সাংবাদিকতার জন্মসূত্র ও বিবর্তন ধারায় অনবরত ছুটে চলা
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ১৯:৪১
কখন থেকে, কিভাবে এলো সংবাদপত্রঃ
সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। যেমন রাজাধিরাজ শাসনামলে ঢোল পিটিয়ে খাজনা আদায়ের যে বার্তা, সেটাই তখনকার সাংবাদিকতা, কিংবা এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে দূতের মাধ্যমে যে বার্তা পাঠানো হতো সেটাই তখনকার সাংবাদিকতা। হাতে লেখা সংবাদপত্র মুদ্রণ মাধ্যমে এসে ঘটেছে বিপ্লব। আর এখন প্রযুক্তি সংবাদপত্রকে নিয়ে গেছে অনলাইনে। এইযে, একেক সময়ে একেক যোগাযোগের ধরন, সেই আলোকেই এখনকার সাংবাদিকতা।
সংবাদপত্রের ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, আদিযুগে পাথর বা শিলালিপিতেই সংবাদ প্রচার করা হতো। তখন সম্রাট বা শাসকের রাজনৈতিক ঘটনাবলি, যুদ্ধের বিবরণ, প্রজা বা নাগরিকদের প্রতি বার্তা প্রচার করা হতো। সংবাদপত্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টজনেরা সকল যুগেই তাদের স্বার্থ হাসিল বা মতাদর্শের প্রচার প্রচারণা চালাতে চেয়েছে। কিন্তু সতেরো শতকের শেষদিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার থেকে সংবাদমাধ্যম হয়ে ওঠে সমাজের ওয়াচডগ।
একসময় রাজার অর্ডার, রাজ্যের প্রধান নগরগুলোতে প্রকাশের নিয়ম ছিল। কথিত আছে- লিখিত ভাবে সংবাদ প্রচারের ব্যাপারটি সর্বপ্রথম মিশর অঞ্চলে সংগঠিত হয়। কেউ কেউ বলেন, খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ বছর পূর্বেই ফারাও শাসন আমলে- হাল আমলের কুরিয়ার সার্ভিসের মত রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আদেশনামা প্রচারের ব্যবস্থা চালু ছিল।
সংবাদপত্র ইতিহাসে দেখা যায়- প্রাচীন রোমে, অ্যাক্টা দিউরমা বা সরকারের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হতো। সেটা ধাতু বা পাথরে খোদাই করে জনসমাগম হয়, এমন জায়গায় টাঙিয়ে দেয়া হতো। প্রাচীন রোম সভ্যতায় সরকারের তরফে জুলিয়াস সিজারের ঘোষিত ইস্তেহার জনগণের উদ্দেশ্যে তৈরি করে বিতরণ করা হত, যা ছিল ধাতব পদার্থ অথবা পাথরের উপর লিখিত।
অনেকের মতে, সাংবাদিকতার আদিরূপটি প্রবর্তিত হয়েছিল জুলিয়াস সিজারের আমলে, খ্রিষ্টপূর্ব ৫০ সালে। সে সময় ইতালির রোমে এক ধরনের লোক কাজ করতো সংবাদ লেখক হিসাবে। তারা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রাত্যহিক দিনলিপি সংগ্রহ করতো। যেটা আজকের যুগে প্রাচীরপত্রের মতো। সাংবাদিকতার আদিরূপ বলা হলেও সেই প্রাচীরপত্রের লেখাগুলো মুদ্রিত ছিল না, ছিল হাতে-লেখা। অন্য অর্থে বলা যায় হাতে-লেখা দেয়াল পত্রিকা।
কেউ বলছেন- সমসাময়িক ও সময়োপযোগী ঘটনাবলীর ওপর ভিত্তি করে লেখা হত সংবাদ। আর সংবাদ লেখকদের প্রাত্যহিক কার্যাবলীর ওপর ভিত্তি করে লেখা রোমের প্রকাশ্য স্থানে সেঁটে রাখার জন্য জুলিয়াস সিজার নির্দেশ দিতেন। এটা আধুনিক যুগের প্রাচীরপত্রের মতো। এটাকে প্রথম খবরের কাগজ ধরা হলে তাকে আজকের আধুনিক যুগের খবরের কাগজের সঙ্গে কিছুটা তুলনা করা যায়।
হরফ বা মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয় মধ্যযুগের ১৪৪০-১৪৫০ সালে; ইউরোপের জার্মানিতে। তখন খবর বলতে যুদ্ধ, আজব ও গুজব ছাপা হতো। ১৭০২ সালে প্রথম এক পাতার ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি কারেন্ট প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ড থেকে। তখন খবর বলতে চটকদার অপরাধ, কেচ্ছা, নিলাম আর নিষেধাজ্ঞা ছাপা হতো।
