আগুনের লেলিহান শিখায় ইন্ধন ধনীদেশের
জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশ, উত্তরণের উপায় কী?
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:০২
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি
‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবে তার আকুতির কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি সভ্যতাকে বলছেন, তাকে যেনো সেই ‘তপোবন’ ফিরিয়ে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে ফিরিয়ে নেয়া হয় ‘লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর’।
পৃথিবী নামের প্রিয় গ্রহটি আজ চরম ক্ষতির সম্মুখীন। এক সময় বন-জঙ্গল ছিল প্রচুর আর প্রকৃতিতে ছিল মনোমুগ্ধকর হিমেল বাতাস। এখন কড়া রোদের তেজ আর দিনভর সূর্যের দহন। প্রচন্ড খরতাপে কোথাও নেই একটু ঠান্ডা বাতাস। লোহা পুড়ানোর মত গরমে নদ-নদী, খাল-বিল সব শুকিয়ে যাচ্ছে। পানি আসছে না নলকূপে আর সময় মতো বৃষ্টিও হচ্ছে না। চারদিকে দাবদাহে প্রাণীকুলের হাঁসফাঁস। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু-বৃদ্ধ-শ্রমজীবী মানুষ। বজ্রপাতেও মৃতের সংখ্যা কম নয়। সব কিছুই যেন উলট-পালট।
অনেক বছর আগের কথা:
এক মিলিয়ন বছর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কয়েকটি বরফ ও উষ্ণ যুগ এসেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন সমীক্ষা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর অবদান রয়েছে। পৃথিবীর তাপমাত্রার চড়াই-উতরাইয়ে অতীতে যেমন মুখ্য নিয়ামক ছিল কার্বন ডাই-অক্সাইড, ভবিষ্যতেও তেমন থাকবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বরফ ও উষ্ণ যুগ অতীতেও ছিল, তাহলে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন কেন এত আলোচিত? একমাত্র কারণ, অতীতের জলবায়ুর পরিবর্তনগুলো ছিল প্রাকৃতিক। আর এখন মানবসৃষ্ট। যেমন নগরায়ণের হার, কলকারখানার পরিমাণ, বনভূমি উজাড় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে। এতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে।
প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ুতে স্বাভাবিকভাবেই কিছু পরিবর্তন হয়। কিন্তু যে মাত্রায় তাপমাত্রা বাড়ছে তার জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী। মানুষ যখন থেকে কল-কারখানা-যানবাহন চালানো কিংবা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়াতে শুরু করলো সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ উনবিংশ শতকের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। ফলে সেই গাছ যখন কাটা হয় বা পোড়ানো হয়, সঞ্চিত সেই কার্বন বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর প্রভাব :
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে নিকট ভবিষ্যতে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে পৃথিবী। কারণ, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার বৃদ্ধি বায়ুমণ্ডলের উচ্চ ও নিম্নস্তরে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াবে। আর তাই আর্দ্র অঞ্চল আর্দ্রতর ও শুষ্ক অঞ্চল শুষ্কতর হবে। ফলে মানুষের জীবনধারণ বা টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে উঠবে।
জলবায়ু পরিবর্তন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি। এটা শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়; এটি আমাদের কল্যাণ, অর্থনীতি এবং আমাদের গ্রহের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিণতিগুলোর মধ্যে একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ বৃদ্ধি, যার মধ্যে রয়েছে সাইক্নেন, বন্যা, হারিকেন, দাবানল এবং তাপপ্রবাহ।
রয়েছে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক ঋতু পরিবর্তন, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, উপকূলীয় এলাকায় বন্যা এবং খরা সমস্যা। এই বিপর্যয়গুলো কেবল বিশাল মানবিক দুর্ভোগের কারণই নয় বরং প্রতি বছর বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে।
বদলে যাচ্ছে ভালোবাসার দুনিয়া:
পৃথিবী গরম হয়ে পড়ছে এবং দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার চেনাজানা আচরণ। তাপমাত্রা বাড়ায় উত্তর মেরুর জমাট বাধা বরফ এবং হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। ফলে সাগরের উচ্চতা বেড়ে উপকুলের নিচু এলাকাগুলো ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
সাইবেরিয়ার মত অঞ্চলে মাটিতে জমে থাকা বরফ গলতে থাকায় বরফের নিচে আটকে থাকা মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে, মিথেনের মত আরেকটি গ্রিনহাউজ গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। পৃথিবীর উষ্ণতা তাতে আরো বাড়বে এবং বন-জঙ্গলে আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়বে।
