শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

দেশজুড়ে আন্দোলনের ডাক

চাকরি-বেতন নয়, কেবল সনদ চান শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২০ আগষ্ট ২০২৪, ২২:৩৯

ছবি: সংগৃহীত

বার কাউন্সিল পরীক্ষা বিড়ম্বনাঃ

দেশে আইনজীবী হওয়ার প্রক্রিয়া রুগ্‌ণ হয়ে পড়েছে। যেনো একটি নীরব নৈরাজ্য চলছে আইন অঙ্গনে। আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা ও খেয়ালিপনার যেন অন্ত নেই। বার কাউন্সিলের নিয়ম কী বলছে। সাধারণত কেউ যদি আইন পেশায় কর্মজীবন শুরু করতে চায়, তাহলে তাকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অধীনে এমসিকিউ (নৈবর্ত্তিক), রিটেন ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। পূর্বে কখনও শুধুমাত্র ভাইবা, কখনও লিখিত ও ভাইবা এবং বর্তমানে তিন ধাপেই শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ হতে হয়। কিন্তু আইনজীবীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় বার কাউন্সিল কৌশলের আশ্রয় নেয়।

আসে ২০১২ সাল। একটি কালাকানুনে স্বপ্নভঙ্গ হয় লাখো আইন শিক্ষার্থীর। সংশোধনীর মাধ্যমে আইনজীবী তালিকাভূক্তি (এনরোলমেন্ট) প্রক্রিয়ায় এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত হয়। আইন সংশোধন হওয়ার আগে কেবল লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে সনদ প্রদান করা হতো। সংস্থাটির আইন অনুযায়ী, প্রতি ৬ মাস পর বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা। কিন্তু নিয়ম না মেনে কৌশলগত বিলম্ব করা হয়।

বর্তমানে ২ থেকে ৩ বছরের ব্যবধানে একটি পরীক্ষার আয়োজন করছে সংস্থাটি। আবার পরীক্ষা নিলেও গড়িমসিতে তার সকল কার্যক্রম শেষ করতে দেড় থেকে ২ বছর কাটিয়ে দিচ্ছে। ফলে দীর্ঘদিন ঝুলন্ত প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা হতাশায় ডুব দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে আইন পেশাও তার আভিজাত্য হারাচ্ছে। আসলে এমসিকিউ পদ্ধতির একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সনদ লাভে আগ্রহীদের সংখ্যা কমানো।

জটিল তিন ধাপের পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে প্রতি পরীক্ষায় স্বল্প শতাংশও পাশ করতে পারেন না। গোলকধাঁধা প্রশ্নমালায় কেউ প্রিলিতে কৃতকার্য হলেও লিখিততে আটকে যাচ্ছেন। আবার কেউ দুটিতে ভালো করেও আটকে যাচ্ছেন ভাইভাতে। প্রিলি পরীক্ষায় শুধু কৌশলের কাছে হেরে গিয়ে আইনজীবীর তালিকায় নাম লেখাতে পারছেন না। আইনের সব খুঁটিনাটি জেনেও তাদের পড়ে থাকতে হচ্ছে তালিকাভুক্তির গ্যাঁড়াকলে। এতে করে নতুন-পুরোনো মিলে বেড়েই চলেছে শিক্ষানবিশ আইনজীবীর সংখ্যা।

বার কাউন্সিলের দীর্ঘসূত্রতার সমালোচনাঃ

২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। আইনজীবী তালিকাভুক্তিকরণের প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার সমালোচনা করে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশনা প্রদান করে। বলা হয়, বার কাউন্সিলকে প্রতি বছর (ক্যালেন্ডার ইয়ার) অধঃস্তন আদালতের অ্যাডভোকেট অন্তর্ভূক্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার। আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণকারী এই প্রতিষ্ঠানটি আপিল বিভাগের এই রায়ও কার্যকর করেনি।

আইন পেশার সনদ গ্রহণ করার জন্য আগে কোনো নির্ধারিত বয়স ছিল না। যেকোনো বয়সের মানুষ এই পেশায় সনদ গ্রহণ করতে পারতেন। তবে আইনজীবী হওয়ার জন্য ২০১৭ সালে বয়স নির্ধারণ করে দেন সুপ্রিম কোর্ট। ৪০ বছরের পর বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে আর আইনজীবী হিসেবে সনদ নিতে পারবেন না বলে আদেশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

