বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটছে যেসব কারণে

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০:০৮

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা ইসলামপন্থী দলগুলোর উত্থান ও শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়টি এখন আবার আলোচনায় এসেছে। ধর্মভিত্তিক ইস্যু ছাড়াও রাজনৈতিক অনেক বিষয় নিয়ে ইসলামপন্থী দলগুলোর একটা অবস্থান তৈরির চেষ্টা দৃশ্যমান হচ্ছে। ২০২০ সালের বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলোর উত্থানের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে - অনেকেই সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করছেন।

শূণ্যতার সুযোগ

ইসলামপন্থী দলগুলো জনগণের মাঝে ছোট পরিসরে হলেও একটা নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে এবং এর ভিত্তিতেই দেশের প্রচলিত রাজনীতিতে তাদের একটা প্রভাব তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকে মনে করেন।

অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেন, দেশে রাজনৈতিক শূণ্যতার সুযোগ নিয়ে কট্টর ডানপন্থার উত্থান হচ্ছে। "বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক শূণ্যতা চলছে, সেটা সবাই জানেন," বলছেন তিনি, "যেখানেই রাজনৈতিক শূণ্যতা তৈরি হয়, সেখানেই উগ্রপন্থীদের উত্থান ঘটে, সেটা ডানপন্থী বলেন কিংবা বামপন্থী বলেন।"

"বাংলাদেশে বামপন্থীদের তো সেরকম তৎপরতা নাই। এই ডানপন্থীদেরই তৎপরতা বেশি আছে গ্রামপর্যায়ে। সুতরাং ডানপন্থীরা শূণ্যতা পূরণের চেষ্টা করবে, তা স্বাভাবিক। এবং সেটাই তারা করছে। সেজন্য এরা শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়, অনেক রাজনৈতিক বিষয়েও বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছে।"

রাজনৈতিক শূণ্যতার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলেছ। এর জেরে বিরোধী শিবিরের দূর্বলতা দৃশ্যমান। ইসলামপন্থী দলগুলো সেই শূণ্যতার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে বলে তারা মনে করেন।

শূণ্যতার ইস্যু: বড় দুই দল

কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি রাজনৈতিক শূণ্যতার বিষয়কে ব্যাখ্যা করেছে তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণেই উগ্রতা মাথা চাড়া দিচ্ছে।

"এখানে এখন কথা বলার বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। ভিন্নমত হলেই তাকে নির্যাতন বা দমন করা হচ্ছে," বলেন মি. আলমগীর, "এই অবস্থা তৈরি করেছে সরকার। সরকারই সমাজকে সেদিকে ঠেলে দিচ্ছে।" তবে আওয়ামীলীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম সদস্য অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল ফারুক খান মনে করেন, দেশে কোন রাজনৈতিক শূণ্যতা নেই এবং ইসলামপন্থীদের কোন উত্থান তারা দেখছেন না।

জামায়াতের জায়গা নেবে তারা?

অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর শূণ্য জায়গাও নেয়ার চেষ্টা করছে ইসলামপন্থী অন্য দলগুলো। "ধর্ম নিয়ে রাজনীতিতে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক এবং পীরদের দলগুলোর মুল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জামায়াতে ইসলামী। সেখানে জামায়াতের প্রকাশ্য তৎপরতা যেহেতু নাই, সেই খালি জায়গাও ইসলামী অন্য দলগুলো নেয়ার চেষ্টা করছে।"

বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা বলেছেন, জামায়তে ইসলামীই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব ছিল। সেই অবস্থান কোনো মেরুকরণের দিকে এগুচ্ছে কিনা- সেটা বিএনপি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। যদিও জামায়াতের নেতারা তাদের দূর্বলতা মানতে রাজি নন। তবে অন্য দলের তৎপরতার বিষয়েও তাদের কোন বক্তব্য নেই।

জোট ও ভোটের রাজনীতি

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-দুই দলের নেতারাই মনে করেন, ২০০১ সালের নির্বাচন থেকে ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতির প্রবণতা। জোটের রাজনীতি মেরুকরণ হয়ে আসছে দুই দলের নেতৃত্বেই। আর দুই দলই ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সাথে রাখার চেষ্টা করে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, এখন যেহেতু নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ এবং জোটের ব্যানার থাকলেও তৎপরতা নেই। সেজন্য ইসলামপন্থী দলগুলো নিজেরা একটা শক্তি হিসাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলে তারা মনে করেন।

