ক্ষমতার অপব্যবহার করে পদবাণিজ্য করতেন ম্যাডাম যুবলীগ
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:১৫
নাহিদ সুলতানা যুথি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। কিন্তু আদালত অঙ্গন ছাড়িয়ে যুবলীগের রাজনীতিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। নিজের অনুসারীদের নিয়ে গড়েন একটি শক্তিশালী ক্ষমতার কেন্দ্র। যুবলীগের কমিটিতে কোটি কোটি টাকায় পদবাণিজ্য, কমিটি ঝুলিয়ে রাখা, বড় কমিশন আদায় এবং জবর-দখলের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। মাত্র ৫ বছরেই যুবলীগকে চাপে ফেলে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। এমনকি যুবলীগের ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোর করে হতে চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি।
যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতাকর্মীরা বলছেন, যুথি ‘যুবলীগের শাসক’ হয়ে উঠেছিলেন। তার রাজত্বে সবাই ছিল ‘করদ প্রজা’। তাকে টাকার জোগান না দিলে কাউকে নিস্তার দিতেন না। তার এতসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যুবলীগের নেতাকর্মীর পাশাপাশি তার স্বামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশও কথা বলতে ভয় পেতেন। চেয়ারম্যানের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাকে সমীহ করলেও তিনি তাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতেন। যুবলীগের প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ হাসিল করতেন তিনি।
জানা গেছে, বার কাউন্সিল থেকে যখন তিনি পিকনিকে যেতেন বা কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকতো তখন কোক, সেভেনআপ, স্ন্যাকস যুবলীগ থেকে দিতে হতো। কাউকে মুরগি কিনে দেওয়ার অর্ডার করতেন আবার কারও ওপর আদেশ চাপতো পোলাউ রান্না করে পাঠানোর। যুবলীগের অফিসেও একটি আলাদা ফ্লোর দখল করেছিলেন তিনি। যুবলীগের বৈঠকের জন্য আনা নাস্তার সিঙ্গারা-সমুচার ভাগও দিতে হতো তাকে। যুথির অনুমতি ছাড়া কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারত না। এমনকি তার অনুমতি ছাড়া কেউ চেয়ারম্যানের সঙ্গেও দেখা করতে পারতেন না বলে এক যুবলীগ কর্মী জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যুবলীগের একটা নমিনেশন ফরমও তিনি বিনা পয়সায় দিতেন না, লাখ লাখ টাকায় একেকটা ফরম কিনতে হতো। যুথির কারণে গত ৫ বছরে একটা কমিটি তৈরি হয়নি। কারণ যারা কমিটির সদস্য হতে চাইবেন তাদের প্রত্যেককে লাখ লাখ টাকা দিতে হবে তাকে। টাকার নেশায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুবসংগঠন যুবলীগকে এক রকম ধ্বংস করে দিয়েছেন এই নারী। আর তার স্বামী শেখ পরশ চুপ থেকে নীরবে সব দেখে গেলেন।
নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগ চেয়ারম্যানের স্ত্রী যুথি বিভিন্ন সময় বলেছেন, ‘আমাকেই সব করতে হবে। কারণ সে (পরশ) কখনো নিজে কিছু (দুর্নীতি) করবে না।’ তার স্বামী কখনো অসদুপায়ে টাকা বানাবেন না বলেই তাকে খড়গ হাতে নামতে হয়েছে বলে ভাষ্য তার।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শেখ ফজলে শামস পরশ ২০১৯ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে তাকে কখনো রাজনীতির মাঠে দেখা যায়নি। তার বাবা শেখ ফজলুল হক মনি যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা বলে পরশকে এই সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পরশের চেয়ে বেশি বয়সী যুথি তার স্বামীর পদমর্যাদাকে শোষণ করেছেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, বহু জেলায় বহু বছর যুবলীগের সম্মেলন বা নতুন কমিটি না হওয়ায় সংগঠনটির শীর্ষ পদে থাকা অনেক নেতা আওয়ামী লীগের কমিটিতে চলে গেছেন। কেউ দেশের বাইরে চলে গেছেন এবং কেউ মারা গেছেন। দীর্ঘ সময়ে নতুন কমিটি গঠিত না হওয়ায় নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। নতুন কমিটি না হওয়ায় দলীয় কার্যক্রমেও স্থবিরতা ছিল। নতুন কমিটি দেওয়ার প্রক্রিয়া চললেই নানাভাবে আটকে দিতেন যুথি। সময় হয়নি এখন কমিটি গঠনের, যুবলীগ চেয়ারম্যানকে বোঝাতেন তার স্ত্রী।
ক্লিন ইমেজের পরশ যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই যুথি খোঁজ নেওয়া শুরু করেন কার কাছে কত টাকা আছে আর কাকে দিয়ে কী করানো যেতে পারে। তার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন বেশ কয়েকজন। বিভিন্ন জেলা-উপজেলার যুবলীগের নেতাকর্মীদের ঢাকায় এনে ডোনেশন নেওয়ার ব্যবস্থা করাই ছিল এজেন্টদের কাজ। যুবলীগের কমিটিতে নাম রাখার আশ্বাস দিয়ে অনেকের কাছে থেকেই ঘুষ নিতে যুথি। টাকা নিয়ে কাঙ্ক্ষিত পদ না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কোনো পদের জন্য যে বেশি টাকা দিতেন তিনিই পেতেন কাঙ্ক্ষিত পদ। টাকা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত পদ না পেলেও ‘টুঁ-শব্দ’ করার সাহস ছিল না কারও। প্রশ্ন করলেও গালি-হুমকি দিতেন যুবলীগ চেয়ারম্যানের স্ত্রী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানান, যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেসের পরে ঢাকা মহানগরের উত্তর-দক্ষিণে কমিটি গঠনের সময় নানাভাবে ব্যাঘাত ঘটান যুথি। মহানগরের অনেক নেতার কাছ থেকে পদের লোভ দেখিয়ে ঘুষ নিয়েছেন তিনি। মহানগর যুবলীগের বড় বড় নেতাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি পর্যন্ত দিতেন। অঙ্গ-সংগঠনটিকে যুথির চাকর সংগঠনে পরিণত করেছিলেন।