এছাড়াও বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছর মেয়াদি এলএলবি সনদধারীরা বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না। তবে রায়ে বিষয়টি নির্ধারণের ভার বার কাউন্সিলের ওপর ছেড়ে দেন আদালত। বার কাউন্সিলের এ রকম কৌশলী কালাকানুন মানতে নারাজ শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা। 

সেসময় বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আইন পেশায় অন্তর্ভুক্তির বয়সসীমা নির্ধারণের বিষয়টি বার কাউন্সিলের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এটিকে সমীচীন মনে করি না। কারণ, এটি একটি স্বাধীন পেশা। যেকোনো সময় যে কারো এ পেশায় আসার অধিকার আছে। তবে আইন বিষয়ে পড়ালেখার বয়স নির্ধারণ করা যেতে পারে’।

বার ও বেঞ্চকে নিয়েই বিচার বিভাগ। বার ও বেঞ্চকে বলা হয় এক পাখির দুই ডানা। বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তকরণ কমিটি (এনরোলমেন্ট কমিটি) আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনিয়র আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত। অথচ তারাই আপিল বিভাগের রায় মানছেন না। দার্শনিক উইলিয়াম গডউইন বলিয়াছেন, 'আইনি বিচার হইল সকল নৈতিক কর্তব্যের সমষ্টি।' বলা হইয়া থাকে, 'আইনের নিয়মে পাওয়া ন্যায়বিচারই সভ্য সমাজের স্থায়ী নীতি।' 

সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১১ তে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বাধ্যতামূলক কার্যকারিতা রয়েছে। এছাড়া অনুচ্ছেদ-১১২ অনুসারে উচ্চ আদালতের রায় মানতে সবাই বাধ্য। দি বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাক্টিশনারস অ্যান্ড বার কাউন্সিল রুলস ১৯৭২ এর চ্যাপ্টার ৬ বিধি ৬০ অনুসারে একজন শিক্ষানবিশকে ছয় মাস জুনিয়রশিপ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু সঠিক সময়ে পরীক্ষা না হওয়ায় অনেকে দীর্ঘসময় শিক্ষানবিশ হিসেবে জীবন কাটাচ্ছেন।

সনদ পেতে এত বেগ কেনঃ

বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বিধি অনুযায়ী, অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্তির (এনরোলমেন্ট) জন্য বছরে দুবার পরীক্ষা হবে। এজন্য প্রথমে প্রিলিমিনারি (এমসিকিউ) ও পর্যায়ক্রমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় বসতে হবে শিক্ষার্থীদের। পরীক্ষার্থীরা কোনও একটি ধাপে প্রথমবার উত্তীর্ণ হলে তাদের মোট দুবার পরবর্তী ধাপের পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়।

বার কাউন্সিলের নির্ধারিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই কপালে জুটে সনদ। এই সনদ না হলে আইনজীবী হিসেবে কোনো মক্কেলের পক্ষে ওকালতি করার সুযোগ নেই। আর সনদ অর্জিত হলেও সরকারতো বেতন দেন না। তাহলে বেতন ছাড়াই এ প্রফেশনের সনদ পেতে এত বেগ কেন, প্রশ্ন শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের।

সমালোচিত প্রক্রিয়াটির ফলে তীব্র জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের। পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রতার কারণে ল গ্র্যাজুয়েটরা আইন প্র্যাকটিস করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। মানহীন প্রশ্নপত্র, পরীক্ষা খাতায় জালিয়াতি ও পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ না থাকার অভিযোগও বহুদিনের। একদিকে দাবির যৌক্তিকতা অন্যদিকে বার কাউন্সিলের চরম ব্যর্থতা। এভাবেই চলছে শিক্ষানবিশদের কঠিন জীবন।

আইন পেশায় অন্তর্ভূক্ত হতে আগ্রহী শিক্ষানবিশদের এমন অপেক্ষা ক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও অনিশ্চয়তা দেশের ল গ্র্যাজুয়েটদের আইন পেশা বিমুখ করে তুলছে। শিক্ষানবিশদের মনে পেশাগত জীবনের শুরুতেই এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে।

বার কাউন্সিল তালিকাভুক্তি পরীক্ষা নিয়ে সংস্থাটির গড়িমসি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে গভীর হতাশায় জর্জরিত হচ্ছেন শিক্ষানবিশরা। কেউ কেউ ক্যারিয়ার নিয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এমনিতেই শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের পেশাগত স্বীকৃতি নেই। মামলা লড়ার সুযোগ নেই বলে অর্থনৈতিক সুফল পান না তারা। শিক্ষানবিশদের জন্য আলাদা কোনো ফান্ডও নেই। এজন্য স্বপ্নের পেশায় মনোনিবেশ করতে পারছেন না অনেকে। অসংখ্য শিক্ষানবিশ আইনজীবী অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

