রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কেন হিন্দু হয়েও রমজানে রোজা রাখেন পার্থসারথি বোস?

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১৪:৫৩

ছবি: সংগৃহীত

এটা এক সম্প্রীতির গল্প।পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ভিটায় গড়ে উঠেছে মসজিদ। আর তা রক্ষণাবেক্ষণ করছেন হিন্দু পরিবার।

শুধু তাই নয়, সে পরিবারের সদস্য পার্থসারথি বোস নিয়ম করে সিয়াম সাধনার মাসে রোজাও পালন করেন। গেল ১৫ বছর ধরেই রমজানে রোজা রেখে আসছেন তিনি। হিন্দু হয়েও কেন তিনি রোজা পালন করেন? জবাবে পার্থসারথি বলেন, রোজার মাসে আমি যথেষ্ট উপকার পেয়েছি। তাই আমি নিয়ম করে রোজা রাখি।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালের আগে মসজিদের সঙ্গে আমার অত সম্পৃক্ততা ছিল না। বাবাই দেখাশোনা করতেন। কিন্তু সেবার রোজার মাসেই বন্ধু বান্ধবের সাথে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠি। এরপর মদ্যপ অবস্থায় বাইক থেকে পড়ে কাঁধের থেকে ডান হাতটা ভেঙে যায়।

হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা বলে দেন, এ হাঁড় জোড়া লাগবে না। সারারাত ঘুমোতে পারিনি। মনের মধ্যে অনুশোচনা জাগে, আমি বুঝতে পারি রমজান মাসে আমি অন্যায় করে ফেলেছি। পরদিন সকালেই মসজিদের এসে কেঁদে ফেলি।

তিনি বলেন, মসজিদে এসে (স্রষ্টার কাছে) বলি আমার ভুল হয়ে গেছে আর কোনোদিন হবে না। আমাকে তুমি শাস্তি দিয়েছো। আমি সেই ছেলে হব, যে রমজান মাসে রোজা রাখবে। আর কোনোদিন জীবিত থাকা অবস্থায় রোজা ভাঙব না। আমার এই হাত জোড়া লাগিয়ে দাও, এই বলে মসজিদের মাটি আমার হাতে লাগাই। এরপর আমার হাত ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। হাড়েও জোড়া লেগে যায়।

পার্থসারথি বলেন, এই মসজিদ আমাকে এমন শিক্ষা দিয়েছে, যে এই মাসটা আমাকে ভালো থাকতেই হবে। আর ভালো থাকার উপায় হলো রোজা। সারাদিন রোজা রেখে এই সময়টা মসজিদে পড়ে থাকি। এ সময় আমার মনে কোনো শয়তানই আসে না, বাজে চিন্তা পোষণ করতে পারি না। কারণ আমার মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে। যদি আবার ভুল করি বা কিছু অন্যায় করি তাহলে আমার আবার ক্ষতি হবে। তারপর থেকেই রোজা রেখে আসছি, বললেন পার্থসারথি বোস।

১৯৬০ সালে সম্পত্তি বিনিময় প্রথার মাধ্যমে খুলনার আলকা গ্রাম থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন পার্থসারথির দাদা নিরদকৃষ্ণ বোস। ওঠেন বারাসাতে। বাস্তুভিটাতেই সন্ধান মিলে এক জীর্ণকায় মসজিদের।

ট্রাংকলের মাধ্যমে ভারত ছেড়ে খুলনায় চলে যাওয়া মুসলিম পরিবারের কাছে নিরদ জানতে চান, বাস্তুতে একটি মসজিদের স্থাপত্য পাওয়া গেছে। কি করা উচিত? বোস পরিবারকে খুলনার বাসিন্দা ওয়াজউদ্দিন মোড়ল জানিয়ে দেন, এখন সেটা আপনাদের সম্পত্তি। ফলে রাখবেন না ভেঙে দেবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু ধর্মপ্রাণ বোস পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, বাস্তুতেই থাক শতাব্দী প্রাচীন মসজিদটি। এমনটাই জানিয়েছেন, পার্থসারথির বাবা দীপক কুমার বোস।

নিরদের ছোট সন্তান দীপক কুমার বোসের বয়স এখন ৮২ বছর। ১৯৬৪ সালের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বিনিময় প্রথার মাধ্যমে বারাসাতে বাবা এই মুসলিম সম্পত্তি কিনেছিলেন। তখন আমি ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি। তখন মসজিদটি ভাঙাচোরা জীর্ণকায় স্তূপে পরিণত ছিল। চারিদিকে ছিল আগাছা এবং সাপেদের বাসস্থান। সে আমলে মহল্লার লোকেরাও বলেছিলেন, মসজিদটা ভেঙে দাও।

