শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আ.লীগ নিষিদ্ধ হয়নি, কিছু সময়ের জন্য কার্যক্রম স্থগিত হয়েছে: ড. ইউনূস

Nasir Uddin | প্রকাশিত: ১২ জুন ২০২৫, ১০:৪৮

ছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল বলা যায় কি-না– সেই প্রশ্ন তুলেছেন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, তবে ‘দেশ ও রাজনীতির নিরাপত্তার স্বার্থে’ একটি সময়ের জন্য আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে, সেটা বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত। বুধবার (১১ জুন) লন্ডনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক থিঙ্কট্যাংক চ্যাথাম হাউসে আলাপচারিতায় এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি।

চ্যাথাম হাউসের পরিচালক ব্রনওয়ে ম্যাডক্সের সঞ্চালনায় আলাপচারিতায় অন্তর্র্বতী সরকারের তিন দায়িত্ব—সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপগুলো বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা।

সেখানে সঞ্চালক তাকে প্রশ্ন করেন, যে জুলাই সনদ হচ্ছে, সমালোচকেরা বলবেন, অনেক রাজনৈতিক দলকে এর বাইরে রাখা হচ্ছে, যারা এর সঙ্গে একমত নয়, যেমন আওয়ামী লীগ; তাদের জন্য কোনো জায়গা রাখছেন না। সুতরাং, মানুষকে কোনো বিকল্প দেওয়া হচ্ছে না। তারা বলছে, এটা একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। এটা ঐকমত্য সম্পর্কে অনেক কথায় সুন্দরভাবে মোড়ানো বাংলাদেশের জন্য একটি কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ।

জবাবে ড. ইউনূস বলেন, হ্যাঁ। ঠিক আছে, এ নিয়েও বিতর্ক আছে। বিতর্ক হলো আওয়ামী লীগ কি রাজনৈতিক দল? যদি তারা রাস্তায় এভাবে তরুণদের হত্যা করতে পারে, এভাবে মানুষকে গুম করতে পারে, এভাবে টাকা চুরি করতে পারে, আমরা কি তখনো এটিকে রাজনৈতিক দল বলব? সুতরাং এটি একটি বিতর্ক। এটি কোনো সিদ্ধান্ত নয়।

তিনি বলেন, আমরা ভেবেছিলাম, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার প্রস্থানের পর এটি শেষ হবে। এখন এটি একটি নতুন দেশ, যেখানে তারা নেই। কিন্তু যারা পালিয়ে গেছে, তাদের জন্য এটা শেষ হয়নি। অনুপস্থিত থেকেও অন্য দেশ থেকে একইভাবে কাজ চালিয়ে গেছে, মানুষকে উসকানি দিচ্ছে, রাস্তায় সংঘর্ষ করছে। এখন ১০ মাস পার হয়ে গেছে, এর মধ্যে দলটির কেউ অনুশোচনা, দুঃখ প্রকাশ বা দোষ স্বীকার করেনি। বলেনি, কেউ আদেশ দিয়েছে, তাতে কেউ নিহত হয়েছে, আমি এর জন্য দায়ী নই। আমার খারাপ লাগছে যে আমাকে এটার অংশ হতে হয়েছে। তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই। ফলে আমাদের কাছে এটা শেষ, কিন্তু তাদের কাছে এটা এখনো চলছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের দাবির মুখে মে মাসে আইন সংশোধন করে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের পথ তৈরি করে ইউনূসের সরকার। আর সেই বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। কেন সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তার একটি ব্যাখ্যা ইউনূস এই আলোচনায় তুলে ধরেন।

ড. ইউনুস বলেন, “আমরা রাস্তায় নিরাপদ বোধ করি না, তারা এই আন্দোলনের নেতাদের হুমকি দিচ্ছে। তাই দেশের নিরাপত্তা, রাজনীতির নিরাপত্তার স্বার্থে, জাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আপাতত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। আমরা শুধু এটুকুই করেছি। আমরা তাদের নিষিদ্ধ করিনি। আমরা কিছুই করিনি, যতক্ষণ না বিচার শেষ হচ্ছে। এখন কেবল ওইসব মানুষের বিচার চলছে যারা অভিযুক্ত।”

ইউনূস বলেন, এখন যদি এই বিচার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দিতে বলা হয়, তাহলে সেটা ‘ঠিক হবে না’।

