আমাজনে যেভাবে ৪০ দিন বেঁচে ছিল ৪ শিশু, জানলে অবাক হবেন
রাজিউর রেহমান | প্রকাশিত: ১৪ জুন ২০২৩, ০২:৪৮
কলম্বিয়ায় আমাজন জঙ্গলের গভীরে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছিল এক মাসেরও বেশি সময় আগে। এতে নিখোঁজ চার শিশুর সন্ধানে টানা উদ্ধারকাজ চলেছে। অবশেষে ৪০ দিন পর চারজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনাকে ‘অলৌকিক’ বলছেন অনেকেই। অনেকের মনে প্রশ্ন, এত দিন কীভাবে বেঁচে ছিল চার শিশু?
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টানা ৪০ দিন গভীর জঙ্গলে থাকার পরও এই চার শিশু বেঁচে ছিল ওদের নানির কল্যাণে। এই চার শিশুর সবচেয়ে বড়জনকে ওদের নানি খুব ছোটবেলা থেকে গভীর জঙ্গলে মাছ ধরা ও শিকারের কলাকৌশল শিখিয়েছেন।
কলম্বিয়ার সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই চার শিশু কাসাভার (বাংলাদেশে শিমুল আলু বা কাঠ আলু নামে পরিচিত) ময়দা খেয়ে বেঁচে ছিল।
সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র পেদ্রো আর্নুলফো সানচেজ সুয়ারেজ বলেছেন, ‘বিমান বিধ্বস্তে নিখোঁজ চার শিশু প্রায় ৩ কিলোগ্রাম (৬ পাউন্ড) ‘ফারিনা’ খেয়েছিল। এই খাবার তাদের সঙ্গেই ছিল। ভ্রমণের দিন তারা বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে বেরিয়েছিল। কিন্তু খাবার শেষ হয়ে যাবার পর তারা এমন এক জায়গা খুঁজে নিয়েছিল যেখানে তারা বেঁচে থাকতে পারবে।’
ফারিনা একটি কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার। সাধারণত ভুট্টা বা কাসাভার ময়দা থেকে এই খাবার তৈরি করা হয়। আমাজনের আদিবাসীদের কাছে এটি খুবই জনপ্রিয় খাদ্য।
সুয়ারেজ বলেন, আমরা যখন তাদের উদ্ধার করি তাদের বেশ দুর্বল দেখালেও পুরোপুরি সচেতন ছিল। তিনি আরও বলেন, আদিবাসী হওয়ায় তারা জঙ্গলের এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছিল। শিশু হলেও তারা জানতো কোনটা খাওয়া যাবে আর কোনটা যাবে না। এছাড়া পানির সন্ধান পাওয়ায় তারা জীবিত ছিল। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশ শক্তিশালী।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লেসলি জ্যাকবোম্বায়ার মুকুতুয় (১৩), সোলেনি জ্যাকবোম্বায়ার মুকুতুয় (৯),তিয়েন রানোক মুকুটুয় (৪) এবং ১ বছর বয়সী ক্রিস্টিন রানোক মুকুতুয়কে শনিবার কলম্বিয়ার বিমানবাহিনীর বিমান অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে আনা হয়। বর্তমানে তারা বোগোটার একটি হাসপাতালে রয়েছে। তারা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে।
গত ১ মে আমাজন বনের একটি এলাকা থেকে কলম্বিয়ার অন্যতম শহর সান হোসে গুয়াভাইরো শহরের উদ্দেশে একটি বিমান যাত্রা করে। কিন্তু যাত্রাপথে বিমানটি কলম্বিয়ার ক্যাকুয়েটা ও গুয়াভিয়ারে প্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিধ্বস্ত হয়।
বিমান যেখানে বিধ্বস্ত হয়েছিল সেখান থেকে সামরিক বাহিনী ওই চার শিশুকে উদ্ধার করেছে। সামরিক বাহিনী উদ্ধার অভিযানে উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরও তাদের সহযোগিতা করে। জঙ্গলে বেঁচে থাকার তাগিদে শিশুদের খাওয়া ফলের উচ্ছিষ্ট তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে কাজে লেগেছে বলে জানা যায়।
সামরিক বাহিনী জানায়, উদ্ধারকারীরা লাঠি ও ডালপালা দিয়ে তৈরি ঘরের মতো একটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র দেখতে পান। তারা ধারণা করেন যে সেখানে কেউ জীবিত আছেন।