বার কাউন্সিলের প্রতি বিরূপ মনোভাব সকল স্তরেই ছড়িয়ে পড়ছে। এই ব্যর্থতা ও উদাসীনতা সমাজের ভেতরে অভিভাবক স্তরেও বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে। নিয়মিত পরীক্ষা না হওয়ায় অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হচ্ছে, বাড়ছে বয়স। নিজের পায়ে ঠিকমত দাঁড়াতেও পারছেন না শিক্ষানবিশরা। ফলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আইন পাস করে বসে থাকছেন কিন্তু সেই ডিগ্রি কাজে লাগাতে পারছেন না তারা।

শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা করুন অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। সেই কান্নার আওয়াজ কী বার কাউন্সিল প্রশাসন শুনতে পায়। অসংখ্য আইন শিক্ষার্থী তাদের জীবন নষ্ট করেছেন লপ্রফেশনে এসে। শিক্ষানবিশদের করুণ অবস্থার জবাব কী বার কাউন্সিল দিতে পারবে। এ প্রশ্ন তাদের।

সময়মতো পরীক্ষার সুযোগ অন্তত হোকঃ

প্রতি বছর হাজার হাজার আইনের ছাত্র তাদের পড়াশোনার পাঠ চুকালেও সময়মতো তালিকাভুক্তি পরীক্ষা না নেওয়ায় ক্যারিয়ার শুরু করতে পারেন না তারা। অনেকটা অথৈ সাগরের অজানা গন্তব্যে হাবুডুবু খান। বিভিন্ন বেসরকারি চাকরি করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাদের বক্তব্য, পাশ-ফেল পরের কথা, সময়মতো পরীক্ষার সুযোগটা অন্তত হোক।

শিক্ষানবিশদের আইনজীবী সনদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে যাচ্ছে বার কাউন্সিল। আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষার মারপ্যাঁচে ৮০ ভাগ আইন শিক্ষার্থী আইন পেশায় যুক্ত হতে পারছেন না। আইন ব্যবসায় প্রবেশে অনুমতিপত্রের জন্য নানান প্রতিবন্ধকতায় বেকারত্বকাল প্রলম্বিত হচ্ছে। বার কাউন্সিলের অযৌক্তিক নিয়ম-কানুনে আইন শাস্ত্রে স্নাতকধারী লাখো শিক্ষার্থী পেশাগত অনিশ্চয়তার কবলে পতিত হচ্ছেন। এই সিস্টেমের দায়ভার বার কাউন্সিলকেই নিতে হবে।

আইন পড়া সৌভাগ্য না অভিশাপঃ

অভিজাত (রাজকীয়) পেশাগুলোর একটি হলো আইন পেশা। এটি নোবেল প্রফেশন। বিশ্বে সম্মানজনক ও স্বাধীন পেশা হিসেবে সমাদৃত। কিন্তু আমাদের দেশে বার কাউন্সিলের কৌশলগত সিদ্ধান্তে আইন পড়াকে সৌভাগ্য না ভেবে অভিশাপ মনে করছেন শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা।

আইনজীবীগণ তাদের মেধা ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে যুক্তি-তর্কের ভিত্তিতে ঘটনার সত্যাসত্য নির্ণয়ে ভূমিকা রাখেন, যার ভিত্তিতে বিজ্ঞ আদালত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সংকট নিরসন করেন। একটি সেবামূলক বৃত্তি হিসেবে ন্যায়পরায়ণতা ও মানবাধিকার সংরক্ষণে নিজেদের যুক্ত করতে অসংখ্য তরুণ নিজেদের আইনজীবী হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।

কিন্তু অহেতুক পরীক্ষার কবলে বেকার জীবনের দুর্বিষহ ভার বহন করতে হচ্ছে শিক্ষানবীশদের। তাঁদের জীবন থেকে আরও কয়েকটি বছর যদি খসে পড়ে তাতেও কারো অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বার কাউন্সিলের গোটা এনরোলমেন্ট প্রক্রিয়ার ওপর মহা ত্যক্ত-বিরক্ত শিক্ষানবীশরা। যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পিছে ছুটছেন তারা।