কিন্তু বাবার ছিল চরম অমত। তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, মসজিদ যেই রকম আছে সেরকমই থাকবে। যদি আমার সাধ্যে কুলায় মেরামত করব। এরপর গঙ্গা পদ্মা দিয়ে বয়ে গেছে বহু পানি। আমার বাবা ছিলেন নিরেট ধার্মিক। নিজের ধর্মকে ভালোবাসতেন বলে অপরের ধর্মকে চিরকাল শ্রদ্ধা করে গেছেন।

দীপক কুমার বোস আরও বলেন, এরপর দেখাশোনা করতেন আমার বড় ভাইরা। দূরদূরান্ত থেকে দু-চারজন করে মুসলিমরা শুক্রবারে নামাজ পড়তে আসতেন। ধীরে ধীরে এই হিন্দু মহল্লায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মসজিদটি। আমরা নাম দিই আমানতি মসজিদ। একে একে ভাইয়েরা প্রয়াত হন। আমি সকলের ছোট, তাই আমার ওপর পড়ে মসজিদে দায়িত্ব।

তিনি বলেন, আমার এমন ভাগ্য যে, ভাইদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারায় এই জমি ভাগ আমার পড়ে। অন্য ভাইদের মধ্যে পড়লে কে কি করত জানি না। কিন্তু আমি জীবিত থাকতে এই জমি কোনোদিন আর হস্তান্তর হবে না।

আক্ষেপের সুরে বলেন, দুঃখ লাগে চারিদিকে এখন শুধু বিভাজন। আমার কাছ থেকে যারা ভোট চাইতে আসেন, তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, আমার পাশে একজন মুসলিমকে দাঁড় করাও। দুজনের হাত কাটো। রক্ত দেখে বলতে পারেন কে হিন্দু কে মুসলমান? তাহলে আমি আপনাদের ভোট দেব। আদতে সবাই মানুষ। মানুষের সেবা আমাদের ধর্ম।

মসজিদের দায়িত্বে আছেন দীপক কুমার বোসের ছেলে পার্থসারথি বোস। তিনি জানান, এই মসজিদের দায়িত্বে এখন আমি আছি। সবার সহযোগিতায় মসজিদ নতুনভাবে গড়ে উঠছে। দুটো মিনার হয়েছে। ঈদের আগে খসে যাওয়া প্লাস্টারগুলো ঠিক করব। আমাদেরই অঞ্চলে হিন্দু মুসলমান মিলেমিশে থাকি।

বারাসাত ৮ নম্বর ওয়ার্ডে হিন্দুদের বসবাস। কোনো মুসলিম ভোটার নেই। ফলে পার্থসারথিদের আমানতি মসজিদে নামাজ পড়তে মুসল্লিরা আসেন দূরদূরান্ত থেকে।

পার্থর অভিমত, বাবার দৌলতে ১৯৬০ সাল থেকে এই ওয়ার্ড যথেষ্ট শান্তিপ্রিয়। ওয়ার্ডে এই মসজিদের সাথে এখন সকলের সম্পৃক্ততা আছে। মায়ের পেটে যেমন শিশু থাকে, বলতে পারেন এই মসজিদ আমাদের সন্তান। সেভাবেই আগলে রেখেছি আমরা সকলে।

পার্থ জানান, আমার পরিবারে কেউ রোজা রাখেন না। কিন্তু সকলেই আমাকে সহযোগিতা করেন। ফজরের আগেই আমাকে আমার স্ত্রী জাগিয়ে দেয়। কয়েকটা খেজুর আর এক কাপ চিনি ছাড়া রং চা দিয়ে সেহরি সারি। সারাদিন কাজের ফাঁকে পড়ে থাকি মসজিদে। ইফতারিতে রাখি হালকা খাবার। খেজুর, পাঁচ রকম ফল মুড়ি আর ঘুগনি।

মসজিদটি পার্থসারথিদের বাস্তুতে অবস্থিত। ফলে এখনো তার মালিকানা বোস পরিবারের। আর সে কারণে রাজ্য সরকারের মুসলিম সংখ্যালঘু প্রকল্পের কোনো সুবিধাই পান না তারা।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top