যেন দালানের খনি, শুধু দেশে না বিদেশেও হারুনের বাড়ি আছে
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৮ আগষ্ট ২০২৪, ১৮:১০
পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হারুন অর রশীদ ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার। এর আগে ছিলেন ডিএমপির গোয়েন্দাপ্রধান। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন। চাকরির জীবনে তাকে পেছনের দিকে তাকাতে হয়নি। যেখানে হাত দিয়েছেন ‘সোনা’ ফলেছে। তার বিত্তীয় সাফল্য সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। সম্পদে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকেও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। রাজধানীর উত্তরা, গাজীপুর, আশুলিয়া ও কক্সবাজারের টেকনাফে অঢেল সম্পদের মালিক তিনি। বেশ কয়েকটি হোটেল ও রিসোর্টের কর্ণধার তিনি।
আশুলিয়ার নন্দন পার্কেও তার শেয়ার আছে। কিশোরগঞ্জে বেনামে প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের মালিক। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের আশকারায় হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। সিনিয়র অফিসারদের পাত্তা দিতেন না।
উত্তরায় কয়েকটি স্থানে সরেজমিন গিয়ে তার সম্পদের বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে। কিছু সম্পদ আত্মীয়ের নামে কিনেছেন তিনি। কিছু সম্পদ দখল করার অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সুপারিশে তার স্ত্রীর নামে থাকা ১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা আটকে গেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে, নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ব্যাংকের হিসাব শাখায়। ৫ আগস্টের পর থেকে হারুনের খোঁজ মিলছে না। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা হয়েছে। এদিকে গতকাল হারুন ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুদকে আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এই নিষেধাজ্ঞা দেন।
সরেজমিন উত্তরা : গত রবিবার দুপুরে উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ২৬/এফ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, এলাকাটি খুব নিরিবিলি। লেকের পাড়ে ১০ কাঠার ওপর নির্মিত আটতলা বাড়ির টপ ফ্লোরে সপরিবারে বাস করছিলেন ডিআইজি হারুন। বাড়িটির মালিক তিনি। চতুর্থতলা পর্যন্ত ভারতের একটি কোম্পানিকে ভাড়া দেওয়া। পঞ্চমতলায় থাকেন গাজীপুরের এক ব্যবসায়ী। ষষ্ঠতলায় থাকেন কাস্টমসের এক কর্মকর্তা। সপ্তমতলাটি ডুপ্লেক্স। বাসাটি ইউরোপের আদলে সাজানো। সরঞ্জামাদি সব বিদেশি।
নাম প্রকাশ না করে ভবনের একজন নিরাপত্তাকর্মী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সর্বশেষ তিনি ৩ আগস্ট সকালে বাসা থেকে বের হন। ওইদিন তার স্ত্রী ও দুই সন্তান অন্য কোথাও চলে গেছেন। তারা আর আসেননি। হারুন অর রশীদ যখন বাসায় আসতেন তখন কঠোর নিরাপত্তার বলয় থাকত। বাসার আশপাশে সাদা পোশাকধারী পুলিশ থাকত। নায়ক-নায়িকারা নিয়মিত আসত। তার বাসাটি মার্বেল পাথরের।
সরকার পতনের দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে ৪০-৫০ জন যুবক বাড়ির সামনে এসে হারুন স্যারকে খুঁজতে থাকে। তারা জোর করে বাসায় ঢোকে। যুবকরা আমাদের মারধর করে। তারা সাততলায় গিয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে টাকা-পয়সা লুট করে। তবে মালামাল ভাঙচুর করেনি। ৯ আগস্ট যুবকরা আবারও হামলা চালিয়ে লুটপাট করলেও ভাঙচুর করেনি। গত শুক্রবার আবার এলে আমরা প্রতিবাদ করি। তারা আমাদের মারধর করে। কয়েকজন ভাড়াটিয়াকেও মারধর করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তি এ বাড়ির ভাড়া তোলেন। তিনি স্যারের মামা লাগেন। স্যার আমাদের সঙ্গে কখনো খারাপ আচরণ করেননি।’ পাশেই আরেকটি ছয়তলা বাড়ি, হোল্ডিং নম্বর ৩০। বাড়ির সামনে লেখা আছে, ‘এ সম্পত্তি ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, খাজা গরীবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউ শাখা, উত্তরার কাছে দায়বদ্ধ’।