প্রত্যেকের শিক্ষানবিশ কাল এক একটা জীবন্ত উপন্যাস। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর সনদ যুদ্ধে বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর গোনা। তাদের কথা ভাবার যেন কেউ নেই। অমানবিকতা আর অবহেলাই যেন তাদের নিয়তি।

এ মুহূর্তে দরকার, বার কাউন্সিল সংস্কারঃ

শিক্ষানবিশ আইনজীবী মহাদেব রায় বলেন, বারের অনিয়মে আমার মতো অনেকেরই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। বার কখনোই এর দায় এড়াতে পারে না। যারা অ্যাডভোকেট হয়ে ন্যায়বিচারের পক্ষে লড়বেন, তারাই ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন।

শিক্ষানবিশ আব্দুল হালিমের ভাষ্য, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান মানে, আপনি আপনার খেয়াল-খুশি মোতাবেক যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না। তাদের সীমাহীর ব্যর্থতার দায়ভার বার কাউন্সিলকেই নিতে হবে।

শিক্ষানবিশ এক আইনজীবী বলেন, এলএলবি পরীক্ষায় পাসের পর অনেকেই মনে করে আইনজীবী হয়ে গেছি। আয়-রোজগারের জন্য পরিবারের চাপ বাড়ে। বার কাউন্সিলের অনিয়মিত পরীক্ষা ও পরীক্ষার পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারিনি। আইনি পেশা কোনো চাকরি নয়, কিন্তু আইন পাসের পরও পরীক্ষা নিয়ে কেন এত বিড়ম্বনা!

আরেক শিক্ষানবীশ বলেন, বছরে দুইবার বার কাউন্সিলের সনদ পরীক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু নিয়ম রক্ষা হয় না। যে কারণে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সোনালি সময় নষ্ট হচ্ছে। এ ব্যর্থতা বার কাউন্সিলের।

শিক্ষানবিশ মাহমুদুল হাসান বলেন, বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নামক বেড়াজালে আটকে আছেন হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষানবিশ আইনজীবী। তাই এই মুহূর্তে দরকার, বার কাউন্সিলের সংস্কার।

কয়েকজন শিক্ষানবিশ আইনজীবী জানিয়েছেন, নিবন্ধন পরীক্ষা দীর্ঘ সময় পরপর হওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। পরীক্ষার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

আরেক শিক্ষানবিশ মেহেদী হাসান জানান, প্রত্যেক পরিবারের আশা থাকে পড়ালেখা শেষ করে ছেলে-মেয়ে কিছু একটা করবে বা নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু আইন পেশায় সনদ পেতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। সেই সময়টা সবার পক্ষে দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে আইন পেশা ছেড়া যাচ্ছেন। সনদ দিয়ে আমাদেরকে বন্দি খাচা থেকে দ্রুত মুক্তি দিন। আমরা আর পারছি না।

শিক্ষানবিশ আইনজীবী সোনিয়া আক্তার বলেন, আইন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করে কি আমরা অপরাধ করেছি? তাহলে আমাদেরকে কেন হতাশায় রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা চাকরি চাই না, বেতন চাই না, বোনাস চাই না। কাজ করার একটি লাইসেন্স বা সনদ চাই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আহসান খালিদ বলেছেন, বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষা তুলে দেয়া উচিত। প্রিলিমিনারী, লিখিত, ভাইভা এই তিন স্তর বিশিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতির জটিলতা, বছরে মাত্র এক বার পরীক্ষা গ্রহণ করে সেটির চূড়ান্ত ফল প্রকাশে মাসের পর মাস এমনকি বছর পেরোনোর অপেক্ষা ও দীর্ঘসূত্রিতা বার কাউন্সিলের চরম দায়িত্বহীন কাজ ও কর্তব্য অবহেলার দৃষ্টান্ত। হাজার-হাজার আইনে গ্র্যাজুয়েটদের আইনজীবী হিসাবে ক্যারিয়ার গড়ার এইস্বপ্ন তালিকাভুক্তির গ্যাঁড়াকলে পড়ে, খুন হচ্ছে, ০৬ মাসের শিক্ষানবিশ কাল প্রলম্বিত হতে হতে অনেকের জন্য অনন্তকালের রুপ নিয়েছে। এটি অন্যায়।