চীনের অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রের প্রচলন হয় বলেও জানা যায়। অষ্টম শতাব্দীর দিকে চায়নায় কাইয়ুয়ান ঝা বাও নামে এক রাজকীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। জনশ্রুতি আছে- ইউরোপের ভেনিসে প্রথম সংবাদপত্র মুদ্রিত হয়েছিল। পনেরো শতকে লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার হলেও ষোড়শ শতকেও ভেনিস থেকে হাতে লেখা প্রাচীরপত্র প্রকাশিত হতো।
কৌটিল্যের তথ্য অনুযায়ী- মৌর্য শাসনকালে এক শ্রেণির কর্মচারীর কাজ ছিল রাজ্যের যাবতীয় খবর রাজদরবারে পেশ করা। আর মধ্যযুগে ভারত বর্ষে হাতে লেখা সংবাদপত্রের কথা জানা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্রের প্রচলন শুরু হয় মুসলমান রাজত্বকালে। অবশ্য তখন সংবাদপত্র মুদ্রিত হতো না, সমস্ত রাজনৈতিকবিষয়ক সংবাদ হাতে লেখা হতো এবং তা দেশের রাজকর্মচারীর নিকট প্রেরিত হতো। বিভিন্ন প্রদেশের সব সংবাদ একত্র করে সম্রাটের কাছে যেত। এরূপ সংবাদ সংগ্রহের জন্য আলাদা বিভাগ ছিল।
সুলতানি আমলে ‘বারিদ-ই-মামালিক’ বা গোয়েন্দা প্রধান কর্তৃপক্ষকে সাম্রাজ্যের তথ্য সরবরাহ করার দায়িত্ব পালন করতেন। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির মুনহি বা গুপ্তচররা সুলতানকে অতি তুচ্ছ বিষয়গুলোও অবহিত করত।
ইতিহাস বলে, মুঘল আমলের বাংলায়ও সাংবাদিকতা ছিল। তবে তা শুরুর পর্যায়ে। প্রাচীন ভারতে পাথর বা স্তম্ভে খোদিত শব্দাবলি তথ্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সম্রাট অশোক পাথর ও স্তম্ভে খোদিত আদেশ তার সাম্রাজ্যের সর্বত্র এবং বাইরেও প্রজ্ঞাপন করেন। তিনি তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশে এবং বিদেশে গুপ্তচর নিয়োগ করেন।
ব্রিটিশপূর্ব ভারতের সংবাদপত্রের নজির বলতে মোগলদের রাজকীয় ফরমানের সংকলক ‘ওয়াকিয়া নবি‘ ব্যতীত আর কোনো আবিষ্কার এখনো করতে পারেননি পন্ডিতকুল। মুগল আমলে প্রচলিত নিউজলেটার, রাজকীয় বিজ্ঞপ্তি এবং অন্যান্য লিখিত যোগাযোগের কথাও ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন।
মুঘল শাসনামলে সংবাদ সার্ভিস নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘ওয়াকই-নবিশ’, ‘সাওয়ানিহ-নবিশ ও ‘খুফিয়ানবিশ’ চালু ছিল। এছাড়াও ‘হরকরা’ এবং ‘আকবর-নবিশ’ নামে সুলতানদের সাধারণ তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল।
ভারতে মুদ্রণযন্ত্র এসেছিল পর্তুগিজদের হাত ধরে। তবে মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার করে সংবাদপত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল ইংরেজদের হাতে। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত জেমস অগাস্টাস হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলায় আধুনিক সাংবাদিকতার ইতিহাস শুরু হয়। পত্রিকার বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, সব পক্ষের জন্য উন্মুক্ত হলেও এটি কারও দ্বারা প্রভাবিত নয়-এমন একটি সাপ্তাহিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক পত্রিকা।
অনেকের মতে- ভারতে প্রথম পত্রিকা বের হয় কলকাতা থেকে ২৯ জানুয়ারি ১৭৮০ সালে। পত্রিকার নাম বেঙ্গল গেজেট। টিকেছিল মাত্র দুই বছর। বাংলায় সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালের ১৪ মে। পত্রিকার নাম বাঙ্গাল গেজেট। প্রকাশক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। এই পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতো সরকারি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, জন্ম-মৃত্যু, বিয়ের খবর। সতীদাহ নিয়ে এ সময় আরো দুটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হতো।
