মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

শরীফ থেকে শরীফার গল্পটা আসলে কী?

কেন পাঠ্যবই ছিঁড়ে চাকরি হারালেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক?

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৩ জানুয়ারী ২০২৪, ১২:২৫

ছবি: সংগৃহীত

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফির খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব। দেশের নতুন শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়ে নিয়ে সমালোচনা করায় চাকরি হারিয়েছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে সব মহলেই চলছে তুমুল সমালোচনা। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বেশ সরগরম।

সোমবার (২২ জানুয়ারি) ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিআরও (জনসংযোগ) শাখা থেকে জানানো হয়, আসিফ মাহতাব ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তার সাথে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কোনো চুক্তি নেই।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তার কর্মী এবং তাদের চুক্তির গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ক্যাম্পাসে সবার মাঝে সহযোগিতামূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করে।

এর আগে, রোববার (২১ জানুয়ারি) ফেসবুকে আসিফ মাহতাব একটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে আর ক্লাস নিতে না যাওয়ার জন্য মোবাইলফোনে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত তিনিও আর ক্লাসে ফিরছেন না।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে আসিফ আরো লিখেছেন, আজকে আমি ব্র্যাকে রেগুলার ক্লাস নিয়েছি। আমাকে (রোববার রাত ১১টা) ফোন করে জানানো হয়েছে, আমি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ক্লাস না নিতে না যাই। আমি জানি না, হঠাৎ কেন তারা এই সিদ্ধান্ত নিলো। আমাকে কোনো কারণ জানানো হয়নি।

এদিকে, রোববার রাতে শিক্ষক আসিফ মাহতাবের সঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তার ফোনালাপের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কল রেকর্ডে শোনা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই কর্মকর্তা শিক্ষক আসিফকে আগামীকাল (সোমবার) থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাওয়ার প্রশাসনিক সিদ্ধান্তটি জানাচ্ছেন।

তখন শিক্ষক আসিফ এ কলের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিপরীত পাশে থাকা ব্যক্তির কাছে অফিসিয়াল বার্তার কথা জানতে চান। তিনি বলেন, আগামীকাল আমার ক্লাস আছে। সেক্ষেত্রে আমাকে এটার সত্যতা নিশ্চিত করে পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিপরীত দিক থেকে বলতে শোনা যায়, একচুয়ালি আমি এ সেকশনেই আছি। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আমাকে আপনার এ তথ্য জানানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমি আপনাকে সে তথ্যটাই জানিয়ে দিলাম। যদি অফিসিয়াল কোনো নোটিশ থাকে, পরে সেটি শেয়ার করবো।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফাতিয়া বলেন, তার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে। কেন তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। সেখানে বিষয়টি পরিষ্কার করা হবে।

জানতে চাইলে আসিফ মাহতাব বলেন, তারা বিজ্ঞপ্তিতে আসল ঘটনাই বলেনি। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নিয়ম হলো- কয়েকটি ক্লাস করানোর পর চুক্তি করে। আমি এরই মধ্যে একটি ক্লাস করিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল, সেটি সবার বোঝার কথা।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তিনি বলেন, আমি বাচ্চাদের পক্ষ নিয়েই কথাগুলো বলেছি যে, বাচ্চারা ভালো কিছু শিখছে না। কিন্তু, ব্র্যাক যেই সিদ্ধান্ত নিল, সেটি অনৈতিক।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অনেক আগ থেকেই ট্রান্সজেন্ডার নীতি প্রচারে অর্থ বিনিয়োগের অভিযোগ ছিল। তাদের এমন সিদ্ধান্তে সেটি এবার প্রমাণ হলো। এখন মানসিকভাবে প্রস্তুত নই, তাই কোনো পদক্ষেপের কথা ভাবছি না।

এদিকে ই-মেইল ডিজেবলের একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করে তিনি লিখেছেন, আমার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ই-মেইল ডিজেবল করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

গত শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে আয়োজিত বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক : বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে অংশ নেন শিক্ষক আসিফ মাহতাব।

অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ট্রান্সজেন্ডারের গল্প ঢুকিয়ে শিক্ষার্থীদের মগজধোলাই করা হচ্ছে। এসময় তিনি এই পাঠ্যবই থেকে ‘শরীফ থেকে শরীফা হওয়ার গল্পের পাতা ছিঁড়ে ফেলেন।