জাতিসংঘের একটি বিজ্ঞানী প্যানেল হুঁশিয়ার করেছে- মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত সাগর-পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। সেই সাথে জীবজন্তুর বিভিন্ন প্রজাতি তাদের আবাসস্থল বদলাচ্ছে।
কিন্তু জলবায়ুর এই পরিবর্তন এত দ্রুত হারে এখন ঘটছে যে অনেক প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ার কারণে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি দিনকে দিন বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে।
আগেই আলোচনা হয়েছে, বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ কমার পরিবর্তে বাড়ছে। ফলে হিমালয়ের হিমবাহ ও গ্রিনল্যান্ডের বরফের আচ্ছাদন দ্রুত কমছে। হিমবাহের বরফ গলার তীব্রতা বাড়লে আমাদের মতো নিম্নভূমির ভূখণ্ডের জন্য নানা ধরনের হুমকি রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র সমতল বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি ও দাবদাহ আরও বাড়বে।
গ্রীন হাউজ ও জলবায়ু পরিবর্তন কী:
কোনও একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড়-পড়তা ধরন, তাকেই বলা হয় জলবায়ু। আর জলবায়ু পরিবর্তন বলতে বুঝায় ৩০ বছর বা তার বেশি সময়ে কোনো জায়গার গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদী ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন।
বায়ুমন্ডলে বিরাজমান জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস, ওজোন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনকে গ্রীন হাউজ বলা হয়। বায়ুমন্ডলের উপরিস্থিত স্তরের সর্বপ্রথম উপাদান হচ্ছে ওজোনস্তর। যা পৃথিবীকে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি বিকিরণ থেকে রক্ষা করে।
ভূ-গর্ভস্ত জ্বালানী, দাবানল, মানুষ ও অন্যান্য জীব জন্তুর নিঃশ্বাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, পশু পালন, আবর্জনা, শোধণপ্রণালী, গ্যাস বিতরণ লাইনের ছিদ্র, শিল্প কারখানা, ইট ভাটার ধৌঁয়া ও যানবাহনের ব্যবহৃত জ্বালানী তেলের দহনে নাইট্রাস অক্সাইড, রেফ্রিজারেটর, শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, এরোসেল ব্যবহারে ক্লোরোফ্লোরো অক্সাইড এবং দহন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মিথেন গ্যাসে ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কেন হয় জলবায়ু পরিবর্তন:
অনেকগুলো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর জলবায়ুর পরিবর্তন নির্ভর করে। যে সকল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া, সৌর বিকিরণের মাত্রা, পৃথিবীর অক্ষরেখার দিক-পরিবর্তন কিংবা সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান।
বর্তমান সময়ে মনুষ্যজনিত গ্রিনহাউজ গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়। যেটি কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধিতে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ধরা হয়। আর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রাথমিকভাবে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন দ্বারা চালিত হয়। এই গ্যাসগুলো তাপকে আটকে রাখে, ফলে বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ, আমরা বিভিন্ন পরিবেশগত পরিবর্তনের হুমকির মুখে থাকি।
জলবায়ু পরিবর্তনের মানদণ্ড বিবেচনা:
জলবায়ু পরিবর্তন ও তার কুফল নিয়ে বিশ্বের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কমতি নেই। কোনো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই পড়ছে কি না, তা চারটি মানদন্ডে বিবেচনা করা হয়। সেগুলো হলো- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, কোথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা কোথায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি ক্ষতি মোকাবিলায় বা অভিযোজনের জন্য এরই মধ্যে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশে একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি। তাই চারটি মানদন্ডেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় শীর্ষে।
বিজ্ঞানীদের হুঁশিয়ারি ও সতর্ক বার্তা:
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে তার নজির বিগত একশ বছরের মধ্যে ঘটেনি। এবছরের গ্রিষ্ম ছিল সবচেয়ে বেশি উষ্ণ। দাবানল, বন্যা, খরা, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারকীয় দৃশ্যের তৈরি করে।