জীবনের শুরুতেই অকারণে হোঁচটঃ

আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর একজন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) করতে পারেন। এরপর শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে কোনো সিনিয়রের (জ্যেষ্ঠ আইনজীবী) অধীনে ছয় মাসের প্রবেশনকালীন মামলা ও আইনি বিষয় সম্পর্কে অবহিত হন। সিনিয়রের মামলার নথিসংক্রান্ত চাক্ষুষ কার্যক্রম দেখা, পরিচালনা ও সহায়তা ছাড়াও বিভিন্নভাবে চলে শিক্ষানবিশকাল। সিনিয়রকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি এ সময়ে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির পরীক্ষার প্রস্তুতিও নেন।

কিন্তু বার কাউন্সিলের অনিয়মিত পরীক্ষা এবং কৌশলগত জটিল প্রক্রিয়ায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তাদের শিক্ষানবিশকাল দীর্ঘায়িত হয়। শিক্ষানবিশ আইনজীবীর আয়-রোজগারের বিষয়েও কোনো নীতিমালা নেই। ফলে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সিনিয়র আইনজীবী যে ধরনের আর্থিক সুবিধা দেন, সেটি নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

এটিও নির্ভর করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বা ল চেম্বারের আন্তরিকতা ও মামলার আধিক্যের ওপর। শিক্ষানবিশদের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই তারা আর্থিক বঞ্চনার মুখোমুখি হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলার দৈনিক কার্যক্রমের ওপর তাদের উপার্জনের বিষয়টি নির্ভর করে।

শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে খুব ভোরে উঠে রুটিন মাফিক যাত্রা শুরু করতে হয়। সকালে কোর্ট চেম্বারে যেতে হয় সাড়ে আটটার মধ্যেই। নয়টার মধ্যে আদালতে উপস্থিত থাকতে হয়। বিকাল ৫ টা পর্যন্ত কোর্টে থাকতে হয়। কোর্ট শেষে অনেকে সিনিয়রের সান্ধ্যকালীন চেম্বারে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত পরের দিনের মামলার বিষয়াদি প্রস্তুত করেন। এরপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

একজন শিক্ষানবিশকে দুপুরে কোর্ট অঙ্গনেই বা চেম্বারে খেয়ে নিতে হয়। এভাবেই সে কাজে সম্পৃক্ত থেকে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে থাকে। যে বয়সে একজন মানুষ সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়, সেসময় সে ১০০/১৫০/২০০ টাকা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ শিখেন। কঠিন সংগ্রাম করেই ভবিষ্যতে আইনজীবী হবার স্বপ্ন দেখেন।

লিখেছেন রাজীব রায়হান

তালিকাভুক্তির গ্যাঁড়াকলে শিক্ষানবিশরাঃ

পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রে পরীক্ষার এমন বিড়ম্বনা আছে বলে জানা নেই শিক্ষানবিশদের। তারা বলছেন, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনিক্যাল পেশায় কর্মজীবনে প্রবেশে এমন ধরাবাধা কোন আইন নেই। আসলে আইন পেশা ছাড়া আর কোনো বিশেষায়িত পেশায় এই তালিকাভুক্তি পরিক্ষা পদ্ধতির কোনো অস্তিত্বই নেই।

শিক্ষানবীশরা বলছেন, আইন কিন্তু এমবিবিএস, বিডিএস, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসি বিষয়ের মতো একটি হাইলি স্পেশালাইজড ও প্রফেশনাল সাবজেক্ট। একাডেমিক ডিগ্রি অর্জন শেষে বাংলাদেশে এমবিবিএস বা বিডিএস গ্র্যাজুয়েটরা কোনো তালিকাভুক্তি পরিক্ষা ছাড়াই বিএমডিসির অধীনে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করে নিবন্ধিত হয়ে রেজিস্টার্ড ডাক্তার বা ডেন্টিস্ট হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন।

একইভাবে যারা ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সের ওপর ডিগ্রি অর্জন করেন, তাদের কোনো তালিকাভুক্তি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় না। বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিলে আবেদন করে ভেটেরিনারি প্র্যাকটিশনার হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে পেশাজীবন শুরু করে।

ফার্মাসি বিষয়ে ডিগ্রিধারীরা একাডেমিক ডিগ্রি নিয়ে ফার্মাসিস্ট হিসেবে পেশা শুরু করেন। তাদেরও কোনো তালিকাভুক্তি পরীক্ষা দিতে হয় না। অথচ এলএলবিসহ আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা পদ্ধতি রয়ে গেছে। পূর্বোক্ত সমস্ত পদ্ধতি বা নিয়মে ইন্টার্নশিপ তাদের একাডেমিক ডিগ্রির শর্ত। পেশায় তালিকাভুক্তি পরীক্ষার শর্ত নয়।

