বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত! প্রস্তুত আছেন তো?

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর ২০২৩, ২২:০০

ছবি: সংগৃহীত

প্রতিনিয়তই যেন আতঙ্ক নিয়ে বাস করতে হয় রাজধানী ঢাকায়। কারণ মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে সারা দেশ। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কাঁপন ধরেছে বাংলাদেশে। এমনিতেই বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। তার ওপর নতুন করে এ খাতায় নাম লিখিয়েছে ভূমিকম্প।

এসব ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ছোট ভূকম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বড় ভূমিকম্পের শতবছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। সে হিসাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বহু পুরোনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করায় ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

ভূমিকম্প কী ও কেন:

পৃথিবী প্লেট ও সাব-প্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দুই প্লেটের মধ্যে যে ফাঁকা থাকে তাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। প্লেটগুলো গতিশীল। দুটি চলন্ত প্লেটের ফল্ট লাইনে পরস্পর সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্ট লাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়।

পৃথিবীর ইন্টারনাল বিহেভিয়ার এবং ইন্টারনালি লেট মুভমেন্ট এনার্জি রিলিজের মাধ্যমে এক প্লেট থেকে অন্য প্লেটে এনার্জি বিনিময় হয় বা কোনো কারণে যখন শক্তির পরিবর্তন হয়, তখনই ভূমিকম্পের মতো ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশে কেন ভুমিকম্প:

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো স্থানে ভূকম্পনের জন্য ফল্টলাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূতত্ত্বের বিশাল খণ্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে ফল্ট বা চ্যুতি লাইন বলা হয়। ফল্টলাইন দিয়ে দুই প্লেটের সংঘর্ষ হলে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশের মূল ভূভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এ রকম কয়েকটি ফল্ট রয়েছে।

আর্থ অবজারভেটরি সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা-এ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। প্লেটগুলো সক্রিয় হওয়ায় প্রচুর শক্তি জমা হচ্ছে সেখানে। ফলে এখানে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা হতে পারে আট।

ছোটো ছোটো ভূমিকম্প কি বড় ভূমিকম্পের আভাস: 

মাঝেমধ্যে ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো বড় বিপদের আগেই সজাগ হওয়ার জন্য ওয়েকআপ কল অর্থাৎ ইশারা। এর ধারাবাহিকতায় প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই ঘন ঘন এ ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এ দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে, যেগুলো বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। আগে হোক বা পরে, এই শক্তি বেরিয়ে আসবেই। আর সেটাই জানান দিচ্ছে এই ছোট ভূমিকম্পগুলো। এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় আকারের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস।  

দেশের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কোন অঞ্চল:

দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি ফল্ট রয়েছে। এসব অঞ্চলগুলো খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ভূমিকম্পের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের উত্তর এবং পূর্বাংশের শহরগুলো। রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রংপুর, ঢাকা, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু অংশ। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের চারটি জেলা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। একইভাবে ময়মনসিংহ বিভাগের পাঁচটি জেলাও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ঢাকা বিভাগের মধ্যে টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী জেলার অংশ বিশেষ, পুরো কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার উত্তরাংশ।

মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের অংশবিশেষ, চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলা। ভূমিকম্পের কম ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পুরো খুলনা ও বরিশাল বিভাগ।

ভূমিকম্পের ইতিহাস কী বলে:

বাংলাদেশে সাত মাত্রার মতো বড় ভূমিকম্প হয়েছে মানিকগঞ্জে ১৮৮৫ সালে। এটার নাম ছিল বেঙ্গল আর্থকোয়াক। আরেকটা হয়েছে শ্রীমঙ্গলে ১৯১৮ সালে, এটার নাম শ্রীমঙ্গল আর্থকোয়াক। শ্রীমঙ্গল আর্থকোয়াকের উৎপত্তিস্থলের আশপাশে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে টাঙ্গাইল, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তবে ওই ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮৭ বার ভূকম্পন হয়। এতে মারা যান ১৫ জন। অবশ্য এর মধ্যে ১৩ জনেরই মৃত্যু হয় আতঙ্কে।

ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড কত বছর:

যেসব অঞ্চলে অতীতে ভূমিকম্প হয়েছে, সেসব অঞ্চলে ভবিষ্যতে আবারও ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ ওই অঞ্চলগুলো টেকটোনিক প্লেটের ফাটল থাকে, যাকে জিওলোজির ভাষায় ফল্ট বলা হয়। সাধারণত এসব ফল্টে একবার এনার্জি রিলিজ হলে শক্তি সঞ্চার হতে একটা দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখা অনুযায়ী, একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে যাওয়ার ১০০ বছর পর ফের বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে একশ বছর পূর্ণ হওয়ার ২০ বছর আগে হলে পূর্বের মাত্রার চাইতে কম মাত্রার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়, আর ২০ বছর পরে হলে তার মাত্রা আগের চেয়ে বেশি হয়।

ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ২০০-২৫০ বছর। ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে আট মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। এরপর ১৮৮৫ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা হয়ত আরও ১০-২০ বছর পর হতে পারে। এ রকম ২০০-২৫০ বছরের যে সাইকেল আছে, সেটি কখন হবে কেউ জানে না।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোন ভূমিকম্পের শক্তি বের হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। কিন্তু কবে বা কখন সেটা হবে, তা এখনো বিজ্ঞানীদের ধারণায় নেই।

ভূমিকম্প নিয়ে লিখেছেন রাজীব রায়হান

গবেষণা কী বলছে:

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের ২০টি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। রিখটার স্কেলে যদি ছয় দশমিক নয় মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে ধসে পড়বে প্রায় আট লাখ ৬৫ হাজার ভবন। মৃত্যু হবে দুই লাখ ১০ হাজার মানুষের, আহত হবেন দুই লাখ ২৯ হাজার মানুষ। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশের যে অবস্থান তাতে আট মাত্রার ভূমিকম্পও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হবে।

সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার ২০০৯ সালে করা এক যৌথ জরিপে বলা হয়, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।

জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় (২০২১-২০২৫) বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে সারা দেশে ছয় কোটি ১২ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়বে। ১১ লাখ নয় হাজার পাকা ভবন, ২১ লাখ ১৪ হাজার সেমিপাকা স্থাপনা, ৪০২টি খাদ্যগুদাম, ১৪টি গ্যাস ফিল্ড, ১৯৫টি হাসপাতাল, এক হাজার আটটি কল্যাণকেন্দ্র, দুই হাজার ৮০০ উচ্চবিদ্যালয়, এক হাজার ৯০০ মাদ্রাসা, ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছয় হাজার ৮০০ পুলিশ স্টেশন, এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, সাত হাজার ৪০০ কিলোমিটার স্থানীয় সড়ক, ২০ হাজার ব্রিজ, এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে তিন লাখ ও সিলেটে এক লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু। সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

জাতিসংঘ যা বলছে:

জাতিসংঘ বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা একটি। এছাড়া বাংলাদেশ পৃথিবীর ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত বিধায় প্রাচীনকাল থেকে এ দেশে মাঝে মধ্যে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। উপরন্তু হিমালয় রেঞ্জ হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। যদিও সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের জনগণ শক্তিশালী ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়নি।

ঢাকায় ভূমিকম্প হলে: 

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা পরিবর্তন করে গড়ে ওঠায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের সময় এ অপরিকল্পিত ভবনগুলো সঙ্গে সঙ্গেই ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভূমিকম্প অসহনশীল ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। আগে থেকে যদি পরিকল্পনা না থাকে তাহলে ওই সময় জরুরি চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার মতো কাজগুলো সামাল দেয়া সম্ভব হবে না এবং মানবিক বিপর্যয় তৈরি হতে পারে।

এরই মধ্যে ঢাকার মানুষজন অনেকটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ওপর বাস করছে। মাকড়সার জালের মতো গ্যাসের লাইনের বিস্তার ঢাকা শহরের মাটির নিচে। কোনো দিন শক্তিশালী ভূমিকম্প হলেই গ্যাস লাইনগুলো ফেটে যাবে। ভূমিকম্পে বিদ্যুতের খুঁটিও ভেঙে পড়তে পারে। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে স্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। সেই অবস্থায় ওপরে আগুন, নিচে দাহ্য গ্যাস- দুইয়ে মিলে ঢাকা একটি অগ্নিকুণ্ডের রূপ নিতে পারে।

রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন রাজধানীকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। হাজার হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। এতে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তুরস্কের মতো বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশেও চোখ রাঙাচ্ছে।

ভূমিকম্প মোকাবিলায় কী ঘাটতি:

আমাদের দেশে ভূমিকম্প বিষয়ে শিক্ষাও তেমন পর্যাপ্ত নয়। মাত্র তিন থেকে চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব পড়ানো হয়। ভূমিকম্প সম্পর্কে নামমাত্র পড়ানো হয় মাঝে মাঝে তাও হয় না। অবশ্য এর কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে হাতেগোনা কয়েকজন আছেন যারা ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করেন। তার মধ্যে অনেকেই দেশের বাইরে থাকেন।