ওই বাড়ির মালিকও তিনি। সেটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কাছে ভাড়া দেওয়া। ট্রানজিট যাত্রী বা বাতিল হওয়া ফ্লাইটের যাত্রীদের এখানে রাখা হয়। বাড়ির কেয়ারটেকার লেবু মিয়া বলেন, ‘হারুন স্যারকে কখনো দেখিনি। তবে শুনেছি বাড়ির মালিক তিনি। বিমানের ভাড়া তোলেন জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তি। পাঁচ কাঠার ওপর বাড়িটি নির্মিত।’
উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়িটি হারুন দখলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন এনায়েত উল্লাহর ছেলে। তিনি বলেন, ‘বাড়িটি আমার বাবার। ১০ কাঠার ওপর একতলা বাড়ি। প্রায় পাঁচ বছর আগে ডিআইজি হারুন বাড়িটি দখলে নেন। বাড়ির সব মালামাল ট্রাকে করে সদরঘাটে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি আমাদের নানাভাবে হয়রানি করেছেন। এখন যদি প্রশাসন বাড়িটি ফিরিয়ে দেয় তাহলে ভালো হয়। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর আমার মা প্যারালাইজড হয়ে যান।’
উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর রোডের ২৯ ও ৩০ নম্বরে দুটি একতলা বাড়ি আছে। একটি গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আরেকটিতে ছোট ছোট ঘর করে ১০টি রুম করা হয়েছে। প্রতিটি রুমের ভাড়া ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা।
বাড়িতে বসবাসকারী বিজয় নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা জানি এ দুটি বাড়ির মালিক জাহাঙ্গীর নামের এক ব্যক্তি। মাঝেমধ্যে তিনি এখানে আসেন। শুনেছি ডিআইজি হারুন তার আত্মীয়। সরকার পতনের পর থেকে গোডাউনটি তালা দেওয়া।’ আশপাশের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, দেশ যখন শান্ত ছিল তখন পুলিশ নিয়ে হারুন স্যার মাঝেমধ্যে আসতেন। তিনি বাড়ির মালিক কি না আমরা জানি না।
উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে ইয়ামাহা নামে একটি মোটরসাইকেলের সার্ভিসিংয়ের শোরুম আছে। নাম প্রকাশ না করে দুজন কর্মচারী বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানি জায়গাটি পুলিশের এক কর্মকর্তার। তার নাম আমরা জানি না। আপনি ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলুন।’ তাকে পাওয়া না যাওয়ায় মোবাইলে কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের শাহ মুকদুম অ্যাভিনিউয়ে ১২ নম্বর প্লটে ‘তাজ ফুডকোর্ট’ নামে একটি রেস্তোরাঁ আছে। এর কর্মচারী মনসুর আহমেদ বলেন, ‘এ জায়গার মালিক ডিআইজি হারুন স্যার নন। প্রকৃত মালিক মাহমুদা খাতুন। তিনি পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় থাকেন। জয়নাল আবেদীন নামে একজনের কাছে ভাড়া দেওয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এটি হারুন স্যারের। তথ্যটি সঠিক নয়।’
এফবিআইয়ের সুপারিশে ১৫৩২ কোটি টাকা আটকা : সূত্র জানায়, কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে তার স্ত্রীর নামে একটি ব্যাংকে থাকা ১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা এফবিআইয়ের সুপারিশে আটকা পড়েছে। সে টাকা উদ্ধার করতে পারেনি হারুন অর রশীদ। কিছুদিন আগে দুদকে একটি গোপন প্রতিবেদন জমা পড়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আশুলিয়ার বারইপাড়ায় নন্দন পার্কে ডিআইজি হারুনের ২০ শতাংশ শেয়ার আছে।
বনানী কবরস্থানের পাশে ২০ কাঠার একটি প্লট ছিল। সেটি তিনি ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। টঙ্গীর ২৭ মৌজায় ৮ বিঘার জমির ওপর নির্মাণ করেছেন জেএক্স জিওটেক্স লিমিটেড নামে একটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান। আশুলিয়ার ছায়াকুঞ্জ-৫ আবাসিক এলাকায় ১২ বিঘার জমির ওপর একটি আবাসিক হোটেল করেছেন। কক্সবাজারের টেকনাফে ৮৮ শতাংশ জমি আছে তার নামে।
পুলিশে চাকরি : জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী হারুন অর রশীদ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চাকরি পান। ২০তম বিসিএসের কর্মকর্তা। ২০০১ সালে তার পদায়ন আটকে দেয় বিএনপি সরকার। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তার চাকরি স্থায়ী হয়।