তাদের মতে, চিকিৎসাও এমন সেবামূলক পেশা, যাদের হাতে মানুষের বাঁচা-মরা সবসময় নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে কেউ এমবিবিএস পাস করার পর নির্দিষ্ট মেয়াদের শিক্ষানবিশকাল শেষে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের ফরম পূরণ সাপেক্ষে পেশা জীবনে প্রবেশ করতে পারে। একই কথা খাটে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের ক্ষেত্রেও।

আবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালিসহ অন্যান্য দেশের প্রথিতযশা আদালতেও এরূপ পরীক্ষা পদ্ধতির অস্তিত্ব নেই। ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের পদ্ধতিও আমাদের তুলনায় সরল। ১৯৮১ সালের আগে আমাদের দেশেও এরূপ পরীক্ষা ছিল না। ২০১২ সালের আগে চলমান তিন ধাপের জটিল পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল না।

পূর্বে বার কাউন্সিল এল.এল.বি গ্রাজুয়েটদেরকে আবেদনের ভিত্তিতে অহেতুক পরীক্ষা পদ্ধতি ছাড়াই আইনজীবী তালিকাভুক্তি পদ্ধতি বলবৎ করেছিল। তাদের অনেকেই আজকে খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃত। অন্যান্য বিশেষায়িত পেশা জীবনে প্রবেশের প্রক্রিয়া বিবেচনায় শিক্ষানবিশ আইনজীবীদেরকে বার কাউন্সিল আইনজীবী সনদ প্রদান করা উচিত। না হলে আইনজীবী হতে আগ্রহী অনেকেই পরীক্ষা নামের কৃত্রিম দেয়াল টপকানোর আশা ছেড়ে দেবেন।

বারকাউন্সিলের জবাবদিহি কোথায়ঃ

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিয়মিত পরীক্ষা না নেয়ার দায়ভার বার কাউন্সিল এড়াতে পারে না। বার কাউন্সিল কমিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেমন সুনির্দিষ্টভাবে দিন-তারিখ উল্লেখ করে, তেমনিভাবে নতুন আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষার ব্যাপারেও দিন-তারিখ উল্লেখ করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইন থাকা বাঞ্ছনীয়।

মারাত্মক অভিঘাত এসে পড়ছে আইন পেশায় আসার স্বপ্নে বিভোর শিক্ষানবিশদের জীবনে। তাঁরা হতাশ, তাঁদের পথ দেখানো আজ সময়ের দাবি। আমরা মুখে বলি আইনের শাসন। কিন্তু যে প্রক্রিয়া থেকে তার সূচনা, সেখানে আমরা একটা বড় রকমের তালগোল পাকিয়ে বসে আছি। কারা দায়ী, কী উপায়ে সমাধান, আজ তার উত্তর জানা জরুরি।

শিক্ষিত বেকারের দেশে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা যখন প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের পরে নিজের খরচে, নিজের মা-বাবার খেয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইছে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্র তাঁদের পিঠ চাপড়ানোর পরিবর্তে পিঠে কিলঘুষি মারছে। এটা তো অসহনীয় এক বাস্তবতা। প্রতিবছর চল্লিশ না হয় পঞ্চাশ হাজারের মতো পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়। আর পাশ করে মাত্র দুই অথবা তিন হাজার! ফেল করার আধিক্য বলে দেয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা ত্রুটিপূর্ণ।

স্নাতক পর্যায়ে আইনশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখা কোর্স হিসেবে পড়ানো হয়। কোন কোন বিষয় পড়া প্রয়োজন তা বিবেচনা করেই পাঠ্যসূচি নির্ধারিত হয়। এসব বিষয় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও পেশা প্রবেশের পথে আবার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। অথচ আইনজীবী কোনো বেতনভুক্ত চাকুরে নন। এটি একটি অসঙ্গতি হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