তারা বলছেন, এসবের পেছনে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা রয়েছে, তেমনি এল নিনোর কারণেও তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমা অতিক্রম করেছে। এ বছর বিশ্ব প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হচ্ছে। এটা এখন প্রমাণিত যে মানবসৃষ্ট কার্যকলাপ যেমন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, কৃষি, দূষণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধানত দায়ী।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের কার্যকলাপের ফল, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটাতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে সতর্ক করেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখনই কমানো না গেলে খুব শিগগির বিশ্ববাসীকে গুরুতর পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তারা বলছেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে বদলে যাবে জীবন যাপন। পানির সঙ্কট তৈরি হবে আর খাদ্য উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়বে। কোনো কোনো অঞ্চল বিপজ্জনক মাত্রায় গরম হয়ে পড়বে। সেই সাথে সমুদ্রের পানি বেড়ে বহু এলাকা প্লাবিত হবে। ফলে সে সব জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
অতিরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারি বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে জীবন এবং জীবিকা হুমকিতে পড়বে। গরীব দেশগুলোতে এসব বিপদ মোকাবেলার সক্ষমতা কম বলে তাদের ওপর এই চরম আবহাওয়ার ধাক্কা পড়বে সবচেয়ে বেশি।
লিখেছেন রায়হান রাজীব
জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী কারা:
জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা এখন বিশেষ কোনো দেশ বা জনগোষ্ঠীর নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের দেশে দেশে পরিবেশদূষণ, নতুন নতুন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার আবির্ভাব, সামুদ্রিক প্রাণীর খাদ্য সংকট, উদ্ভিদের ক্ষতি সবকিছুই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ইকোসিস্টেমের ভারসাম্যহীনতার ফল।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মানুষই দায়ী। বনভূমি ধ্বংস, কার্বন ডাই-অক্সাইড বির্গমন, পরিবেশের প্রতি হুমকিস্বরুপ প্লাস্টিক ও পলিথিন সামগ্রী ব্যবহার, পানিতে আর্সেনিক বিষের মিশ্রণ, শব্দ দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মারণাস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে মানুষ নিজেই পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।
এর ফলে বিশ্বব্যপী সৌর তেজস্ক্রিয়তার দ্বারা উষ্ণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম বিরুপ প্রভাব হচ্ছে সমুদ্রে পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। গত ১০০ বছরে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার।
গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের পরিবেশবিরোধী নানারকম ক্রিয়াকলাপের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, মিথেন, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড গ্রিনহাউস গ্যাসের উপস্থিতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বায়ুমণ্ডলের নিচের স্তরে উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে তা প্রভাবিত করছে পৃথিবীর জলবায়ুকে।
স্বপ্নের বাংলাদেশ কতটুকু নিরাপদ:
বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিখরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, নদীভাঙন এবং জলাবদ্ধতা, পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি এক মূর্তিমান চ্যালেঞ্জ। এ জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ সমতল ও নিচু ভূমি এলাকা নিয়ে গঠিত।
বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ কমছে বাংলাদেশে। অনেক প্রজাতিই হারিয়ে যেতে বসেছে। গাছ, মাছ, পাখি, ফুল, ফল সবকিছুতেই এই প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। শ্বাসকষ্ট, হিটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যু কিংবা তীব্র ঠান্ডাজনিত মৃত্যু খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হবে এবং প্রায় তিন কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন কিছু কিছু অঞ্চলের আবহাওয়ার সঙ্কটময় অবস্থাকে আমরা যে বদ্বীপে আছি এবং সমুদ্রের সঙ্গে যে সম্পর্ক, তাতে আমরা খুব নাজুক পরিস্থিতিতে আছি।
