পোশাক পরিবর্তন করছিলেন।

এ সময় রফিকুল ওই কক্ষে ঢুকে তাঁর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেন। এতে তিনি বাধা দিলে তাঁকে অ্যাসোসিয়েশন থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। আজীবন খেলাধুলা থেকে বহিষ্কার করে দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁর রয়েছে বলে জানান রফিকুল। এক পর্যায়ে মারধর করা হয় তরুণীকে। এরই মধ্যে রফিকুলের সহযোগী এক নারী ক্রীড়াবিদ ঢুকে রফিকুলের প্রস্তাবে রাজি হতে বলেন এবং মোবাইল ফোনে ছবি তোলেন তরুণীর।

এর প্রায় এক মাস পর এক রাতে রফিকুলকে নিয়ে ওই নারী তাদের কক্ষে ঢোকেন। সবাইকে মোবাইল ফোনে অশ্লীল ভিডিও দেখান তারা। এক পর্যায়ে তরুণীকে জোরপূর্বক রফিকুল তাঁর কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করেন। সেই দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করেন রফিকুলের সহযোগী নারী। এরপর ওই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে দিনের পর দিন মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়।

তরুণী জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পাবনা সদর আসনের এমপি গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্সের কাছে রফিকুলের কুকীর্তির তথ্য তুলে ধরে বিচার দাবি করেন। তবে প্রিন্সও মেয়েটিকে মামলা করতে নিষেধ করে রফিকুলের পক্ষে সাফাই গান বলে দাবি ভুক্তভোগীর।

তবে প্রিন্স বলেন, কোনো ভুক্তভোগী রফিকুলের বিরুদ্ধে আমার কাছে অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতাম। এ ঘটনায় অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান তিনি।

ভুক্তভোগী তরুণী জানান, গত ২ এপ্রিল তিনি অ্যাসোসিয়েশন থেকে বের হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে রফিকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পরও পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। পুলিশ বলেছিল, অভিভাবক লাগবে। পরে অন্য অভিযোগে তিনি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে গ্রামের বাড়ি চলে যান।

এরপর ৬৫ লাখ টাকা ও পাসপোর্ট চুরির অভিযোগে রফিকুলের সহযোগী নারী ওই তরুণীর বিরুদ্ধে ৮ এপ্রিল শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় তরুণী গ্রেপ্তার হয়ে ১২ দিন জেল খেটে ২১ এপ্রিল জামিনে মুক্তি পান।

তরুণী জানান, কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রফিকুল একটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন। তাতে লেখা ছিল, তিনি রফিকুলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন না। আমাকে অ্যাসোসিয়েশনে আটকে রাখার জন্য রফিকুল তার সহযোগীকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা চুরির মামলা দিয়েছে। যাতে ভয়ে আমি রফিকুলের কথায় রাজি হই। আমার মতো একাধিক নারী ক্রীড়াবিদকে রফিকুল ধর্ষণ করেছে। সবাইকেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতো।’ তরুণী জানান, তাঁর মামলার এক নারী সাক্ষীকে রফিকুলের লোকজন হুমকি দিচ্ছেন।

তিনি জানান, গত রমজান মাসে রফিকুল তাঁকে উত্তরার একটি বাসায় ১০ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। সেটি রফিকুলের বোনের বাসা। বাসায় কেউ ছিল না। একদিন তিনি আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বাথরুমে হারপিক খাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন রফিকুল তা কেড়ে নেন। তরুণী জানান, তিনি দরিদ্র ঘরের সন্তান। মামলা চালানোর খরচ জোগাতে কয়েক দিন আগে কানের স্বর্ণের দুল বিক্রি করেছেন।




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top