২০১১ সালে সংসদ ভবনের সামনে তৎকালীন চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নুল আবদিন ফারুককে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হারুন। তারপর তরতর করে পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন হয় তার। তখন থেকেই সব জায়গায় বিতর্কে জড়ান এ পুলিশ কর্মকর্তা। সরকারি স্কেল অনুযায়ী তার বেতন ছিল ৮০ হাজার টাকার মতো। নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের নিউ হাইড পার্ক এলাকায় তার বাড়ি আছে। তিনি ওই দেশের স্থায়ী নাগরিক। সম্পত্তিতে সাবেক আইজিপি বেনজীরকেও হার মানিয়েছেন তিনি।
তার আরও সম্পদ : উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের ৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের ১০ কাঠা প্লটে দশতলা মার্কেট করেছেন শ^শুরের নামে। ৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর হোল্ডিংয়ে সাত কাঠার বাণিজ্যিক প্লট এবং ১৫ নম্বর রোডের ২৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে রয়েছে একটি বাণিজ্যিক ভবন। উত্তরার রবীন্দ্র সরোবরে পাঁচ কাঠার একটি প্লট আছে।
উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে পাঁচ কাঠার একটি প্লট আছে হারুনের। একই সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়ির পঞ্চমতলায় হারুনের একটি অফিস আছে। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের উত্তরা স্মৃতি কেবল টিভি লিমিটেডের পাশে পাঁচ কাঠার একটি প্লট রয়েছে তার। সেটি ভাড়া দেওয়া।
১২ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ২১ নম্বরে আছে ছয়তলা বাড়ি। এটি বন্ধক রেখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ৭৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের প্লটটি ভাড়া দেওয়া। আর ৩ নম্বর রোডের ৪৯ নম্বর প্লটে হারুনের ছয়তলা ভবন রয়েছে। উত্তরা তৃতীয় পর্ব ও পূর্বাচলে কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে।
কিশোরগঞ্জে ৩০ একরের প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট : রিসোর্টটি সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নামে তৈরি করেছেন। কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে এটি দেখাশোনা করেন তার ভাই ডাক্তার শাহরিয়ার। হাওরের জায়গা দখল করে এটি বানানো হয়েছে। এর মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
টাকা পাচারের অভিযোগ : বিদেশে অর্থ পাচারের জন্য হারুন গড়ে তোলেন নিজস্ব মানি এক্সচেঞ্জ। পুরানা পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টসের গলিতে এটির অফিস। দুবাইয়ে এটির শাখা আছে। ১৮ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। হারুন অর রশীদ ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা হয়েছিল ২০২৩ সালের জুলাই মাসে। কিছুদিনের মধ্যে তাকে তলব করার কথা রয়েছে।
গাজীপুরে যত অপকর্ম : গাজীপুর থেকে আমিনুল ইসলাম জানান, গাজীপুরে আতঙ্কের নাম ছিল এসপি হারুন। তার রোষানলে পড়ে সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নিগৃহীত হয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা, সরকারদলীয় নেতা, ব্যবসায়ী ও ধনীর সন্তানরা ছিল তার টার্গেট। গাজীপুরের এসপি থাকাকালে এসব অপকর্ম করতেন ডিবি দিয়ে।
স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা বলেছেন, প্রতি রাতে ডিবির একাধিক দল নেমে পড়ত টার্গেটকৃত ব্যক্তির উদ্দেশে। গাড়িতে মজুদ রাখা হতো ইয়াবা, অস্ত্র ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। সুযোগবুঝে ওইসব জিনিস দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হতো নিরপরাধ ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও ধনী পরিবারের সন্তানদের। সবই হতো হারুনের নেতৃত্বে।
গাজীপুরে এসপি হারুনের চার বছরের রাজত্বে মাদক, আবাসিক হোটেলে দেহব্যবসা ও জুয়ার জমজমাট ব্যবসা চলত। এসব করে তিনি হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। তার আসার আগে গাজীপুরের কোথাও হোটেলে দেহব্যবসা ছিল না। তিনি তার অবৈধ টাকায় গাজীপুরে গড়ে তুলেছেন রিসোর্ট বাগানবাড়ি এবং আবাসিক বিভিন্ন প্লট।