আইপিসিসির প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৭ থেকে ২০ শতাংশ জমি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়, তাতে প্রায় ২ কোটি মানুষের জলবায়ু উদ্বাস্তু হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ফলে অনুমান করতে পারি, এত ছোট দেশে যদি ২০ শতাংশ জমি সমুদ্রে চলে যায় এবং যদি প্রায় ২ কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়, তাহলে তাদেরকে দেশের মধ্যে অন্যত্র স্থানান্তরের সুযোগ নেই। এতে শহর এলাকায় জনসংখ্যার চাপ আরও বাড়বে।
নদীভাঙন, উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি বা অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে দেশে সামনের দিনগুলোতে গ্রাম থেকে শহরে অভিগমনের হার বাড়বে, সেহেতু বড় বড় শহরের পাশাপাশি মাঝারি শহরগুলোতে জনসংখ্যার চাপ বাড়বে, ভেঙে পড়বে সমাজব্যবস্থা। এতে সামাজিক অস্থিরতা প্রকট আকার ধারণ করবে।
কৃষিজমির হ্রাস, জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস দ্রুত নগরায়ণের ফসল। গত ২০ বছরে বেড়েছে নগরের উষ্ণতা, নগরগুলোর মাইক্রোক্লাইমেট দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্ব, জলবায়ু-অসংবেদনশীল বিল্ডিং উপাদান, চরম মনুষ্য কর্মকাণ্ড এবং সবুজের অস্বাভাবিক অভাব দেশের নগরগুলোর উষ্ণতা বৃদ্ধির মূল কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে করণীয়:
বনভূমি বা বৃক্ষ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত আমাজনের চিরহরিৎ বন থেকে। তার থেকেও বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় এই বনভূমি। প্রায় ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশাল এই বনাঞ্চল।
তাই যত বেশি সম্ভব সবাইকে গাছ রোপন করতে হবে। বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করতে হবে এবং বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সাইকেল বা জনপরিবহনের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। তাছাড়া বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহারও জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে মানুষকে সজাগ ও সচেতন করতে হবে। কলকারখানায় কালো ধোঁয়া নির্গমন কমিয়ে আনতে হবে। সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সন্ধান করতে হবে। প্রকৃতির ওপর মানুষের বিরূপ আচরণ বন্ধ করতে হবে।
বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরিতে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ খুবই জরুরি। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ এবং বিষাক্ত বিভিন্ন পদার্থ বাতাসে মিশে দেশের সামগ্রিক আবহাওয়ায় পরিবর্তন আনছে। বিশ্বের উষ্ণতা যতই বাড়ছে হিমালয় ততই গলছে। অতিরিক্ত উষ্ণতার কারণে ঋতুতেও হেরফের দেখা দিচ্ছে। অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা হানা দিচ্ছে। সাগরে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন ঘূর্ণিঝড়। যা বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে সক্ষম।
জলবায়ু পরিবর্তন এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় হুমকি। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আরও বিধ্বংসী প্রভাব পড়বে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইতোমধ্যে এর ভয়াবহতা প্রমাণ করেছে। সুতরাং মানবজাতিসহ অন্যান্য প্রাণীর স্বার্থে আমাদের ভালোবাসার গ্রহকে রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
ধনী দেশগুলোর ভোগবাদি মানসিকতা ও আচরণের নির্মম শিকার হচ্ছে, বাংলাদেশের মত দেশগুলো। ফলে অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো, একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা, পরিবেশ বান্ধব কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পরিচ্ছন্ন বায়ু নিশ্চিত করা, পৃথিবীর ক্ষতি না করে সমৃদ্ধি বাড়ানো সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরণের বিপদ এড়ানো যাবে। তা না পারলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন।
জলবায়ু পরিবর্তনে নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ও সক্ষমতা তৈরিতে প্রয়োজন এ বিষয়ে আরও বিস্তর গবেষণা, সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষতি মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা। আর তাই কার্যকর ও ফলপ্রসূ পথনকশার বিকল্প অন্য কী হতে পারে?
এখনই পদক্ষেপ গ্রহণের সময় – আমরা যদি পরিবেশ, পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করি, তাহলে পরিবর্তনশীল জলবায়ু এবং অবনতিশীল পরিবেশের প্রভাব থেকে ভবিষ্যতকে রক্ষা করতে পারি। সবশেষে কবিগুরুর কবিতা দিয়েই শেষ করি:
হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।
নিবন্ধটি কয়েকজন লেখক ও ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।