সিরিয়ায় ৫৩ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:২২

ছবি: সংগৃহীত

সিরিয়ার 'স্বৈরশাসক' প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং সিরিয়া এখন মুক্ত বলে ঘোষণা করেছে দেশটির বিদ্রোহীরা। এর আগে বার্তাসংস্থা রয়টার্স সিরিয়ার দুইজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট আসাদ অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে রাজধানী দামেস্ক ছেড়েছেন।

সিরিয়ায় এই অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের একটি ইসলামিক সশস্ত্র গোষ্ঠী বলেছে, একটি অন্ধকার যুগের অবসান হলো এবং নতুন যুগের সূচনা ঘটেছে।

তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত এলাকা থেকে বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা হুগো ব্যাচেগা বলেছেন, আসাদ বিদায় নেওয়ায় বহু মানুষ খুশি কিন্তু এরপরই একটি প্রশ্ন নিশ্চিতভাবে আসবে যে এরপর কী হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামপন্থী বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত এইচটিএস- যাদের রুট হলো আল-কায়েদা। বহুবছর ধরেই তারা নিজেদেরকে জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টা করছে। তবে অনেকেই এটা মানতে রাজি নন।

তাদের মতে, গ্রুপটি এখনো চরমপন্থী সহিংস একটি সংগঠন এবং সেই কারণেই এরপর দেশটিতে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাশার আল-আসাদের সহযোগী হিজবুল্লাহ সিরিয়ার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে তাদের সেনাদের সরিয়ে নিচ্ছে।

ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছে, তারা হোমস ও দামেস্ক শহর থেকে সৈন্যদের প্রত্যাহার করছে। ওদিকে রয়টার্স জানিয়েছে, লেবানন সীমান্তের কাছে সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় কুসেইর শহর থেকেও হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা সরে যাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা দ্যা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) খবর দিয়েছে, সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীর শত শত সদস্য তাদের সামরিক পোশাক খুলে ফেলেছে।

এর আগে তাদের বলা হয়েছে, সরকারের পতন হয়েছে এবং তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একটি ব্যক্তিগত বিমান চলে যাওয়ার পর একই ধরনের আদেশ দামেস্ক বিমানবন্দর এলাকায় থাকা সরকারি বাহিনী সদস্যদেরও দেওয়া হয়েছে।

দ্যা সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক কর্মসূচির সিনিয়র ফেলো নাতাশা হল বিবিসি রেডিও ফাইভ লাইভ'কে বলেছেন, এটাকে সত্যিকার অর্থেই মনে হচ্ছে যে সিরিয়ায় ৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের চূড়ান্ত মুহূর্ত।

সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের শাসন শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকের শুরু থেকে। হল বলেন, প্রেসিডেন্ট আসাদ দামেস্ক ছেড়ে গেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তার মতে, মূলত আসাদের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাশিয়া ও ইরান অন্য ঘটনায় দুর্বল ও মনোযোগ হারানোর কারণেই তার এ পরিণতি হলো।

রাশিয়া কয়েক বছর ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত আর ইরান সমর্থিত দুই গোষ্ঠী হামাস ও হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের হামলায় বিপর্যস্ত। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

হল বলেছেন, সিরিয়ান নব্বই ভাগ মানুষ এখন দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে এবং অনেকেই বাস্তুচ্যুতদের জন্য নির্মিত ক্যাম্পে বাস করে। আমি মনে করি মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

২০১৮ সাল থেকে দেশটি কার্যত তিন ভাগে বিভক্ত, যেখানে বাশার আল-আসাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন, কুর্দি বাহিনী এবং ইসলামি বিদ্রোহীরা বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

একটা সময় পর্যন্ত সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষ করা কঠিন বলে বিশ্বাস করেছেন বিশ্লেষকেরা। বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধ সিরিয়াকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একইসঙ্গে দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু, অবকাঠামোকে ধ্বংস এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে চরম দুর্দশায় ফেলেছে।

এটি এমন একটি মানবিক সংকট তৈরি করেছে যেখান থেকে পুনরুদ্ধারের কোনো সুস্পষ্ট পথ নেই। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সিরিয়ায় যুদ্ধের আগের দুই কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া ৬৮ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ লাখেরও বেশি লোক সীমিত সুবিধা নিয়ে ভিড়ে উপচে পড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। এর বাইরে আরও প্রায় ৬০ লাখ মানুষ দেশটি ছেড়ে পালিয়েছে, যার বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছে লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্কে। এসব দেশে সবমিলিয়ে ৫৩ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী রয়েছে।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে করে রাজধানী দামেস্ক ছেড়ে পালিয়েছেন। আজ রবিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে এমনটাই জানিয়েছেন দেশটির সেনাবাহিনীর দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।তবে দামেস্ক ছাড়লেও তিনি কোথায় গেছেন, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।এর মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ায় শাসক হিসেবে আসাদ পরিবারের আধিপত্য স্থায়ী হয়েছে টানা পাঁচ দশকেরও বেশি।বাবা হাফেজ আল-আসাদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতা পেয়েছিলেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল -আসাদ। হাফেজ আল-আসাদ ১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়া শাসন করেছিলেন। এরপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

২০০০ সালের জুন মাসে তার মৃত্যুর পর পুত্র বাশার আল-আসাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর একই বছরের জুলাইয়ে বাশার আল-আসাদ বাথ পার্টির নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট হন। সেই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কমান্ডারও হন তিনি।

তবে তার শাসনের এক দশক পর, ২০১১ সালে সিরিয়ার জনগণ গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনে নামলে তিনি কঠোর দমননীতি গ্রহণ করেন। আন্দোলন বাড়তে থাকলে আসাদ তার বিরোধীদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করেন এবং দমননীতি জোরদার করেন।এর ফলে দেশটি গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।এই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ নিহত হন।আসাদের বিরুদ্ধে বেসামরিক জনগণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।

যুদ্ধ চলাকালীন সরকার-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নির্বাচন আয়োজন করেন বাশার আল-আসাদ। তবে এই নির্বাচন অনেকের কাছে ‌‘অগণতান্ত্রিক’ বলে বিবেচিত হয়েছে।

যদিও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদ কখনোই বিজয় নিশ্চিত করতে পারেননি। কিন্তু তারপরও তিনি তার সমর্থকদের, বিশেষ করে সংখ্যালঘু আলাওয়াইট সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। অবশেষে রবিবার বিদ্রোহীদের সশস্ত্র অভিযানের মুখে দামেস্ক ছেড়ে পালালেন বাশার আল-আসাদ। সূত্র: ইত্তেফাক, আমাদের সময়

 



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top