সামরিক বাহিনী প্রকাশিত ছবিতে জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রের ডালপালার সঙ্গে একটি কাঁচি এবং চুল বাঁধার ফিতা দেখতে পায়। এর আগে বাচ্চাদের পানির বোতল এবং একটি আধা-খাওয়া ফল খুঁজে পেয়েছিলেন উদ্ধারকারীরা।
সামরিক বাহিনী জানায়, শিশুরা একসঙ্গে ছিল। জঙ্গলের ভেতর তারা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করছিল। ওই বিমান দুর্ঘটনায় চার শিশুর মা ম্যাগডালেনা মুকুতেই ভ্যালেন্সিয়া, পাইলট হার্নান্দো মুর্সিয়া মোরালেস ও ইয়ারুপারি উপজাতি গোষ্ঠীর নেতা হারম্যান মেন্দোজা হার্নান্দেজ নিহত হন।
শিশুরা এখনো দুর্বল জানিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইভান ভেলাসকুয়েজ বলেন, শিশুদের রিহাইড্রেট করা হচ্ছে তবে তারা এখনও খাবার খেতে পারছে না। এদিকে উদ্ধার তৎপরতার দায়িত্বে থাকা জেনারেল পেদ্রো সানচেজ জানান, দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৫ কিলোমিটার (৩ মাইল) দূরে একটি ছোট পরিস্কার জঙ্গলে শিশুদের পাওয়া যায়। উদ্ধারের সময় তারা খুবই দুর্বল অবস্থায় ছিলো।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো এই চার শিশুদের "বেঁচে থাকার উদাহরণ" বলে অভিহিত করেছেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে তাদের এই যাত্রা "ইতিহাসে থাকবে।"
সেসনা ২০৬ একটি ছোট হালকা ধরণের বিমান। এই পাঁচ জনের সাথে দুজন পাইলটসহ মোট সাতজন নিয়ে বিমানটি ক্যাকুয়েটা প্রভিন্সের জঙ্গলাকীর্ণ আরারাকুয়ারা বিমানবন্দর থেকে ওড়ে। তাদের গন্তব্য ছিল কলম্বিয়ার জঙ্গলের উপর দিয়ে ৩৫০ কিমি দূরের শহর সান হোসে দেল গুয়াভিয়ারে।
কিন্ত বিমানটি আকাশে উঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই এর পাইলট ইঞ্জিনের ত্রুটির কথা জানিয়ে সংকেত পাঠান এবং এরপর রাডার থেকে বিমানটি হারিয়ে যায়।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, আমাজন জঙ্গলের এই অংশে জাগুয়ার, সাপ ও অন্যান্য ভয়ংকর প্রাণী ছাড়াও বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীরও তৎপরতা রয়েছে। স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায় ও কলম্বিয়ান আর্মি মিলে বিমানটির খোঁজে গভীর জঙ্গলে অভিযান শুরু করে। অবশেষে মে মাসের ১৫ তারিখে দুর্ঘটনার দুই সপ্তাহ পর জঙ্গলে বিমানটির দেখা মেলে।
এটিকে খাড়াভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। দুই পাইলট ও শিশুগুলোর মা ম্যাগডেলিনার মরদেহ মেলে। কিন্তু বাচ্চাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে সঙ্গে থাকা শিকারী কুকুর প্রথমে বাচ্চাদের পানি খাওয়ার একটি বোতল শনাক্ত করে।
এরপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আধ খাওয়া ফল, জামা কাপড়সহ নানা প্রাণের অস্তিত্ব ধরা পড়ে উদ্ধারকারীদের চোখে। খোঁজ শুরু হয়। বাচ্চাদের জীবিত ফেরত পাওয়ার আশায় জোরালো করা হয় উদ্ধার অভিযান।
উদ্ধারকারী দল বিমান থেকে জঙ্গলের ভেতর স্প্যানিশ ও হুইতুতো ভাষায় লেখা বার্তা ফেলতে থাকে যেন বাচ্চারা একসাথে থাকে এবং বিভিন্ন দিকে ঘোরাফেরা না করে। একইসাথে তার নানির কন্ঠেও এই কথাগুলি রেকর্ড করে বাজানো হয় জঙ্গলজুড়ে।
কলম্বিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের শেয়ার করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, উদ্ধারকৃত শিশুদের অন্ধকার জঙ্গল থেকে একটা হেলিকপ্টারে তোলা হচ্ছে। এরপর তাদের রাজধানী বোগোটায় উড়িয়ে আনা হয়। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয় বাচ্চাদের।
বিষয়: আমাজন জঙ্গল উড়োজাহাজ জীবিত উদ্ধার
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।