কঙ্গনার 'ইমার্জেন্সি' ছবিটি ঘিরে বাংলাদেশে বিতর্ক কেন?

রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারী ২০২৫, ১৬:৩২

ছবি: সংগৃহীত

ভারতে বলিউডের একটি বাণিজ্যিক সিনেমাকে ঘিরে বিশ্বের অন্তত দুই প্রান্তে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে – তাও আবার আলাদা আলাদা কারণে – এমন ঘটনা শেষ কবে ঘটেছে বলা মুশকিল। বিজেপি এমপি তথা বলিউড তারকা কঙ্গনা রানাওয়াতের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'ইমার্জেন্সি' কিন্তু আপাতত সেই বিরল 'কৃতিত্বে'রই দাবিদার!

'ইমার্জেন্সি' হল আসলে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি আংশিক বায়োপিক, যা তৈরি হয়েছে ১৯৭৫ সালে দেশে তার জারি করা জরুরি অবস্থা বা ইমার্জেন্সির পটভূমিতে। ছবিটির কাহিনিকার, পরিচালক ও অন্যতম প্রযোজক কঙ্গনা রানাওয়াত নিজেই। ছবিতে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন তিনি।

তবে ইমার্জেন্সি ছাড়াও এই 'পলিটিক্যাল ড্রামা'তে ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের আরও বহু ঘটনাই চিত্রায়িত হয়েছে, যার মধ্যে তার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে ঘটা ১৯৭১-র যুদ্ধ কিংবা ১৯৮৪-তে স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সেনার 'অপারেশন ব্লু স্টারে'র প্রসঙ্গও এসেছে।

ছবিটিকে ঘিরে আন্তর্জাতিক স্তরে বিতর্কের সূত্রপাতও সেখানেই। দেশের ভিতরেও এই ছবিটিকে নিয়ে নানা রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে এবং সে কারণে ছবিটির মুক্তিও বারবার বিলম্বিত হয়েছে, তবে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।

ব্রিটেনের বিভিন্ন শিখ গোষ্ঠী দাবি করছে, এই ছবিতে খালিস্তানি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নায়ক জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের মুখে এমন সংলাপ বসানো হয়েছে, যা তিনি কখনও বলেনইনি।

ব্রিটেনের বিভিন্ন সিনেমা হলে 'ইমার্জেন্সি' ছবির স্ক্রিনিং-য়ের বিরুদ্ধে এই গোষ্ঠীগুলো তীব্র বিক্ষোভ দেখিয়েছে – অন্তত দু'টি সিনেমা হল চেইন তাদের দাবির মুখে ছবিটি প্রত্যাহার করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ব্রিটেনের একজন প্রভাবশালী এমপি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, ভারত সরকারও আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে যে এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন।

বাংলাদেশে এই ছবিটিকে নিয়ে বিতর্কের কারণও সিনেমায় শেখ মুজিবর রহমানের মুখে কিছু 'বিতর্কিত' সংলাপ। বাংলাদেশে যদিও 'ইমার্জেন্সি' বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায়নি, তারপরও ছবিতে শেখ মুজিবকে চিত্রায়িত করা হয়েছে এমন কিছু অংশের ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে এবং সেখানেও অনেকেই তা নিয়ে তর্কবিতর্কে মেতেছেন।

তবে 'ইমার্জেন্সি' নিয়ে বাংলাদেশে যাবতীয় বিতর্ক অবশ্য এখনও সোশ্যাল মিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ, ব্রিটেনের মতো তা রাস্তায় নামেনি। কিন্তু 'ইমার্জেন্সি' ছবিতে শেখ মুজিবুর রহমান বা জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের মুখে ঠিক কী শোনা গেছে – যা নিয়ে এই বিতর্কের অবতারণা?

