আব্বা আব্বা, রাব্বি আব্বা, আমাকে বাঁচান
রাসেল হত্যা মামলায় আব্বা বাহিনীর প্রধানসহ গ্রেপ্তার ১২
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৮ জানুয়ারী ২০২৪, ১৬:৩১
ঢাকার কেরানীগঞ্জে রাসেল হত্যা মামলার প্রধান আসামি স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ওরফে আব্বা বাহিনীর প্রধান আফতাব উদ্দিন রাব্বিসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার বাকি আসামিরা হলেন আলমগীর হোসেন ওরফে ঠান্ডু (৩৯), আমির হোসেন (৩৮), মো. শিপন (৩১), দেলোয়ার হোসেন দেলু (৩৭), মো. রনি (৩৫), অনিক হাসান হিরা (৩০), মো. সজীব (৩৬), ফিরোজ (৩১), রাজীব আহমেদ (৩৫), মাহফুজুর রহমান (৩৬) ও রতন শেখ (২৮)।
এর আগে ১০ জানুয়ারি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফতাব উদ্দিন রাব্বির অফিসে রাতভর নির্যাতন চালিয়ে রাসেলকে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের সময় বন্ধু দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফতাব উদ্দিন রাব্বিকে আব্বা ডেকে বাঁচার আকুতি জানিয়েও রক্ষা পাননি রাসেল। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় বস্তায় ভরে তাঁকে বাড়িতে ফেলে আসে রাব্বির সহযোগীরা। রাসেলকে নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে দিয়ে অন্যদের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে রাব্বি। ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
রাসেল বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার ভাসানচর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হাওলাদারের ছেলে। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের খেজুরবাগ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।
চরকালীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মমিনুল হক বলেন, কালীগঞ্জ এলাকায় রাব্বির টর্চার সেল রয়েছে। গত মঙ্গলবার সারারাত সেখানে রাসেলের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় রাব্বি ও তার সহযোগীরা।
নির্যাতনের ওই ভিডিও নিজের ফেসবুকে দিয়ে রাব্বি লেখে, রাসেলরে দেখে যদি কেউ না বুঝে, তাইলে রাসেলের জায়গায় আবার কেউ থাকবে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, খালি গায়ে থাকা রাসেলকে কয়েকজন টানা-হেঁচড়া করছে। রাসেল মুমূর্ষু অবস্থায় রাব্বিকে বলছে, আব্বা আব্বা, রাব্বি আব্বা, আমাকে বাঁচান।
মমিনুল হক জানান, রাব্বির বাবা বাসের উদ্দিন শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। রাব্বির নেতৃত্বে তার সহযোগীরা কেরানীগঞ্জে মাদকের কারবার করে। রাসেল ও রাব্বি বন্ধু। চরকালীগঞ্জ ও তেলঘাট এলাকা থেকে রাব্বির নামে চাঁদা তুলত রাসেল। মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তেলঘাট এলাকার পারভীন টাওয়ারের নিচতলায় রাব্বির অফিসে ওই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে কোন্দল চলছিল।
এ নিয়ে রাতভর নির্যাতন করে বুধবার সকালে রাসেলকে বস্তায় ভরে মুমূর্ষু অবস্থায় চরকালীগঞ্জের বাসায় ফেলে আসে রাব্বির সহযোগীরা। পরে রাসেলের মৃত্যু হলে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে দ্রুত খেজুরবাগ কবরস্থানে দাফনের চেষ্টা করে রাব্বির পরিবার। তবে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়।
নিহতের স্ত্রী মৌসুমি আক্তার রিয়া জানান, আমার স্বামী রাসেল ঘাতক রাব্বিসহ তার সহযোগীরা রাতভর পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। আমার স্বামীকে নির্যাতনের খবর পেয়ে আমি রাত সাড়ে ১২টায় তেলঘাট এলাকার পারভীন টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় আফতাব উদ্দীন রাব্বির নিজ অফিসে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি আমার স্বামী অফিসের ফ্লোরে পড়ে আছে।
আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা মারধরের কথা অস্বীকার করে। এরপর তারা আমার বাড়িতে এসে আমার মেয়েকে একটি ঘরে আটক করে ঘরদুয়ার তছনছ করে। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা আমার কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করে। আমি এত টাকা কোথায় পাব বললে তারা আমার স্বামীর টাকা-পয়সা ও চেকবই পাসপোর্ট নিয়ে যায়।
এরপর তারা ফের অফিসে গিয়ে আমার স্বামীকে মারধর করতে থাকে। সকালে আমার স্বামী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ সময় কারা আমার স্বামীর আইফোন ও আমার হাতের ফোনটিও নিয়ে যায়। যাতে করে আমি ৯৯৯ নম্বরে বা কোনো স্বজনকে ফোন দিতে না পারি। আমরা সকালে আমার স্বামীকে মুমূর্ষু অবস্থায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্য্ল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
রাসেলের বাবা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমার ছেলে জীবনের শেষ মুহূর্তে আব্বা বাঁচাও বলেও রক্ষা পায়নি। শেষে বস্তায় ভরে বাসায় দিয়ে আসে। রাসেল মারা যাওয়ার পর তার লাশ দাফনের জন্য চাপ দেয় রাব্বির বাবা আওয়ামী লীগ নেতা বাসের উদ্দিন।
বুধবার (১৭ জানুয়ারি) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান পিপিএম (বার) বলেন, নিহত রাসেল আসামি রাব্বির বন্ধু ছিল। কালিগঞ্জ এলাকায় রাসেল বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে রাব্বির নামে চাঁদা তোলে।
কিন্তু রাসেল সেই টাকা রাব্বি ও অন্য সহযোগীদের না দিয়ে আত্মসাৎ করে। মূলত আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে ও পারস্পরিক মতবিরোধের জেরে রাব্বি ও তার সহযোগীরা রাসেলের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় রাব্বি লোকজন দিয়ে রাসেলকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে আসে।
এরপর এ অফিস রুমে রাব্বি ও তার সহযোগীরা মিলে সারারাত রাসেলকে প্রচণ্ড মারধর করে ও কেচি দিয়ে চুল কেটে দেয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে রাসেল তার বন্ধু রাব্বিকে ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকে ও বাঁচার জন্য আকুতি মিনতি করতে থাকে। কিন্তু তার পরেও সবাই মিলে পালাক্রমে মারতে থাকায় রাসেল গুরুতর আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। একপর্যায়ে রাব্বির লোকজন আহত রাসেলকে অচেতন অবস্থায় রাত ২টার দিকে তার বাসায় স্ত্রীর কাছে দিয়ে আসে। পরদিন সকালে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়ার পথে রাসেল মারা যায়।
এ ঘটনার পর থেকেই ব্যাপক তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে ঢাকা জেলা পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ হত্যার ঘটনাস্থল রাব্বির অফিসে গিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আলামত জব্দ করে।
এ ঘটনার দুইদিন পর নিহত রাসেলের বাবা বীরমুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হাওলাদার বাদী হয়ে ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার পর আসামিরা পালিয়ে যান।
পুলিশ সুপার জানান, হত্যাকাণ্ডে এজাহারভুক্ত আসামি ছাড়াও তদন্ত টিম ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ এবং ভাইরাল হওয়া ভিডিও পর্যালোচনা করে ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের শনাক্ত করে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।