গবেষকরা বলছেন- জেমস অগাস্টাস হিকির প্রকাশিত প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্রটি 'হিকির গেজেট' নামে পরিচিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে পত্রিকাটির নাম ছিল 'বেঙ্গল গেজেট' বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার। পত্রিকাটি অল্পদিনেই বাজেয়াপ্ত করেন লর্ড হেস্টিংস।
এরপর উইলিয়াম ডান 'বেঙ্গল জার্নাল' প্রকাশ করে অচিরেই ভারত ত্যাগে বাধ্য হন। তার উত্তরসূরি 'বেঙ্গল হারকরা' পত্রিকার প্রকাশক ডক্টর চার্লস ম্যাকলিয়ানকেও ভারত ত্যাগে বাধ্য করেন গর্ভনর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি। তিনি সংবাদপত্রের ওপর ১৭৯৯ সালে সেন্সরশিপ আরোপ করেন।
এর আগে ১৭৬৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারী উলিয়াম বোন্টস চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তিনি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু কোম্পানির লোকরা সম্ভাব্য বিপদের গন্ধ পেয়ে বোন্টস সাহেবকে জাহাজে করে তার নিজ দেশে পাঠিয়ে দেন। রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় রোমান ক্যাথলিক চার্চের পক্ষে একজনকে প্যামলেট লেখার দায়ে তাকে ফাঁসিতে লটকানো হয়। উইলিয়াম প্রাইম নামের এক মুদ্রক ও প্রকাশককে রাজদ্রোহের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এই বিদেশিদের হাতেই সংবাদপত্র প্রকাশ, প্রচারের যেমন হাতেখড়ি তেমনি নিয়ন্ত্রণেরও সূত্রপাত। ইউরোপিয়ানরাই এ উপমহাদেশে আধুনিক সংবাপত্র ও সাংবাদিকতার জন্ম দিয়েছেন। বিশেষ করে ১৮১৮ সাল থেকে ১৮২১ সাল ছিল এ অঞ্চলের সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
লিখেছেন রায়হান রাজীব
এই উপমহাদেশে সংবাদমাধ্যমের যাত্রা শুরু কবে : একনজরে
এই উপমহাদেশে কবে সংবাদমাধ্যমের যাত্রা শুরু হয়েছে তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে মধ্যযুগে ভারতবর্ষে হাতেলেখা সংবাদপত্র ছিল, সেগুলোর সঙ্গে পেশাদার সংবাদদাতারা যুক্ত ছিলেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে কাফি খান নামে এক পণ্ডিত তার মুন্তা-খাবুল-লুবাব গ্রন্থে লিখেছিলেন, শিবাজীর বাড়ির জনৈক রাজারামের মৃত্যুর খবর সম্রাটের শিবিরে পৌঁছেছিল সংবাদপত্রের মাধ্যমে। (সুধাংশু শেখর রায় : সাংবাদিকতা সাংবাদিক ও সংবাদপত্র)। বলা দরকার, মুদ্রণযন্ত্র তখনও তৈরি হয়নি।
তবে আধুনিক অর্থে উপমহাদেশে সংবাদপত্র ১৭৮০ খ্রিব্দের ২৯ জানুয়ারি কলকাতায় প্রথম চালু হয়। বেঙ্গল গেজেট বা হিকির বেঙ্গল গেজেট নামে এটি ছিল ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা (ভারতবর্ষের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র)। পত্রিকাটি দুই বছর পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছিল। ১২ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ৮ ইঞ্চি প্রস্থ দুই পৃষ্ঠার এ পত্রিকাটির মালিক, সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। ২৩ মার্চ ১৭৮২ সালে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হযে যায়।
১৮১৮ সালে বাংলা সাংবাদিকতা যাত্রা শুরু করে। সে বছর বাঙাল গেজেট (বাঙালি কর্তৃক প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র- কলকাতা), দিগ্দর্শন (কলকাতা) এবং সমাচার দর্পণ (শ্রীরামপুর) নামে তিনটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল।
উপমহাদেশে বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র হলো দিগ্দর্শন (বাংলা ভাষার প্রথম সাময়িকপত্র)। শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে শ্রীরামপুর থেকে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রথম এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। চার পৃষ্ঠার পত্রিকাটি ছিল বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক মাসিক পত্রিকা। এখানে বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ একসঙ্গে প্রকাশিত হতো। শ্রীরামপুরের সাংবাদিকরা একটি নিজস্ব ভাষারীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটি ছিল মাসিক পত্রিকা এবং এখানে ছাত্রদের উপযোগী ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানা রচনা থাকত।