মুজিবের কণ্ঠে ভারতমাতার বন্দনা

'ইমার্জেন্সি' ছবিতে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কলকাতার অভিনেতা ঋষি কৌশিক। সিনেমার একটি অংশে নদীর ধারে বিরাট জনতার সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে তাকে বলতে শোনা যায়, "ভারতমাতা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন।"

"আজ আমরা শপথ নিচ্ছি, যতদিন এখানে ব্রহ্মপুত্রের পানি বইবে, যতদিন আমরা বাংলা বলব, ততদিন আমরা ভারতমাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করে যাব।"

তার পরেই সিনেমায় তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন, "এত জোরে আপনারা ইন্দিরা গান্ধীর নামে জয়ধ্বনি দিন, যাতে তার রেশ দিল্লি পর্যন্ত শোনা যায়!"

"জয় মা ইন্দিরা, জয় বাংলা" স্লোগানে এরপর মুখরিত হয়ে ওঠে ব্রহ্মপুত্রর তীর। একাত্তরে যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি – ভারত তাতে কতটা কৃতিত্ব দাবি করতে পারে, অথবা একাত্তরকে একটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা কতটা সঙ্গত – সেটি বাংলাদেশে যথারীতি একটি স্পর্শকাতর বিতর্কের ইস্যু।

সেই জায়গায় যদি একটি ভারতীয় সিনেমায় শেখ মুজিবকেও বলতে শোনা যায় 'ভারতমাতা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন' – তাহলে বাংলাদেশে তার সামাজিক বা রাজনৈতিক অভিঘাত সুতীব্র হতে বাধ্য। ইমার্জেন্সিতে শেখ মুজিবের সেই বক্তব্যের ক্লিপ বাংলাদেশে ভাইরাল হতেই সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রতিক্রিয়াতেও সেটা স্পষ্ট।

সোয়েব মাহমুদ নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করে যেমন লিখেছেন, "প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রোপাগাণ্ডার সিনেমা – ইমার্জেন্সি-তে শেখ মুজিব। পলাতক লীগের ইতিহাসবিদদের মন্তব্য আশা করছি।"

একই ভিডিও পোস্ট করে এম এইচ রনির মন্তব্য, "কঙ্গনা তার ইমার্জেন্সি মুভিতে শেখ মুজিবকে এত অপদস্থ করলো কিন্তু এটা নিয়ে জাতির আব্বার একনিষ্ঠ সন্তানদের প্রতিবাদ করতে দেখলাম না।"

ছবিটিতে ১৯৭৫র ১৫ই অগাস্ট (ভারতে তখন জরুরি অবস্থা চলছে) শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের যে রেফারেন্স এসেছে, সেই প্রসঙ্গে সাইফুল ইসলাম নামে আরেকজন লিখেছেন, "ইমার্জেন্সি মুভিতে শেখ মুজিবকে যেভাবে উপস্থাপন করেছে এইটা শেখ মুজিবের সাথে বিগেস্ট মকারি (প্রহসন)। শেখ মুজিবের হত্যাকারী পর্যন্ত কোনও দিন বলে নাই যে পলাইতে গিয়া গুলি খাইছে।"

"অথচ লীগের বন্ধু বিজেপির কর্মী কঙ্গনা রানাওয়াত দিদির ইমার্জেন্সি মুভিতে দেখাইছে কাপুরুষের মত মুজিব দৌড়াতে গিয়ে গুলি খাইছে!"

প্যারিসে বসবাসকারী বাংলাদেশি রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য তার ইউটিউব চ্যানেলে ইমার্জেন্সি ছবির ওই ক্লিপটি দেখিয়ে বলেছেন, "এটা যে কত বড় ড্যামেজিং (ক্ষতিকর) ইন্ডিয়ার জন্য এবং মুজিবের জন্যও – এটা বোঝার মতো বুদ্ধিও ইন্ডিয়ার নাই!"

বলিউডে এর আগের আরও অনেক ছবির মতো 'ইমার্জেন্সি'ও যে একাত্তর নিয়ে ইতিহাস চেতনা এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশের সংবেদনশীলতার কোনও ধার ধারেনি – তা বোধহয় এই সব প্রতিক্রিয়া থেকেই পরিষ্কার।

'খালিস্তান-পন্থী বিভিন্ন শক্তি' যেভাবে যুক্তরাজ্যে 'ইমার্জেন্সি' ছবির স্ক্রিনিংয়ে বাধা দিচ্ছে, গত শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) ভারত সরকার সেই ঘটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ভারত আশা করবে এই সব ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

