বেপরোয়াভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন বেনজীরঃ
নামের প্রতি এমন সম্মান বোধহয় এর আগে আর কেউ দেখাতে পারেননি। বে-নজির মানে নজিরবিহীন। হ্যাঁ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের কথাই বলা হচ্ছে। শুধু সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রেই নয়, দেশ ত্যাগের ক্ষেত্রেও তিনি বে-নজির।
পত্রিকার পাতা আর টেলিভিশনে প্রতিদিনই নতুন নতুন সম্পদের খবর উঠে আসছে পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের। বন-পাহাড়-সমুদ্র কোথায় নেই তার সম্পদ! এ পর্যন্ত শুধু তার ৬২১ বিঘা জমিই জব্দ করা হয়েছে। কালই তা বেড়ে হাজার বিঘার খবরে পরিণত হলেও অবাক হবে না মানুষ।
একজন মানুষের কয়টি অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে! বেনজীর আহমেদের ৩৮টি অ্যাকাউন্ট জব্দই হয়েছে। আরও যে নেই নামে-বেনামে, তাই-বা বলবে কে? এত বিপুল সম্পদ গড়ে যদিও তিনি এখন লাপাত্তা। পুলিশ সদস্যদের তিনি হিম্মতওয়ালা হওয়ার পরামর্শ দিতেন, মাটির গভীর থেকে দুর্নীতিবাজদের তুলে আনার হুংকার দিতেন। তিনিই কিনা চুপিসারে দেশ ছেড়েছেন, মানা যায়!
বেনজীর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কেবল নড়েচড়েই বসেননি, রীতিমতো হম্বিতম্বি শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারও। দুদক আগামী ৬ জুন তলব করেছে বেনজীর আহমেদকে। সেদিন তিনি দুদকে হাজির হচ্ছেন না, তা অনেকটা নিশ্চিত। তারপরও সেদিন পর্যন্ত সবার চোখ থাকবে দুদকের দিকেই। থাকবে সব আয়োজন। যদি তিনি আসেন?
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, অবশ্যই ৬ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এলে একধরনের কনসিকোয়েন্স, না এলে আরেক ধরনের কনসিকোয়েন্স। এমনও হতে পারে উনি আইনজীবীর মাধ্যমে সময় চাইতে পারেন। কাজেই ৬ তারিখ পার না হলে কিছুই বলা যাবে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে থেকে এর আগে কেউ এতটা বেপরোয়াভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন এমন তথ্য নেই কারো কাছে। আর তা হবেই-বা কীভাবে তিনি তো বে-নজির। সময়
গাজীপুরেও ভয় দেখিয়ে জমি কেনেন বেনজীরঃ
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে গাজীপুরের কালীগঞ্জেও বিপুল পরিমাণ জমি কেনা হয়েছে। এসব জমির বেশির ভাগই তিনি কিনেছিলেন হিন্দু ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছ থেকে।
বেনজীর পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি রয়েছে, যার প্রায় বেশির ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। এসব জমিসহ মোট ৬২১ বিঘা ইতিমধ্যে জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এই ৬২১ বিঘা জমি ছাড়াও বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে একটি সাততলা বাড়ি ও বেনজীরের নামে ভাটারায় একটি চারতলা বাড়ির খোঁজ পেয়েছে দুদক। গাজীপুরে বেনজীর পরিবার জমি কেনা শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। তখন র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। প্রথম আলো
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর স্ত্রী, সন্তান ও কয়েকজন স্বজনের নামে প্রায় ১১৪ একর বা ৩৪৫ বিঘা জমি খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সবচেয়ে বেশি জমি পাওয়া গেছে তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে। বেনজীরের সম্পদ জব্দ করার জন্য দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের আদেশে জমির এই হিসাব পাওয়া গেছে। প্রথম আলো
দেশজুড়ে বেনজীর আহমেদের জমিদারিঃ
উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম এবং মধ্যাঞ্চল –সব অঞ্চলেই জমির খোঁজ মিলছে তাঁর; যেন দেশজুড়ে তাঁর জমিদারি। জেলায় জেলায় জমি কেনার এই অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে। নিজের, স্ত্রী-সন্তান, স্বজনদের নামে ও বেনামে কেনা হয়েছে কয়েক শ একর জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পাঁচটি দেশেও তাঁর সম্পদ গড়ার অভিযোগ আছে।
রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১০ জেলায় এখন পর্যন্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। অন্য ৯টি জেলা হলো গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, সাতক্ষীরা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, বান্দরবান ও কক্সবাজার। এসব জেলায় রয়েছে জমি, খামার, রিসোর্ট। সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও আছে জমি। গতকাল সোমবার পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন জেলায় থাকা জমির পরিমাণ ২ হাজার ৩৮৫ বিঘা বা ৭৮৬ একর। তাঁর সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত গত ২৩ ও ২৬ মে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের নামে থাকা ১৯৩টি দলিলের জমি, গুলশানের ৪টি ফ্ল্যাট ক্রোকের এবং বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ৩৩টি হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ১৯টি প্রতিষ্ঠানে তাঁদের নামে থাকা শেয়ার, ৩টি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধ করারও আদেশ দিয়েছেন আদালত।
বেনজীররা কীভাবে সবার চোখ এড়িয়ে দেশ ছাড়েনঃ
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের সম্পদ অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় গত ১৮ এপ্রিল। এরপর সংস্থাটির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিপুল সম্পদ। কিন্তু অনুসন্ধান চলার মধ্যেই গত ৪ মে সপরিবার দেশ ছেড়েছেন বেনজীর।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা শেখ আবদুল হাইয়েরও কোনো খোঁজ নেই। তিনিও সপরিবার দেশ ছেড়েছেন বলে দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতে ধরা পড়েছেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার।
প্রশ্ন উঠেছে, দুদক, গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থাকে ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এই আলোচিত ব্যক্তিরা বিদেশে চলে গেলেন? নাকি তাঁদের বিদেশ চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং এখন চলছে লোকদেখানো অনুসন্ধান ও আইনি ব্যবস্থা। পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, বেনজীর আগেও সরকারের ছাড় পেয়েছেন। এখনো পাচ্ছেন।
দেশ ছাড়ার আগে যা যা বিক্রি করলেন বেনজীরঃ
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করার আগেই অ্যাকাউন্টের অধিকাংশ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অর্থ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুবাইয়ের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার পর তা বিক্রি করে দিয়েছেন বেনজীর-এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।
সাবেক এই আইজিপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরপরই আড়ালে চলে যান। তবে কোথায় ছিলেন সেটি নিদিষ্ট করে জানা যাচ্ছিল না। তবে বেনজীরের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া গেছে। বেনজীর এখন দেশে নেই।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের রেকর্ডে উল্লেখ আছে, গত ৪ মে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। এ সময় পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে ছিলেন।
ক্ষমতায় থাকতে যারা তার অতি আপন ছিলেন, তারাও এখন সরে গেছেন। এমনকি পুলিশ সদর দপ্তরের অন্তত ৫টি কেনাকাটার খাত থেকে বিপুল অর্থ লোপাটে যেসব কর্মকর্তা সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন তারাও বেনজীরকে ‘খারাপ’ আখ্যা দিচ্ছেন। বেনজীরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে চিহ্নিত ওই কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই এখন খারাপ অবস্থায় আছেন।
এদিকে বেনজীর পরিবারের সম্পদের খোঁজে তল্লাশি অব্যাহত রেখেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান টিম। ধারাবাহিকভাবে তারা বেনজীর পরিবারের নামে-বেনামে নতুন নতুন সম্পদের তথ্য পাচ্ছে। এমনকি ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে পরিচিত কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নামেও সম্পত্তি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে নতুন করে সাতক্ষীরায় বেনজীরের শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও আরেক পুলিশ কর্মকর্তার নামে কয়েকশ বিঘা আয়তনের মাছের ঘের থাকার তথ্য এসেছে দুদকের হাতে। এছাড়া ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুবাইয়ের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার পর তা বিক্রি করে দিয়েছেন বেনজীর-এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।
বেনজীরের মোবাইল ফোন এখন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি ‘আত্মগোপন’ অবস্থায় থাকলেও তার শুভাকাক্সক্ষী হিসাবে পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬ জুন দুদকের তলবের জবাব দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। এ কাজে বেশ কয়েকজন আইনজীবীর একটি টিম কাজ করছে। যুগান্তর
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।