আইনে স্নাতক সম্পন্ন করাটাই আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা নির্দেশক। স্নাতক ডিগ্রি যদি যোগ্যতার পরিচায়ক না হয় তবে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষা পদ্ধতিকে হেয় প্রতিপন্ন করে, ত্রুটি নির্দেশ করে। আইন শিক্ষায় ত্রুটি থাকলে পাঠ্যসূচি ও পঠন-পাঠন পদ্ধতি সংস্কার করার প্রয়োজন নির্দেশ করে। ফলে ভুলনীতির মাধ্যমে আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতি সংস্কারের বিকল্প নেই। আবার এ পরীক্ষা উত্তীর্ণদের পেশাজীবনে কোনো কার্যকর প্রভাব রাখতে পারে না। বরং বিকল্প উপায়ে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সনদ প্রদান করা সম্ভব।

সাপ লুডু খেলা সর্বনাশ ডেকে আনছেঃ

শিক্ষানবিশকালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ কর্মশালা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও অ্যাসাইনমেন্টের আয়োজন করা হোক। সেই আয়োজনের মাধ্যমে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা যেতে পারে। এটা পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে অধিক সহায়ক। নির্দিষ্ট সংখ্যক কর্মশালা-সেমিনার-প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ ও অ্যাসাইনমেন্ট প্রদান সাপেক্ষে আইনজীবী সনদ প্রদান করা হোক।

মামলা পরিচালনায় নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত শিক্ষানবিশ আইনজীবীর অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে অন্তর্ভুক্তিকরণের পূর্ব পর্যন্ত ন্যূনতম শিক্ষানবিশ সম্মানি ফি নির্ধারণ করা হোক।

আইনজীবী তালিকাভূক্তি প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, মানসম্পন্ন ও যথাসময়ে সম্পন্ন করতে হবে। পরীক্ষা প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার অংশ হিসেবে পরীক্ষা খাতা পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যথাযথভাবে পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদ প্রদান করতে হবে।

বিলম্বিত পরীক্ষা নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার তফসিল নির্ধারণ করতে হবে। বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নেয়ার জন্য একটি পঞ্জীবর্ষ থাকবে। সেখানে প্রতি বছর কোন তারিখে কোন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, তা সুস্পষ্টভাবে তালিকা বা তফসিল করে উল্লেখ থাকবে। জটিল, সময়সাপেক্ষ ও হয়রানিমূলক তিন ধাপের পরীক্ষার নামে ছাঁটাই প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে।

শিক্ষানবিশদের কেউ আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষা ছাড়াই সনদ দাবি করছেন। তারা বলছেন, শিক্ষানবিশ অন্তে আইনজীবী সনদ চাই। শিক্ষানবিশদের কেউ কেউ এমসিকিউ পদ্ধতি বাতিলের পক্ষে কথা বলছেন। কেউ লিখিত পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে আওয়াজ তুলছেন। তারা কেবল এমসিকিউ ও ভাইবা পরীক্ষা দেয়ার পক্ষে সোচ্চার।

তবে তাদের শর্ত, চল্লিশে (৪০) পাশ দিতে হবে এবং কোনো নেগেটিভ মার্কিং থাকবেনা। শিক্ষানবিশগণ বলছেন, আইনজীবী হিসেবে সনদ নেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণ করা চলবে না। আইন একটি স্বাধীন পেশা। যেকোনো সময় যে কারো এ পেশায় আসার অধিকার আছে।

পরীক্ষার্থীরা কোনও একটি ধাপে প্রথমবার উত্তীর্ণ হলে তাদের মোট দুবার পরবর্তী ধাপের পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়। কিন্তু যদি ওই দুবারও অনুত্তীর্ণ হয় সেক্ষেত্রে কখনই আর পূর্বের ধাপে ফেরত আসার নিয়ম মানতে চাইছেন না তারা। শিক্ষানবিশদের ভাষ্য, এই সাপ লুডু খেলা তাদের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে। একবার উত্তীর্ণ হওয়া ধাপ নয় কেবল পরের ধাপটি থেকেই পরীক্ষা দিতে চাইছেন কেউ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানাজনের নানা মত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছাতে অনলাইন জরিপের আয়োজন করা যেতে পারে। যে প্রস্তাবটি সর্বোচ্চ সমর্থন পাবে সেটি নিয়েই কথা বলা যেতে পারে। স্মারকলিপি, সংবাদ সম্মেলন, অনশন, সমাবেশ, অবরোধ, ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া যেতে পারে। তবে এর আগে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। বিভক্তি দাবি আদায়ের অন্তরায়। 

হয় বিতর্কিত পরীক্ষা বাতিল নয়তো আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