একই বছরের মে মাসে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারিরা আরেকটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করে। এটি ছিল জন ক্লার্ক মার্শম্যান সম্পাদিত সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ (বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র, সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত)। এটি প্রায় ২০ বছর চালু ছিল।
১৮১৮ খ্রিস্টাব্দেই বাঙালি মালিকানায় প্রথম সংবাদপত্র বাঙ্গাল গেজেটি প্রকাশিত হয়, প্রকাশক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য। কারো কারো মতে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য্য। মাঝে মধ্যে এতে ইংরেজি ও হিন্দিতে কিছু নিবন্ধ মুদ্রিত হলেও সাধারণভাবে এর ভাষা ছিল বাংলা। হরচন্দ্র রায় ছিলেন বাঙ্গাল গেজেটটির সম্পাদনাকার্যে গঙ্গাকিশোরের অন্যতম সহযোগী।
১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মে জেমস সিল্ক বাকিংহাম সম্পাদিত ক্যালকাটা জার্নাল অর্ধ-সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক-এ রূপান্তরিত হয়। ক্যালকাটা জার্নালই ছিল উপমহাদেশের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র। পরে রাজা রামমোহন রায়ের 'সংবাদ কৌমুদী', কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর' (বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র) প্রকাশিত হয়। ১৭৮০-১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে সংবাদপত্রগুলো মূলত কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে।
মার্গারিটা বার্নাসের 'দ্যা ইন্ডিয়ান প্রেস' সূত্রে জানা যায়- বাদশা আওরঙ্গজেবের সময় সাধারণ সৈন্যদের মাঝে সংবাদপত্র বিলি করা হতো। ১৮২৮ সালে কর্নেল জেমস টড মোগল দরবারে কয়েকশ হাতে লেখা সংবাদপত্র হস্তগত করে তা লন্ডনের এশিয়াটিক সোসাইটিতে পাঠাতেন। সেই সব কাগজ লম্বায় ৮ইঞ্চি এবং চওড়ায় সাড়ে ৪ ইঞ্চি ছিল। উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাভাষী অঞ্চলে সাংবাদিকতা বৃত্তির উন্মোচনে মোগল সম্রাটদের ভূমিকা ছিল অনন্য।
উপহাদেশের বাংলাদেশ অঞ্চলে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে জেলা শহর রংপুর থেকে প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র রংপুর বার্তাবহ প্রকাশিত হয় (বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র)। এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কুন্ডির জমিদার কালীচরণ রায় চৌধুরী। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত এই সাপ্তাহিকের সম্পাদক ছিলেন গুরুচরণ রায়।
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিকের নাম ছিল ঢাকা নিউজ, এটি সম্পাদনা করতেন এ.আর ফোর্বস। ১৮৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গ থেকে অন্তত চারটি সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলো ছিল রংপুর দিকপ্রকাশ, কবিতা কুসুমাবলী (ঢাকা), মনপঞ্জিকা (ঢাকা) এবং পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ (ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র)। ঢাকা দর্পণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৩ সালে।