টঙ্গীর সাতাইশ মৌজায় আট বিঘা জমিতে অনুমোদন ছাড়াই নির্মিাত হচ্ছে ‘জেএইচ-জিওটেক্স লিমিটেড’ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীর আশুলিয়া মৌজায় ছায়াকুঞ্জ-৫ আবাসিক প্রকল্পের ভেতরে ১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসিক হোটেল। গাজীপুরের শ্রীপুরে সবুজ পাতা নামে একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট রয়েছে। শ্রীপুরের কাওরাইদে রয়েছে তার ছয় বিঘার জমি। চারপাশ বাউন্ডারিঘেরা।
তার রোষানলে পড়েছে রাজনৈতিক দলের নেতারাও : গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা অধ্যাপক এমএ মান্নান এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার নেপথ্যেও হারুনের ইন্ধন ছিল। জেলার শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা হয়েছে।
মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানকে দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের পৃথক অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে বরখাস্ত করার পেছনে তার অবদান রয়েছে। মান্নানকে গ্রেপ্তারও করে হারুনের পুলিশ। টাকা ছাড়া কিছুই বুঝতেন না তিনি। টাকা না দিলে আওয়ামী লীগের নেতাদেরও হেনস্তা করতেন। ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর গাজীপুর পৌর সুপার মার্কেটের দ্বিতীয়তলার মুক্ত সংবাদ পত্রিকার অফিস থেকে ডিবি পুলিশের সদস্যরা জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যান পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক সোহরাব হোসেনকে।
দৈনিক মুক্ত সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রায়হান বলেন, ‘অফিসে আসার পর জানতে পারি, আমার বাবাকে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়েছে। আমার বাবা একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। আমার বাবার অপরাধ ছিল একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তথ্যবহুল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তার নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করা।’
সাংবাদিক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তিন দশক ধরে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৯ সালের ২ মে সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি পত্রিকা অফিসে বসে কাজ করছিলেন তিনি। হঠাৎই প্রতিবেদন তৈরির জন্য তথ্য দেবে বলে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করে।
তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান ফটকের সামনে থেকে এসপি হারুনের নির্দেশে সাদা পোশাকে থাকা কয়েকজন ব্যক্তি তাকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। ২০ দিন পর পরিবার তার সন্ধান পায়। তারা জানতে পারে সাংবাদিক লতিফকে ৫০০ পিস ইয়াবা দিয়ে চালান করা হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী ৯ মাস জেল খেটেছেন।
‘মুক্ত বলাকা’ নামের পত্রিকায় ২০১৭ সালে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। নিউজটি হারুনের বিপক্ষে যাওয়ার পরের দিন রাতে ২০০ পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করা হয় ওই পত্রিকার সম্পাদক আলমগীর হোসেনের বাড়ি। সেদিন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। পরে তার বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি চালানো ও ভাঙচুর করা হয়। তিনি তিন মাস আর গাজীপুরে ফিরতে পারেননি।
‘মুক্ত বলাকা’র সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘একটি নিউজ করেছিলাম বলে হারুনের কারণে তিন মাস আমি পালিয়ে বেড়িয়েছি।’ কালিয়াকৈরের যুবলীগ নেতা রফিক হত্যার পর ডিবির উৎপাতে কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা, পল্লীবিদ্যুৎ, হরিণহাটিসহ আশপাশের এলাকা প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। শতাধিক লোককে ডিবি আটক করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। এক ব্যক্তিকে দুই-তিনবার আটক করার ঘটনাও ঘটেছে। সূত্র: দেশ রূপান্তর
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।