শুধু তাই নয়, ভূমিকম্প সঠিকভাবে পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই বলেই চলে। বাংলাদেশ কিংবা আশপাশে যেকোনো মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার পর রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা জানতে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভূতাত্ত্বিক সংস্থার দিকে।

ভূমিকম্পের এমন ঝুঁকি থাকলেও মোকাবিলার প্রস্তুতি অনেকটাই কম। বহু পুরোনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সঠিক সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। নেচার জিওসায়েন্সে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত ভবন ছাড়াও ভূমিকম্পে ভারী শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হতে পারে।

প্রতিবারই বড় কোনো ভূমিকম্প হওয়ার পরই ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়, যা ধামাচাপা পড়ে থাকে বড় ধরনের আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানার আগ পর্যন্ত। ঘনবসতির ঢাকা শহরটির ভূমিকম্প ঝুঁকি কমাতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও তার বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি।

ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের উৎস দূরে হলেও সব থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে ঢাকায়। কারণ এখানে ঘনবসতি, অপরিকল্পিত-অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন, জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও সরকারের প্রস্তুতির অভাব। সবগুলো উপাদানের দিক দিয়ে এখানে ঝুঁকির পরিমাণটা বেশি। কী ক্ষতি হবে তা কল্পনার বাইরে। ওই রকম ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহর ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সরকার হয়তো বাধ্য হবে এটাকে পরিত্যক্ত নগরী হিসেবে ঘোষণা করতে। কারণ আমাদের এখানে ডিসেন্ট্রালাইনজ করার পরিকল্পনা নেই।  ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের পর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা নেই ঢাকা শহরে।

অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আবাসন ও এনজিওর মতো বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে রয়েছে সমন্বয়ের অভাব। উন্নত ফায়ার ব্রিগেড এবং সিভিল ডিফেন্স কার্যক্রমের মতো সহায়তা সুবিধার অভাব, বিপুলসংখ্যক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের থাকার জন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল, শারীরিক ও মানসিক সহায়তা, অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে যোগাযোগ, পরিবহন যান, পর্যাপ্ত সংখ্যক ড্রিলিং সরঞ্জাম, বুলডোজার ইত্যাদিরও রয়েছে অভাব।

দেশে সম্পূর্ণ ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণের সুবিধা নেই। আবহাওয়া অধিদফতর ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে একটি সিসমিক অবজারভেটরি স্থাপন করে। এটিই দেশের একমাত্র মানমন্দির। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নদী-খাল-পুকুর-জলাশয় ভরাট, প্রকৃতির পেরেক পাহাড় ও টিলা কেটে-খুঁড়ে ধ্বংস, রাস্তাঘাট-সড়ক-গলি, খোলা জায়গা ক্রমাগত বেদখল ও সরু হয়ে যাচ্ছে। পরিণামে বাড়ছে ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা।

কী করতে হবে:

ভূমিকম্প এমনই এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ- সুনির্দিষ্টভাবে দিনক্ষণ জানিয়ে এটা বলা যায় না, কখন হবে। আবার এই দুর্যোগকে ঠেকানোরও কোনো উপায় নেই। কিন্তু সতর্কতা বা প্রস্তুতি বলতে যা বোঝায়, তা হলো ক্ষয়ক্ষতি কতটা কমানো যায়। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া এবং ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় সামগ্রিক প্রস্তুতির কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। এছাড়া ভূমিকম্পের আশঙ্কাকে মাথায় রেখে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করাও জরুরি।

জনগণের দুর্ভোগ, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা কমাতে সরকারি গণমাধ্যম, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও সর্বস্তরের জনগণকে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা গঠনে বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ক্রয় করতে হবে ভুমিকম্প সামলানোর সরঞ্জাম, বিপদ অঞ্চলের বাইরে মাল্টিডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।

এ ছাড়া ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে, কোথায় আশ্রয় নিতে হবে, কোথায় সাহায্যের জন্য ফোন করতে হবে ইত্যাদি বিভিন্ন টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, টকশোতে প্রতিদিন প্রচার করা উচিত। কার্টুনের মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান টিভিতে প্রচার করা যেতে পারে। প্রত্যেক বিল্ডিংয়ে অ্যালার্ম সিস্টেম যুক্ত করা যেতে পারে।

নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে প্রয়োজন পরিকল্পিত নগরায়ন, পাহাড়-টিলা, জলাশয়, নদী-নালা-খাল, ভূমিরূপ, পরিবেশ-প্রকৃতিকে সুরক্ষা, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ কঠোরভাবে অনুসরণ, প্রাক-প্রস্তুতি ও গণসচেতনতা।




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top