জাতীয় শিক্ষক ফোরামের ওই সেমিনারে আসিফ মাহতাব উৎস বলেন, ছোটবেলায় যখন নূহ (আ.) এর গল্প শুনি তখন ঈমানি দুর্বলতার কারণে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো কীভাবে একটা জাতি একটা রাষ্ট্র সমকামী হতে পারে? যারা সমকামী না তাদের সমকামী হওয়ার জন্য প্রেশার দিতো।

আমি ইংল্যান্ড থেকে লেখাপড়া করেছি। আমেরিকায় ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৪০ শতাংশ সমকামী। আমাদের বাবা-মা জমি-জমা বিক্রি করে বিদেশে পাঠাচ্ছেন। আমরা হাসি দিচ্ছি, ছেলে নিজেকে মেয়ে মনে করছে। এই হাসি আমেরিকানরা ১০০ বছর আগে দিয়েছিল।

কিন্তু এখন আমরা দেখছি তাদের ছেলে-মেয়ে দু’জনের মধ্যে একজন সমকামী। বাংলাদেশে এটা আসছে। সলিমুল্লাহ খান স্যার সবসময় একটা কথা বলেন, বুদ্ধিজীবীরা সেল আউটি। আমি কথা বলছি। আমার চাকরি চলে গেলে কি আপনারা আন্দোলন করবেন? কিন্তু আমি কথা বললে আমার চাকরি চলে যেতে পারে।

অনেকেই বলে ওরা এলিট সোসাইটি। এলিট সোসাইটি একটা সময় রিলেশনশিপ করতো। এখনতো আপনার আমার ছেলে- মেয়েরাও রিলেশনশিপ করে। একটা সমাজে এলিট সোসাইটির মধ্যে এটা ছড়িয়ে পড়লে একটা সময় পর সমাজের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের এখনি থামাতে হবে।

বাংলাদেশের নতুন আইন প্রচারিত হচ্ছে- আইন হবে যেসব ছেলে বা মেয়ে ট্রান্সজেন্ডার এদের স্বীকৃতি দেয়া হবে। এর বিরুদ্ধে কথা বললে, আপনার শাস্তি একবছরের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। এই আইন পাস হলে আমরা ধ্বংস।

বাংলাদেশের ধর্ষণ আইনে বলা হয়েছে, ছেলে যখন মেয়েকে ধর্ষণ করে তখন সেটা ধর্ষণ। এখন যদি সে ধর্ষণ করে নিজেকে মেয়ে দাবি করে তাহলে বিচার হবে না। আমরা ধর্ষণ আইন প্রচার করছি। ট্রান্সজেন্ডার আইন পাস করলে তারা বলবে আমি মেয়ে।

এরপর তিনি বইটি হাতে নিয়ে বলেন, শরীফ-শরীফার গল্প একটু পড়ে শুনাই। ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলতো। আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। একটা ছেলে যদি মেয়ে হয় তাহলে তার বিয়ে হবে কার সঙ্গে? আমাদের দেশে সমকামী বৈধ? এটা দিয়ে সমকামিতার বৈধতা দেয়া হচ্ছে।

আপনারা জানেন অনেক সময় ছেলেরা ছোটবেলায় মেয়েদের পোশাক পরে। এরপর আমরা তাদের শুধরিয়ে দেই। এখনতো আপনি আর পারবেন না। যেটা ইংল্যান্ড-আমেরিকায় করা হচ্ছে। 

এরপর আসিফ মাহতাব উৎস সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইটি হাতে নিয়ে বলেন, বইয়ের দোকানে যাবেন, বইটি কিনবেন। ৮০ টাকা দিয়ে আমি কিনেছি। এইযে শরীফ-শরীফার যে গল্পটা আছে এটা ছিঁড়বেন। যাতে সচেতন হয়।

এরপর বলবেন এটা অর্ধেক দামে বেচো। আমাদের প্রতিবাদ এটা হতে পারে। আমার টাকা দিয়ে আমি ছিঁড়বো। আমরা যদি ছিঁড়ে ফেসবুকে আপলোড করি কার কী? এটা আমার ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার পাঁয়তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসিফ মাহতাবের এমন কর্মকাণ্ডে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় তার বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারে। এদিকে জাতীয় শিক্ষক ফোরামের একটি সূত্র জানিয়েছে, উৎসের সঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যে আচরণ করেছে এর প্রতিবাদে তারা সোচ্চার হবেন। প্রয়োজনে জোরালো কর্মসূচিও আসতে পারে।




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top