টেকনাফে ধস-মৃত্যুর ঝুঁকিতে অর্ধলাখ মানুষ

সুজন হাসান | প্রকাশিত: ৩ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৮

ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড় ও টিলাকে কেন্দ্র করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে হাজারো মানুষ। বর্ষা মৌসুম শুরু হলে এসব বসবাসকারীকে নিয়ে বাড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ভারী বৃষ্টিতে টিলা ধসে ক্ষয়ক্ষতি এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। এ বসবাসকারীদের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ হওয়ায় তারা টিলা বা পাহাড়ের পাদদেশের অল্প ভাড়ার ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে চায় না।

আবার কখনও প্রভাবশালীরা দখল টিকিয়ে রাখতে অনেককে পাহাড় বা টিলায় নিম্ন আয়ের মানুষকে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের উচ্ছেদ কিংবা এসব মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম মাইকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

সারা দেশে আগামী চারদিন মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এছাড়া চার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্কতায় এলাকায় করা হয়েছে মাইকিং।

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজার শহর, মহেশখালী, চকরিয়া, উখিয়া, টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। এ বছর বর্ষার শুরুতে কক্সবাজারের আট উপজেলায় পাহাড়ে ফাটল ও ধস দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি পৃথক পাহাড় ধসে ১২ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জুন রাতে উখিয়া উপজেলার পালংখালীতে পাঁচটি স্থানে পাহাড়ধসে স্থানীয় দুই ব্যক্তি ও আট রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার শহরের বাদশাঘোনায় পাহাড়ধসে নিহত হয়েছে এক দম্পতি।

পরিবেশকর্মীরা জানান, জেলা সদর, উখিয়া, টেকনাফ, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীতে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। বর্ষা এলে স্থানীয় প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে সরে যেতে মাইকিং করে। এছাড়া কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তবে জেলায় পাহাড়ে অবৈধ বসতি ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীর সঠিক পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের নয় উপজেলার মধ্যে কুতুবদিয়া ছাড়া বাকি আট উপজেলার এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পাহাড়ের বিস্তীর্ণ বনভূমির একটি বড় অংশ গত দুই দশক ধরে দখল হয়ে গেছে।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে এ বিভাগের অধীন ১৩ হাজার ৩৪৭ একর বনভূমি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিভাগের ৭৬ হাজার ৪৫৭ একর বনভূমির মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে দখলে গেছে ১২ হাজার ৬০৫ একর।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ১ লাখ ২০ হাজার ৫৮৩ একর বনভূমির মধ্যে বড় অংশ হাতছাড়া হয়েছে। এর মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার একর বনভূমিজুড়ে। রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশের পাহাড়েও গড়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‌পাহাড়ে অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে বন বিভাগের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। বেদখল হওয়া বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কক্সবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ কলিম বলেন, ‘‌কক্সবাজারে পাহাড় নিধনের ভয়ানক পরিস্থিতি সম্পর্কে সবাই অবগত। কিন্তু কোনো সংস্থা কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না। এক্ষেত্রে পাহাড় রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর, প্রতিষ্ঠান ও বাহিনীর সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা খুবই প্রয়োজন।’

এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি শিবিরে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত অন্তত ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এসব ক্যাম্পের মধ্যে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নে ৭ থেকে ১১ নম্বর ক্যাম্পে ৫ হাজার ৫০০টি বসতঘর পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ক্যাম্পে পাহাড়ধসে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বেশির ভাগ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে গত তিন বছরে।

এ নিয়ে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়েছে।’

স্থানীয়রা বলেন, বুধবার গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত অতিবৃষ্টির ফলে টেকনাফ উপজেলায় শত শত বাড়ি-ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। বৃষ্টি না কমলে পানিবন্ধি হয়ে থাকবে অর্ধলাখ মানুষ। বর্ষার সময় বৃষ্টি পানি যেসব খাল বা ড্রেন দিয়ে পানি চলাচল করে সে খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া ও বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত স্লুইস গেইট না থাকায় দ্রুত পানি নামতে না পেরে বাড়ি-ঘর তলিয়ে যায়।

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘টানা বর্ষায় পাহাড় ধসের ঝুঁকি রয়েছে। এজন্য তাদের সেখান থেকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রেগুলো খোলা রাখা হয়েছে। আমরা অতিঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের তালিকা তৈরি করছি। এরপর তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। এছাড়া নিরাপদ স্থানে চলে যেতে প্রতিদিন মাইকিং করা হচ্ছে।’

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং ও পৌর সভায় টানা ভারী বৃষ্টিতে ভূমি ধসের ঘটনা ঘটতে পারে এমন ৩২টি পাহাড় ঝূঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় প্রায় সাত হাজার পরিবারের প্রায় অর্ধলাখের কাছাকাছি মানুষ বসবাস করছে। 

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ‘‌পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সতর্ক করে নিয়মিত প্রচার চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির তালিকা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top