তবে দুই জোটে থাকা ইসলামপন্থী কয়েকটি দলের নেতাদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, বড় দুই দলের জোট থেকে সহসাই বেরিয়ে আসার চিন্তা তাদের নেই। তারা মনে করেন, তাদের পৃথক অবস্থান নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য আরও সময় প্রয়োজন। তারা বলেছেন, তারা শক্তি সঞ্চয় করে জোটে থেকে বড় দলগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে এগুতে চাইছেন।

অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ

যদিও ইসলামপন্থীদের উত্থান হচ্ছে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন না। কিন্তু ইসলামপন্থী দলগুলো যে শক্তি সঞ্চয় করছে -সেটা আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেকে স্বীকার করেন। সেজন্য তারা বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। আর বিএনপির পাল্টা অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, "হেফাজতে ইসলামকে সরকার এবং আওয়ামী লীগই সবসময় সাহায্য-সহযোগিতা করেছে এবং প্রশ্রয় দিয়েছে। তবে যখনই গণতন্ত্র থাকে না বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না, তখনই এমন বিষয়গুলো তৎপর হয়।"

সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে যুক্তি দিতে গিয়ে মি. আলমগীর আরও বলেছেন, "ধর্ম বিশ্বাস করা আর ধর্মান্ধতাতো এক জিনিস নয়। এখানে ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। এটা সচেতনভাবে করা হচ্ছে কিনা - তা বলতে পারবো না। তবে বিএনপি যেহেতু গণতান্ত্রিক শক্তি, সেজন্য তাদের নির্মূল করার চেষ্টা চালানো হয়। কারণ কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে যদি উগ্র কোন শক্তি থাকে, তাহলে তাদের সুবিধা হয়। বিশ্বে যেহেতু সন্ত্রাস এবং উগ্রতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার বিষয় আছে, সেখানে তারা সুবিধা পেতে পারে।"

তবে আওয়ামী লীগ নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল ফারুক খান বলেছেন, "হেফাজতে ইসলাম কোন রাজনৈতিক দল নয়। মাদ্রাসার শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সময় হেফাজতের সাথে আমাদের আলোচনা হয়েছে। এখানে কোন রাজনীতি নেই।" "বিএনপিই উগ্রতাকে প্রশ্রয় দেয়" বলে তিনি অভিযোগ করেন।

আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব ইসলামপন্থীদলগুলোর সাথে কোন সংঘাতে যেতে চায় না। আর বিএনপির একাধিক সূত্র বলেছে, ইসলামপন্থীদের তৎপরতা বৃদ্ধির পেছনে সরকারের ভূমিকা কি আছে এবং পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, এগুলো দলটি পর্যবেক্ষণ করছে।

এদিকে নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে দাবি করলেও হেফাজতে ইসলাম যখন ২০১৩ সালের মে মাসে নাস্তিক ইস্যু তুলে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল, তখন বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকেই দলীয় নেতাকর্মীদের তাদের সহযোগিতা করার আহবান জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পর হেফাজতের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিল।এর পেছনে দুই দলেরই রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তা ছিল।

বিকল্প শক্তি হবে কি?

ইসলাম নিয়ে লেখক ও গবেষক ওসমান গণি বলেছেন, ইসলামপন্থী দলগুলো এখন বিএনপি বা অন্য কোন দলের বিকল্প হতে পারবে না। তিনি মনে করেন, ইসলামপন্থী দলগুলো ধর্মীয় ইস্যুতেই বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছে বা কথা বলছে।

"যেহেতু কোন ইস্যুতে কেউ যখন কথা বলছে না, তখন তুলনামূলক কম শক্তির বা তুলনামূলক কম সংগঠিত কেউ কথা বললেও তাতে জনসমর্থন চলে আসে। ইসলামপন্থী দলগুলোর ক্ষেত্রে এখন সেটাই হচ্ছে।