বিচার, সংস্কার আর নির্বাচন–এই তিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অন্তর্র্বতী সরকারের দায়িত্ব পালনের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “যারা আমাদের দায়িত্ব নিতে বলেছে, তারা আমাদের তিনটি কাজ দিয়েছে। আমরা সেই তিনটি কাজ গ্রহণ করেছি, এবং সেই পথেই এগোচ্ছি।”

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়নের যে অভিযোগ কেউ কেউ করছে, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিক্রিয়া জানতে চান সঞ্চালক।

উত্তরে ইউনূস বলেন, “এটা মিথ্যা। একেবারে সত্য নয়। তারা এর আগে কখনো এত স্বাধীনতা পায়নি। তারা যা খুশি বলতে পারছে।”

অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, জুলাই মাসে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে জুলাই চার্টার ঘোষণা করে তার ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন হবে।

সংস্কারের বিষয়গুলো গণভোট দেওয়া হচ্ছে না কেন– এ প্রশ্নের উত্তরে ইউনূস বলেন, অনেকে মনে করেন গণভোট অর্থহীন।

“কারণ অনেকে বুঝবেন না যে কেন এই গণভোট। সে কারণে দলগুলো সবাই সম্মত হলে সেটা হবে বেশি বাস্তবসম্মত।”

নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে বাংলাদেশে যে বিতর্ক চলছে, সে বিষয়টি সামনে এনে সঞ্চালক বলেন, “সব মিলিয়ে অনেকে বলছেন, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না।”

জবাবে ইউনূস বলেন, এটা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের ‘সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন’।

"সময় ঠিক আছে, জনগণও প্রস্তুত। সতের বছর পর আপনি একটি সত্যিকারের নির্বাচন পাচ্ছেন। দেশের মানুষের মনে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে যে তারা সত্যিই ভোট দিতে যাচ্ছে।”

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আগামী নির্বাচন একটি নতুন সরকার নির্বাচনের রুটিন ভোট হবে না, এটা হবে ‘নতুন বাংলাদেশের’ জন্য ভোট।

“আমরা পুরনো বাংলাদেশকে বিদায় বলে নতুন বাংলাদেশ তেরি করতে চাই," বলেন তিনি।

একজন ব্রিটিশ বাংলাদেশী ব্যবসায়ী তার প্রশ্নে বলেন, বাংলাদেশে যেখানে শেখ হাসিনার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ভারত সেখানে তাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। ইউনূস যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা অন্যান্য দেশের মাধ্যমে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন কি না।

জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি যখন প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাথে কথা বলি, তাকে অনুরোধ করি, আপনি যদি তাকে আশ্রয় দেন, সেটা আপনার বিষয়, কিন্তু দয়া করে নিশ্চিত করুন সে যেন বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশ্যে কথা না বলে।

“কারণ সে (হাসিনা) ঘোষণা দেয় যে এই তারিখে এই সময় সে কথা বলবে,আর এতে পুরো বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ হয়।ৃ আর মোদীর জবাব ছিল, ‘এটা সোশ্যাল মিডিয়া, আমরা কন্ট্রোল করতে পারি না’।”

তাহলে অন্তর্র্বতী সরকার শেখ হাসিনার বিচারের বিষয়টি পরবর্তী সরকারের জন্য ছেড়ে দিচ্ছে কি না, তা জানতে চান সঞ্চালক।

উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এটা চলতে থাকবে। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাকে (হাসিনাকে) সেখানে হাজিরার নোটিস পাঠানো হয়েছে। এখন ইন্টারপোল ও অন্যান্য মাধ্যমে এগোনো হবে। আমরা চাই এই প্রক্রিয়াটা হোক আইনসম্মত ও সুশৃঙ্খল। আমরা আবেগ থেকে কিছু করতে চাই না।”

ইউনূস বলেন, “আমরা প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। কিন্তু ৃ ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে প্রচুর ভুয়া খবর আসে, যেগুলোর সঙ্গে উপরমহলের সম্পর্ক আছে বলে অনেকেই মনে করেন। এগুলোই বাংলাদেশের রাগ, ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে।

“আমরা যতই শান্ত থাকতে চাই, হঠাৎ করে আবার কিছু একটা ঘটে, রাগটা ফিরে আসে।

এখন আমাদের বড় কাজ হল অন্তত একটা শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা, যাতে আমরা আমাদের স্বপ্নের দেশ গড়ে তুলতে পারি।”

একজন আইনজীবী জানতে চান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে ২০২৬ সালের এপ্রিলের মধ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য, ন্যায্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকবে–এ বিষয়ে ইউনূস কতটা আত্মবিশ্বাসী।

জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top