ভাসানচর: সাগরের বুকে এক টুকরো শহর
ডেস্ক রিপোর্ট | প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বর ২০২০, ১৪:৫৩
নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভাসানচর, যেন সাগরের বুকে এক টুকরো শহর। ত্রিশ বছর আগেও যে দ্বীপের ওপর দিয়ে জাহাজসহ বিভিন্ন ধরনের জলযান চলাচল করেছে, সেই দ্বীপ এখন বাসযোগ্য।
শুধু কোনরকমে বসবাস নয়- সুউচ্চ বেড়িবাঁধে সুরক্ষিত দ্বীপটিতে জাহাজ ভেড়াবার জেটি, সুবিন্যন্ত সড়ক, সারিসারি ঘর, নান্দনিক নকশার দালান, পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার, চাষাবাদের উপযোগী ভূমি আর রাতে আলোর ঝলকানি-কি নেই সেখানে! এ যেন পরিকল্পিত এক জনপদ। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এই চরটি।
নোয়াখালীর হাতিয়া থানাধীন চর ঈশ্বর ইউনিয়নের অধীন প্রায় ১৩ হাজার একর আয়তনের এই দ্বীপ এখন মানুষের বসবাসের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে সাময়িকভাবে স্থানান্তরের জন্য এই ভাসান চরকে সাজিয়ে তুলতে খরচ হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। এক লাখ রোহিঙ্গার থাকা আর রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন, খেলার মাঠ আর ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের সুযোগও সেখানে তৈরি করা হয়েছে।
ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, ‘১২০টি ক্লাস্টার গ্রাম নিয়ে তৈরি ভাসান চর এক লাখ মানুষের আবাসনের জন্য প্রস্তুত। রোহিঙ্গার সাময়িক আশ্রয়ের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা ভাসানচরে করা হয়েছে। ঢেউ ও জোয়ারের ধাক্কা থেকে তীর রক্ষার জন্য শোর প্রটেকশন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটু ভালোভাবে থাকার জন্য যে সুযোগ সুবিধাগুলো এখানে রাখা হয়েছে, সেগুলো কক্সবাজারের ক্যাম্পে নেই। আমরা অপেক্ষায় আছি, রোহিঙ্গারা এখানে আসবে এবং থাকবে।’
সরেজমিন ভাসারচর ঘুরে দেখা যায়, সাগরের মাঝখানে এক টুকরো সবুজ দ্বীপ, তারই মাঝে লাল রঙের ছাউনি দেওয়া চতুর্ভুজ আকৃতির সারি সারি টানা ঘর আর সাদা রংয়ের বহুতল ভবন মিলিয়ে পরিকল্পিত এক জনপদ। নৌকায় চট্টগ্রামের মূল ভূখন্ড থেকে ভাসানচর যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। আর নোয়াখালী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপটিতে থাকা বিদ্যুৎ ও সোলার প্যানেল, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এবং মোবাইল ফোনের টাওয়ারসহ ভবনগুলো যে কাউকে অবাক করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এখানে প্রতিটি কক্ষে চার জনের একটি পরিবার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রকল্প কর্মকর্তা বলছেন, প্রতিটি ভবনের ১৬টি কক্ষে ১৬টি পরিবার থাকতে পারবে।
জনপদের প্রতি ১২০টি প্লটের জন্য আলাদা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। যা এক হাজার মানুষ এবং ২০০ গবাদি পশুর জন্য তৈরি। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলেছেন, সৌর-চালিত স্ট্রিট লাইট ও সার্বক্ষণিক সিসিটিভির মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ভাসানচরের এই আবাসন প্রকল্প এক লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিতে প্রস্তুত এবং এতে করে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ওপর চাপ কমবে।
এখানে রয়েছে চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, দুটি ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, দুটি স্কুল ও তিনটি মসজিদ যা বাসিন্দাদের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট হবে বলে আশা করা হচ্ছে। খাবার ও অন্যান্য পণ্য সংরক্ষণের জন্য চারটি গুদামের পাশাপাশি বাজার রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। এ ছাড়াও, দ্বীপে দুটি বড় হ্রদ রয়েছে। বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উপযোগী লেবু, নারকেল ও কেওড়াসহ বিভিন্ন গাছ প্রচুর পরিমাণে লাগানো হয়েছে এই দ্বীপে। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা, জাতিসংঘ প্রতিনিধি, আরআরআরসি প্রতিনিধি, রেডক্রস, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে।
সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মোটামুটি সাড়ে ছয় হাজার একর জমিতে এখন আট লাখ ৬০ হাজারের মত রোহিঙ্গার বসবাস। প্রতি বর্গকিলোমিটারে কোনো কোনো অংশে ৩০-৪০ হাজার মানুষকেও থাকতে হচ্ছে সেখানে। এই ঘনবসতির মধ্যে তাদের যেমন মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে, তেমনি স্থানীয়ভাবে নানা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে।
এনএফ৭১/আরআর/২০২০
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।