সেই দলগুলোর মূল্যায়ন

ইসলামপন্থী যে দলগুলো সাম্প্রতিক সময়ে নানা ইস্যুতে তৎপরতা চালাচ্ছে, এমন তিনটি দলের নেতারা বলেছেন, তারা শক্তি সঞ্চয় করছেন এবং সমাজে তাদের রাজনীতির প্রভাব পড়ছে বলে তারা মনে করেন।

তারা বলেছেন, তাদের একটা ভাল অবস্থান তৈরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। তারা এই অনুকুল পরিবেশ কাজে লাগিয়ে অবস্থান আরও শক্ত করার চেষ্টা করছেন বলে উল্লেখ করেন। তবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সহ সভাপতি আব্দুর রব ইউসুফী বলছেন, রাজনৈতিক শূণ্যতা এখন রয়েছে। কিন্তু তারা সেটার সুযোগ নিচ্ছেন না।

তিনি আরও বলেন, "ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে আমরা রাজনৈতিক ব্যানারে না করে বিভিন্ন সংগঠনের নামে কর্মসূচি পালন করি। রাজনৈতিক ইস্যুতে সরকার আমাদেরকেও বাধা দেয়। আর অরাজনৈতিক বিষয়ে সরকার বাধা না দেয়ায় আমরা সেটা ইতিবাচক মনে করি। তবে সরকার হয়তো ইসলামপন্থীদের সাথে কোন সংঘাতে যেতে চাচ্ছে না। সেটাও আমরা মনে করি।"

আরও দু'টি ইসলামপন্থী দলের দু'জন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্নভাবে। তারা বলেছেন, রাজনৈতিক শূণ্যতার বিষয় এখন এসেছে। কিন্তু এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে বলে তারা মনে করেন।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তারা বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের জন্য বাংলাদেশিদের যাওয়ার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ফলে ঐ দেশগুলোর সাথে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একটা প্রভাব একেবারে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাঝে পড়েছে। এছাড়া দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে ইসলামপন্থী দলগুলো সাধারণ মানুষের কাছে অবস্থান তৈরির সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটকেও তাদের শক্তি বৃদ্ধির পেছনে বড় কারণ হিসাবে দেখেন।

কীভাবে কর্মসূচি পালন করছে?

ইসলামপন্থী দলগুলোর নেতাদের অনেকেই হেফাজতে ইসলামের কমিটিতে আগেও ছিলেন এবং এখনও রয়েছেন। হেফাজত যেহেতু কওমী মাদ্রাসা-ভিত্তিক একটা বড় সংগঠন হিসাবে অনেক আগেই অবস্থান করেছে।

দলগুলোর নেতাদের অনেকে জানিয়েছেন, ধর্মীয় বড় কোন বিষয় এলে বা স্পর্শকাতর কোন কোন ইস্যুতে এই ইসলামপন্থী দলগুলো হেফাজতের ব্যানারে কর্মসূচি নিয়ে থাকে। এছাড়া ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠন আছে, সেগুলোর ব্যানারও ব্যবহার করা হয়। তাতে তাদের জোটবদ্ধ শক্তি প্রদর্শনের একটা সুযোগ তারা পান। তারা তাদের দলীয় ব্যানারে ধর্ম অবমাননার বিষয়গুলো নিয়ে তৎপরতা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন।

লেখক ওসমান গণি বলছেন, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন সংগঠন এবং ইসলামপন্থী দলগুলো তাদের কর্মসূচিতে জমায়েতের ক্ষেত্রে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ওপর নির্ভরশীল। 

সেটি স্বীকার করছেন ইসলামপন্থী নেতারা। একটি ইসলাপন্থী দলের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তাদের কর্মসূচিতে লোকসমাগমের জন্য তারা তাদের স্ব স্ব দল বা সংগঠনের সমর্থক মাদ্রাসার ওপর নির্ভর করেন। তবে কয়েক বছর ধরে জেলা-উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ে তাদের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে, এমন চিত্র তারা পাচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ডানপন্থীদের শক্তি বাড়ছে, সেটা অস্বীকার না করে বর্তমান বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বড় দলগুলোর উচিত নিজস্ব কৌশল ঠিক করা। সূত্র: ১৯ নভেম্বর ২০২০ লেখাটি প্রকাশ করে বিবিসি বাংলা (সংক্ষেপিত) 



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top