সুপ্রীম কোটের ইতিহাসে ‘কলঙ্কজনক অধ্যায়’
প্রভাব খাটিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং গায়ের জোরে নাহিদ সুলতানা যুথি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সালের নির্বাচনে সম্পাদক পদে বিজয়ী হতে চেয়েছিলেন। সমিতির নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্যানেল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।
নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য যুবলীগ নেতাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করেন যুথী। এক যুবলীগ কর্মী বলেন, ‘তিনি হুমকি দিয়েছিলেন, যদি আমরা তার পক্ষে কাজ না করি তাহলে আমাদের আর যুবলীগে থাকতে দেওয়া হবে না। যেকোনো ভাবে তাকে জয়ী করানোর ব্যবস্থা করতে হুকুম দেন নেতাকর্মীদের।’
যুবলীগ নেতাকর্মীদের তিনি বলেছেন, আইনজীবীদের মতো ইউনিফর্ম পরে নির্বাচনের দুদিন তাদেরকে মাঠে থাকতে হবে। যুথির দলবল তার নির্দেশে এবং প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির নিচ তলার শহিদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে অস্ত্র হাতে জোরপূর্বক বেআইনিভাবে প্রবেশ করেন। সে সময় তারা অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং নির্বাচন সাব-কমিটির সদস্যদের ওপর লোহার রড দিয়ে হামলা করেন।
যুথির সহযোগিরা কাঠের লাঠি, কাঠের ও প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে অতর্কিতভাবে এলোপাথাড়ি মারধর করেন, কাপড় ছিঁড়ে ফেলেন এবং গলা চেপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার চেষ্টা করেন। ফলে নির্বাচনী দায়িত্বরত সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভণ্ডুল হয়ে যায়।
একপর্যায়ে যুথি নিজে অস্ত্রের মুখে নির্বাচন সাব-কমিটির প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবুল খায়েরকে ভোট গণনা ছাড়াই সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করার জন্য বাধ্য করেন। পরে গত ৮ মার্চ রাতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই দিনব্যাপী নির্বাচনে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে হট্টগোল, হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুর রহমান চৌধুরী সাইফ বাদী হয়ে তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে এ মামলা করেন।
এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় শুধু আদালত অঙ্গন নয়, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডও ব্রিবত ও চরম ক্ষুব্ধ হয় বলে জানা গেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনার তদন্ত করে সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন। পরে ৮ মার্চ রাতেই যুথির গুলশানের বাসায় অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সেখান থেকে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও যুথিকে বাসায় পাওয়া যায়নি বলে ডিবি জানায়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল আইনজীবী যুথির। যার ফলে তিনি বাসায় থেকেও গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। কিন্তু ডিবি জানিয়েছে, অভিযানের সময় পালিয়ে গিয়েছিলেন যুথি।
পরে গত ১২ মে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে মুচলেকায় জামিন পান তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনার মেয়ে অ্যাডভোকেট যুথির স্থানীয়ভাবে তেমন কোনো প্রভাব নেই। তার বাবা অধ্যাপক আবু সাঈদেরও কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যুথি রাজধানীতে বসবাস শুরু করেন।
খোঁজ নিয়ে ইত্তেফাক জানতে পারে, পাবনায় বাবার বাড়ি থাকলেও যুথি বড় হন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় তার নানা বাড়িতে। সেখানে অন্যের জমি ভয়ভীতি দেখিয়ে দখল করেন। যুবলীগের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে উল্লাপাড়ায় তৈরি করেন বিলাসবহুল বাড়ি। সরকার পতনের পর সেই বাড়িতে সাধারণ মানুষ আগুন দেয়-ভাঙচুর করে।
সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাইয়ের শুরুর দিকে যুথি কানাডায় যান। সেখান থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে বা পরে কোনো এক সময় শেখ পরশও ভারতে চলে যান। খুব শিগগির যুথি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে স্বামীর কাছে যাবেন। পরে শেখ পরশকে সঙ্গে নিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে তার।
নাহিদ সুলতানা যুথির উত্থান ও পতন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এক নজিরবিহীন ঘটনা। তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীর দাগ ফেলেছে বলে মন্তব্য করেছেন যুবলীগের ভুক্তভোগী নেতাদের অনেকে। সূত্র: ইত্তেফাক
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।