রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান বুধবার থেকে

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:৪৬

ছবি: সংগৃহীত

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আগামী বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে যৌথ অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রোববার (১ সেপ্টেম্বর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান হয়। এর আগে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনার সময় থানায় সংরক্ষিত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায় আক্রমণকারীরা।

এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয় কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ। তবে সে সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। আরও বহু অস্ত্র বাইরে রয়ে গেছে। সেসব অস্ত্র এবং আগে থেকে অনেকের কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান পরিচালনা করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার কার্যক্রমসহ নিয়মিত টহল ও নজরদারি অব্যাহত রাখা হবে বলে এরই মধ্যে একাধিকবার জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই সরকারের হত্যা, নির্যাতন, গুম, অর্থ পাচার ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিদিন মামলা হচ্ছে সারা দেশে। তবে যে গতিতে মামলা হচ্ছে, সে তুলনায় আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছে খুবই কম।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এখনই বড় অভিযান পরিচালনার পক্ষে নয় অন্তর্র্বতী সরকার। গণগ্রেপ্তারের দুর্নাম এবং মানুষ হয়রানি এড়াতে ধীরে চলো নীতিতে চলছে তারা। পুলিশ পুনর্গঠনের পর সুনির্দিষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে, সুনির্দিষ্ট অভিযান পরিচালনা করে তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।

মামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করেছেন, মামলার আসামিও এজাহারে উল্লেখ আছে। গ্রেপ্তারের বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেবেন। তদন্ত কর্মকর্তার প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁকে সহযোগিতা করা হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার করে লাভ নেই, অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে। হাজার হাজার গ্রেপ্তারের পর দেখা গেল, মূল অপরাধী বিচারের মুখোমুখি হলো না, এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে।

প্রতিটি অপরাধের ঘটনার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কে হত্যা করেছে, কে মানুষ তুলে নিয়েছে, কারা অস্ত্রের মহড়া দিয়ে গুলি করেছে, সবার নাম-ঠিকানা ও পরিচয় রয়েছে। প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। তবে নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না। সে জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, সেই অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করবে।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত শতাধিক হত্যা মামলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। সব কটি মামলা হয়েছে বিভিন্ন সময় গুম ও জুলাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা করা হয় গত ১৩ আগস্ট, রাজধানীতে। আর শততম মামলাটি করা হয়েছে ২৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

হত্যা মামলাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গণহত্যার অভিযোগে ৮টি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় জমা পড়েছে। আর ৯৪টি মামলা করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন থানায়। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০১টি হত্যা মামলা করার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অপহরণ করে গুমের অভিযোগেও একটি মামলা করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি ছাড়াও তাঁর মন্ত্রিসভায় থাকা মন্ত্রী, এমপি, সচিব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে গ্রেপ্তারের সংখ্যা খুবই কম।

গ্রেপ্তার ও মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, এ বিষয়ে এখনো মন্তব্য করার সময় হয়নি। র‍্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস বলেন, প্রতিটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁরা কোনো সহায়তা চাইলে র‍্যাব করবে। ইতিমধ্যে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশে সোপর্দ করেছে র‍্যাব। এভাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যদি চান, তাহলে র‍্যাব তাঁদের সহযোগিতা করবে।

যৌথ কোনো অভিযানে র‍্যাব অংশ নেবে কি না জানতে চাইলে র‍্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, আপাতত যৌথ অভিযানের কোনো পরিকল্পনা নেই। র‍্যাব বিশেষত ইউনিট হিসেবে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গ্রেপ্তার হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা ছাড়াও গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলকেও গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।

জুলাই ও আগস্টে যত হত্যা এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর তুলনায় অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা কম কেন জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, ‘দেশ একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে। সবকিছুই এখানে নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে, পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক হলেই মামলার তদন্ত, অপরাধী গ্রেপ্তার, অভিযানের কার্যক্রম—সবকিছু ঠিক হবে। এ জন্য আমাদের কার্যক্রম চলছে।’

এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সারা দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অস্ত্র ৪৫ হাজার ২২৬টি। এগুলোর মধ্যে পিস্তল ৪ হাজার ৬৮৩টি, রিভলবার ২ হাজার ৪৩টি, একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯টি, দোনলা বন্দুক ১০ হাজার ৭১৯টি, শটগান ৫ হাজার ৪৪৪টি, রাইফেল ১ হাজার ৭০৬টি এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪ হাজার ৬টি। বাকি অস্ত্রগুলো বিভিন্ন আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স করা।

প্রাপ্ত হিসাব বলছে, এসব অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিবিদদের কাছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে ৭ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে ৭৯টি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।

ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরই সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়। তখন আতঙ্কে দুর্নীতিবাজদের অনেকেই রাস্তায় গাড়ি ও টাকার ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার নজির আছে।

এর আগে ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সারা দেশে অভিযানে নেমেছিল যৌথবাহিনী। তখন ভয়ে অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আবার অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top