প্রথম দিককার সংবাদপত্রগুলো খুব বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল বলে জানা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রথম ব্যতিক্রম অমৃতবাজার। যশোরের কৃতী ভ্রাতৃদ্বয় বসন্তকুমার ঘোষ ও শিশিরকুমার ঘোষ ঝিকরগাছার পলুয়া মাগুরা গ্রাম থেকে ১৮৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি বের করেন। অমৃত বাজারে প্লেগ রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ার কারণে ১৮৭১ সালে এটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। (সংস্থাপন মন্ত্রণালয় : বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার)। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রুশ কমিউনিস্ট বিপ্লবী ভ্লাদিমির লেনিনএবিপি-কে ভারতের সেরা জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র বলে বর্ণনা করেছিলেন।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মোট ৩৮টি সংবাদপত্র ছিল, যার মধ্যে ১০টি প্রকাশিত হতো পূর্ববঙ্গ থেকে। এগুলো ছিল বঙ্গবন্ধু, ঢাকা প্রকাশ, মহাপাপ এবং বাল্যবিবাহ (ঢাকা থেকে); গ্রাম দূত, বালারঞ্জিকা, হিতসন্ধানী, বরিশাল বার্তা (বরিশাল থেকে), হিন্দু রঞ্জিকা (রাজশাহী) এবং রংপুর দিকপ্রকাশ (রংপুর)।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় উঁচুমানের ইংরেজি অর্ধ-সাপ্তাহিক বেঙ্গল টাইমস। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট দশটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। এ সময়ে অধিকাংশ পত্রিকাই পরিচালিত হতো হিন্দু মালিকানায়।
১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় গরণ ও ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক তৎপরতার বছরগুলোতে বাংলাদেশ অঞ্চলে সংবাদপত্র শিল্প বিকাশের ভিত্তি প্রশস্ত হয়। এ সময় বাংলা থেকে প্রকাশিত ১৭৩টি সংবাদপত্রের মধ্যে আনুমানিক ৬৫টি পূর্ববঙ্গ থেকে মুদ্রিত হয়। এদের অধিকাংশই ছিল মতামতধর্মী, যেগুলোর উপজীব্য ছিল সাহিত্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা, সংস্কার এবং ধর্ম।
পূর্ববাংলার প্রথম দৈনিক পত্রিকা ছিল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত জ্যোতি। এর প্রকাশ শুরু হয় ১৯২১ সালের ৫ আগস্ট। এরপর ১৯২৯-এ চালু হয় দৈনিক, ১৯৩০-এ দৈনিক রাষ্ট্রবার্তা, ১৯৩৬-এ দৈনিক আযান এবং ১৯৪৬-এ দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান আমলের (১৯৪৭-৭০) শুরুর দিকেও পূর্ববঙ্গের সংবাদপত্র শিল্প কেবল মিশনারি পর্যায় অতিক্রম করছিল। ভারত বিভক্তির সময় আব্দুস সামাদ সম্পাদিত দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান-ই কেবল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হতো।
ভারত বিভাগের পর পূর্ববাংলায় প্রথম যে দৈনিকের আবির্ভাব ঘটে তার নাম ছিল পয়গাম (সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী)। এটি ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। একই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশনা শুরু করে জিন্দেগী নামক অর্ধ-সাপ্তাহিক। মওলানা আকরম খাঁর কলকাতাভিত্তিক দৈনিক আজাদ-ও ঢাকাতে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৪৮ সাল থেকে প্রকাশনা শুরু করে।