"ভারত-বিরোধী শক্তিগুলোর এই ধরনের সহিংস প্রতিবাদ বা ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে আমরা সব সময় যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের উদ্বেগ জানিয়ে থাকি", বলেন মি জয়সওয়াল।

তিনি আরও বলেন, "মত ও বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা কখনও 'সিলেক্টিভ' (বাছাই করে প্রয়োগ) হতে পারে না। ফলে যারা এই (সিনেমাটির প্রদর্শনে) বাধা দিচ্ছে, আশা করব যুক্তরাজ্যর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।"

এর আগে বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ শিখ গোষ্ঠী এই 'ইমার্জেন্সি' ছবিটি সে দেশের সিনেমা হলগুলোতে দেখানোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে আসছিল। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তারা এই ছবিটির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালায়।

শিখ প্রেস অ্যাসোসিয়েশন যেমন বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করে, কঙ্গনা রানাওয়াতের 'ইমার্জেন্সি' একটি 'অ্যান্টি-শিখ' ছবি। তাদের হুমকির মুখে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস অঞ্চলের দু'টি বড় শহর – বার্মিংহাম ও উলভারহ্যাম্পটনে ছবিটির স্ক্রিনিং বাতিল করতে হয়।

'ইনসাইট ইউকে' নামে ব্রিটেনের একটি কমিউনিটি চ্যানেলের এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করা ভিডিওতেও দেখা যায়, মুখোশ-পরা বিক্ষোভকারীরা লন্ডনের একটি সিনেমা হলে ইমার্জেন্সি ছবিটির প্রদর্শনে বাধা দিচ্ছে ও ভাঙচুর চালাচ্ছে।

এই ছবিটির বিরুদ্ধে শিখ গোষ্ঠীগুলির মূল অভিযোগ, এটিতে খালিস্তানপন্থী নেতা জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালেকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

গত বছর যখন 'ইমার্জেন্সি'র ট্রেলার মুক্তি পায়, তখনই সেটিতে সিনেমার ভিন্দ্রানওয়ালেকে ইন্দিরা গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা গিয়েছিল, "আপনার দল ভোট চায়, আমরা চাই খালিস্তান।"

আপাতদৃষ্টিতে ছবির এই সংলাপটিই শিখ গোষ্ঠীগুলোকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে, কারণ তাদের বক্তব্য ভিন্দ্রানওয়ালে তারা সারা জীবনে কখনও এমন দাবি জানাননি।

এদিকে যুক্তরাজ্যের একজন কনজার্ভেটিভ পার্টির এমপি বব ব্ল্যাকম্যানও সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে অভিযোগ করেছেন, তার কেন্দ্রের কয়েকজন ভোটারকে সিনেমা হলে এই ছবিটি দেখার সময় 'মুখোশধারী প্রতিবাদকারী'রা হুমকি দিয়েছে।

তিনি বিষয়টিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইভেট কুপারের হস্তক্ষেপও চেয়েছেন। লন্ডনের হ্যারো ইস্ট আসনের এমপি বব ব্ল্যাকম্যান হাউস অব কমন্সেও জানান, এই 'অতি বিতর্কিত' সিনেমাটির বিরুদ্ধে একই ধরনের প্রতিবাদ দেখা গেছে উলভারহ্যাম্পটন, বার্মিংহাম, স্লাও, স্টেইনস, ম্যানচেস্টার-সহ ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে।

এর জেরেই ভিউ বা সিনেওয়ার্ল্ডের মতো সুপরিচিত সিনেমা চেইন তাদের বহু থিয়েটার থেকে ছবিটি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বব ব্ল্যাকম্যান অবশ্য সেই সঙ্গেই যোগ করেছেন, "এই সিনেমাটি অবশ্য খুবই বিতর্কিত, আমি এর গুণগত মান বা বিষয়বস্তু নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।"

"কিন্তু আমার কেন্দ্রের ভোটারদের ও আমার সতীর্থ এমপি-দের ভোটারদের পূর্ণ অধিকার আছে এই সিনেমাটি দেখে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার, আমি সেই অধিকারের পক্ষে কথা বলতে চাই!" সূত্র: বিবিসি বাংলা




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top