আইনজীবী তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে শুধুমাত্র এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ভাইভা গ্রহণ করে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তিসহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষানবিশ আইনজীবীর ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ দফা দাবি মেনে নেওয়ার আনুষ্ঠানিক বা দাপ্তরিক ঘোষণা চাওয়া হয়। অন্যথায় পরবর্তীতে বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মতো কর্মসূচিতে যাওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি।

লিখিত বক্তব্যসহ ৫ দফা দাবি উপস্থাপন করেন সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক চৌধুরী হৃদয়। তিনি বলেন, শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা আদালতে গেলে তাদের কোনো সম্মান দেওয়া হয় না। বরং তাদের চেয়ে একজন মুহুরিকে আরও বেশি সম্মান দেওয়া হয়। দাবি আদায় না হলে কঠোর কর্মসূচি নিতে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা বাধ্য হবে।

ঘোষিত দাবিগুলো হলো- প্রথমত, বিতর্কিত লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি চিরতরে বাতিল করে শুধুমাত্র এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ভাইভা হিসেবে সৌজন্য সাক্ষাৎকার নিয়ে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তি করা।

দ্বিতীয়ত, ফলাফলে সংক্ষুব্ধ পক্ষের রিভিউয়ের সুযোগসহ যৌক্তিক ফি ধার্য করে ১০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষায় ৪০ নম্বর পেলে পাস দিতে হবে এবং ভুল উত্তরের জন্য কোনো নেগেটিভ মার্ক কাটা যাবে না।

তৃতীয় দাবি হলো–আইনজীবী তালিকাভুক্তি পদ্ধতির যেকোনো পরীক্ষায় একবার উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষানবিশকে আর কোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে না- এ নিয়ম কার্যকর করতে হবে। Retrospectives effect দিয়ে পূর্ব থেকে কার্যকর করতে হবে।

চতুর্থত, বার কাউন্সিল থেকে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের কর্তৃত্ব প্রত্যাহার করতেই হবে। এবং সবশেষ দাবি হলো–প্রতি বছর দুইবার আইনজীবী তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

আন্দোলনের একাত্ম হওয়ায় বিকল্প নেইঃ

মানবিক ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দীর্ঘদিনের সৃষ্ট সমস্যার সুরাহা প্রয়োজন। বার কাউন্সিল পরীক্ষা না নেওয়ার পিছনের ব্যর্থতার যে বীজ বপিত হয়েছে তা উপরে ফেলতে হবে। পরীক্ষার পুরো প্রক্রিয়া ঢেলে সাজাতে হবে। জটিলতা নিরসনে বার কাউন্সিলকে অনতিবিলম্বে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষানববিশ আইনজীবীদের যৌক্তিক দাবি আমলে নিতে হবে। 

বার কাউন্সিল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠান কী করে পরীক্ষার প্রতি এতটা নির্লিপ্ত, সেটা বিরাট প্রশ্ন। সমস্যা থেকে উত্তোরনের সঠিক পথ বার কাউন্সিলকেই ঠিক করতে হবে। সনদ প্রত্যাশী শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সমস্যা সমাধানে যুগোপযোগী পদক্ষেপ তাদেরকেই নিতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা স্থায়ীভাবে কোনো সমাধানসূত্রে পৌঁছাতে অপারগ হলে বিকল্প পথ আন্দোলন।

নীতিনির্ধারকদের মানতে হবে যে, যারা একদিন বিচার বিভাগের অংশে পরিণত হবেন, তারা জীবনের শুরুতেই অকারণে হোঁচট খাচ্ছেন। দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হচ্ছেন, এটা লজ্জার। আইনজীবী সনদ অর্জনে আইন শাস্ত্রে স্নাতকধারীদের আইনজীবী তালিকাভুক্তি করার দাবিতে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের একাত্ম হওয়ায় বিকল্প নেই। এই নৈতিক ও যৌক্তিক দাবিতে কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সকল শিক্ষানবিশ আইনজীবী ও আইন শিক্ষার্থী একাট্টা হওয়া এখন সময়ের দাবি।

পেশা জীবনে প্রবেশ কালে ভুল নীতির মাধ্যমে আইনজীবী হওয়ার পথ আটকে রাখা হয়েছে। কারা এখানে ব্যর্থতার বীজ বুনলেন, সেটা খুঁজে দেখতে হবে। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এ অপতৎপরতা থামানো জরুরি। বার কাউন্সিলের পরীক্ষাসংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে সোচ্চার হোন এখনই। না হলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকাই শিক্ষানবিশদের ভবিতব্য।




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top