১৯৪৯ সালে ঢাকায় প্রকাশিত হয় দ্য পাকিস্তান অবজারভার। আরও দুটি সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ যথাক্রমে ১৯৪৯ ও ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়। এগুলো এখনো বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে শীর্ষস্থানে আছে। পরবর্তী প্রকাশনাগুলোর মধ্যে ছিল দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা), পূর্বদেশ এবং দ্য মর্নিং নিউজ। এরপর প্রকাশিত হয় শাশ্বত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, জয় বাংলা, সোনার বাংলা, বাংলার বাণী, বিপ্লবী বাংলা, দ্য নেশন, মুক্ত বাংলা, দ্য পিপল, দুর্জয় বাংলা, মুক্তি, একতা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মুহূর্তে বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১০টি। ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বিচিত্রার প্রকাশনা শুরু হয় দৈনিক বাংলা প্রকাশনী থেকে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবাদপত্রে নিয়োজিত কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য আইন প্রণীত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সরকারিভাবে প্রকাশিত চারটি পত্রিকা ছাড়া সরকার অন্যসব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করে। পত্রিকা চারটি ছিল দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস।
১৯৭৫ সালের পর থেকে পুরনো পত্রিকাগুলো একে একে আবার প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সংবাদপত্র ছিল নিয়ন্ত্রিত। ১৯৮৪ সালে যায় যায় দিন নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন মতের রেকর্ড সংখ্যক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে সংবাদপত্রে রঙিন ছবি মুদ্রণও সুন্দর গেটআপে নতুন পত্রিকা চালু হয়।
নব্বই দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য দৈনিক পত্রিকার মধ্যে ছিল ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, ইনকিলাব, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, বাংলাবাজার পত্রিকা, মুক্তকণ্ঠ, প্রথম আলো, সংবাদ, মানবজমিন, সংগ্রাম, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, দ্য ডেইলি স্টার, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং নিউ নেশন।
নিউজ এজেন্সি, কোন চ্যারিটি হাউজ নয়:
প্রচলিত অর্থে সংবাদ মানে হচ্ছে খবর। যা মূলত একটি ফারসি শব্দ। নতুন ঘটনা সমূহের বিবরণ ও প্রকাশ। যখন কোন খবর কারো বাড়ি পর্যন্ত বহন করে নিয়ে আসা হতো, তখন সংবাদদাতাকে মিষ্টান্ন কিংবা সন্দেশ খাইয়ে আপ্যায়ন করাটা ছিল বঙ্গীয় সংস্কৃতির প্রাচীন প্রথা।
যেহেতু খবর বিনিময়ে সন্দেশ, তাই সংবাদকে কেউ কেউ সন্দেশ নামেও অভিহিত করেছেন। তাই সন্দেশকে সংবাদের বিনিময় মূল্য ধরলে, আড়াইশ বছর আগেও নিউজ ওয়াজ এক্সপেন্সিভ মানে ‘ফিরি ফিরি‘ সংবাদ কেউ কাওকে শোনায়নি তখনও !
বলা হয় নিউজ এজেন্সি, অনাথ শিশু লালন পালনের কোন চ্যারিটি হাউজ নয়। আর ৮-১০টি ব্যবসার মতোই গণমাধ্যম একটি ব্যবসা। এটি কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়, যা আজীবন ভর্তুকি দিয়ে চলবে।
চেনা প্রশ্ন, সঠিক উত্তর জানা নেই:
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিকরা৷ প্রশাসন ও প্রভাবশালীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন সংবাদকর্মীরা। ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আক্রোশে অনেকের জীবনও চলে যায়।
রাজনীতিবিদ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আমলা সুযোগ পেলে সাংবাদিকদের নামে মামলা ঠুকে দেয়, হয়রানি করে। আবার কথায় কথায় রাজপথে সাংবাদিক পেটানো হয়। সাংবাদিকদের কাজ হলো মানুষকে তথ্য জানানো। এই জন্যই তারা কাজ করেন।
তাহলে কেনো খবর প্রকাশের পর সাংবাদিককে মার খেতে হয়, নির্যাতিত হতে হয়, জীবন দিতে হয়? সাংবাদিককে কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে? তারা তো দেশ ও জনগণের জন্যও সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন।
বিষয়: সংবাদপত্র সংবাদ সাংবাদিকতা ইতিহাস
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।