শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বরিশালের ‘গডফাদার’ হাসানাত আব্দুল্লাহ কোথায়?

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:১৯

ছবি: সংগৃহীত

বরিশাল আওয়ামী লীগ সাড়ে চার দশক ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার বাবা শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতও ছিলেন মন্ত্রী। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বড় ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ মহানগরের সাধারণ সম্পাদক। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে লাপাত্তা বরিশালের গডফাদার খ্যাত হাসানাত আব্দুল্লাহ ও তার ছেলে। কোথায় আছেন তারা, তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনাকল্পনা।

আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বরিশাল-১ (গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। একাদশ সংসদের সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেও অসহযোগ আন্দোলনের পর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করলে তিনি পদ হারান।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছোট ছেলে সেরনিয়াবাত আশিক আবদুল্লাহকে নিয়ে পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। হাসানাত ভারতে আছেন তার মেয়ে আঞ্জুমানারা কান্তা আব্দুল্লাহর কাছে। কান্তা একজন ভারতীয় নাগরিককে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করেন। কান্তার স্বামী ভারতের দিল্লিতে সমাধিস্থ বিশ্বের বিখ্যাত সুফি সাধকদের অন্যতম নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) এর দরগা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি।

কান্তা তার বাবা হাসানাত আবদুল্লাহর অপকর্মের দোসর ছিলেন। তিনি বহু বছর তার বাবার ক্যাশিয়ার এবং ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। কান্তা তার বাবার সমস্ত ঘুষের টাকা সংগ্রহ করতেন। কান্তা মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন দপ্তরে সুপারিশ করতেন বলে জানা গেছে।

যেকোনো সংকটে উৎড়ানোর জন্য বিকল্প ভেবে রেখেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই এই হাসানাত আবদুল্লাহ। ভারতকে 'সেফ হোম' ভেবে রেখেছিলেন তিনি। এজন্য ভারতের একটি প্রদেশে দেশ থেকে টাকা পাচার করে প্রচুর সম্পদ কিনে রেখেছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার পতনের আগেই দেশ ছেড়ে পালান তিনি।

এক দশকের বেশি সময় ধরে হাসানাতের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা খায়রুল বাশার গত ২ আগস্ট ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেন। লেখা ছিল– ‘শর্ট নোটিশে মুম্বাই যাচ্ছি’। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওই দিনই হাসানাত ভারত গেছেন।

হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এবং আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছোট ভাই সিটির বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ দেশেই আত্মগোপনে আছেন। এই সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তিনি মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন। দুর্নীতিগ্রস্ত, মাদকাসক্ত সাদিক আব্দুল্লাহ টর্চার চেম্বার তৈরি করেছিলেন বলেও জানা গেছে।

সাড়ে চার দশক ধরে বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা হাসানাত আবদুল্লাহ গৌরনদী-আগৈলঝাড়া টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। দপ্তর ও কাজের ধরন অনুযায়ী ১০-১২% টাকা নিতেন। গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌরসভার মেয়র মো. হারিছুর রহমান হারিছ এসব কাজের দেখাশুনা করতেন। ২০১৪ সালের পর থেকে এ সকল টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়।

এর আগে এগুলোতে কোনো কমিশনের টাকা দিতে হতো না। আগৈলঝাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ লিটন সেরনিয়াবাত এ উপজেলার দায়িত্বে ছিলেন। এই দুই ব্যক্তির মাধ্যমে পুরো নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন হাসানাত আবদুল্লাহ। টানা অনেক বছর ক্ষমতায় থাকার জন্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণও ছিল তার হাতে। তবে এটি দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন তারই ছোট ছেলে আশিক আব্দুল্লাহ।

এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (৪০ দিন) প্রকল্পের শ্রমিক সাপ্লাই দিতেন হারিছ ও লিটন। সেখানে আগৈলঝাড়ায় প্রতিদিন ২০০ লেবার * ৪০ দিন * ৪০০ টাকা = ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা নিতেন লিটন। আর গৌরনদীতে প্রতিদিন ৩০০ লেবার * ৪০ দিন * ৪০০ টাকা = ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিতেন হারিছ।

সেই টাকা যেত আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কাছে। তিনি নিজেই সেই টাকার বণ্টন করতেন নেতাকর্মীদের মধ্যে। তার এসব কাজে সহায়তা করতেন দুই উপজেলার ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা। আর তাই প্রতিবার তাদেরই নমিনেশন দেন হাসানাত। হাসানাত আবদুল্লার ছোট ছেলে আশিক আবদুল্লাহ জেলা পরিষদের সকল টেন্ডার এবং কাজের বিনিময়ে মোটা অংকের অর্থ নিতেন বলে জানা গেছে।

এদিকে, গত ৫ আগস্ট বিকেল সোয়া ৪টায় বিক্ষুব্ধরা কালীবাড়ি সড়কে হাসানাতের বাড়িতে ভাঙচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনতলা বাড়িটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। পরে দোতলার একটি কক্ষ থেকে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সিটি কাউন্সিলর গাজী নাঈমুল ইসলাম লিটু ও আরও দুই কর্মীর পোড়া মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, এ ঘটনার কয়েক মিনিট আগে সাদিককে ভবনের ছাদে দেখা গেছে। বাড়ির মধ্যে দলের অনেক কর্মী ছিল। তাদের নিয়ে দুপুরে সদর রোডে মহড়া দেন সাদিক।

জানা গেছে, বিক্ষুব্ধরা ঢোকার পর সাদিক বাড়ির পেছনের পকেট গেট দিয়ে বেরিয়ে যান। সঙ্গে ছিল স্ত্রী ও সাত বছর বয়সী সন্তান। তারা গলির মধ্যেই একটি বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সন্ধ্যার পর ওই বাসা থেকে বেরিয়ে হাসপাতাল রোডে উঠে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে একটি সিএনজি অটোতে সোনালী সিনেমা হলের দিকে চলে যান।

প্রবল গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাত্র সাত দিনের মাথায় ১৩ আগস্ট বরিশালে যান সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর মেজ ছেলে মঈন আব্দুল্লাহ। আগুনে পুড়ে যাওয়া নিজের বাড়ি দেখে এবং মায়ের কবর জিয়ারত করে আবার ফিরে যান তিনি।

এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের ছেলে মুয়াজ আরিফ। মঈন আব্দুল্লাহর এই সফর নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় বরিশালজুড়ে। মঈন আব্দুল্লাহ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস‌্য ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক।

স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি জানান, কালীবাড়ি রোড থেকে মঈন আব্দুল্লাহ নগরীর মুসলিম গোরস্থানে গিয়ে তার মা বেগম সাহানারা আব্দুল্লাহ ও কাউন্সিলর গাজী নঈমুল হোসেন লিটুর কবর জিয়ারত করে বরিশাল ত্যাগ করেন।

হঠাৎ সফরের বিষয়ে জানতে চাইলে মঈন আব্দুল্লাহ বলেন, “আমার জন্মস্থান বরিশালে আমি যাব এতে অবাক হওয়ার কী আছে? আমি তো রাজনীতি করি না। আমি ব্যবসায়ী, এফবিসিসিআইর পরিচালক এবং সিআইপি। এই সফরে উপদেষ্টার ছেলের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে মঈন বলেন, “সে তো আমার ছোটবেলার বন্ধু। সেই শিশুকাল থেকে আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি। বন্ধুত্ব আর রাজনীতি মিলিয়ে ফেলবেন না।” সূত্র: ইত্তেফাক



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top