বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কে এই কমরেড ফরহাদ ? কী স্বপ্ন দেখতেন তিনি ?

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৯ অক্টোবর ২০২৩, ১৩:২৭

ছবি: সংগৃহীত

মোহাম্মদ ফরহাদের জন্ম ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই। পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার জমাদারপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বৃষ্টির দিনে রাতের বেলায় তার জন্ম হয়েছিল বলে নাম রাখা হয়েছিল বাদল। তার বাবা স্কুলের ভর্তির খাতায় নাম দিয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ মোহাম্মদ ফরহাদ। তাঁর পূর্বপুরুষ পীরে কামেল কদম আলী শাহ্ জলপাইগুড়ি থেকে আগমন করেন।

রাজনীতির পাঠশালায় যখন মোহাম্মদ ফরহাদ নাম লিখিয়েছেন, তখন তার বয়স ১৫ বছর। ১৯৫৬ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এর আগে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যই এ যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।

রাজনৈতিক ছদ্মনাম ছিল কমরেড কবির। পরবর্তী সময়ে যিনি অভিহিত হন বাংলার লেনিন হিসেবে। ভাষাসংগ্রামী কমরেড ফরহাদকে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের মস্তিষ্ক, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের নেপথ্যের স্থপতি, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের নায়করূপে ভূষিত করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর প্রধান সংগঠক।

সমাজ বদলের সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি জীবনের একটা বড় সময় অতিক্রম করেছেন জেল-জুলুম আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন কমরেড ফরহাদ। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান কমরেড ফরহাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেন। মোহাম্মদ ফরহাদের মাথার মূল্য ঘোষিত হয় সেই আমলে এক হাজার টাকা। কবির ভাই নাম ধারণ করে আত্মগোপনে চলে যান তিনি।

৭৫-এর ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর দলের একাংশ যখন ক্ষমতায়, আরেক অংশ যখন পালিয়ে যায়, প্রতিবাদটা প্রথম কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের কৌশলী সিদ্ধান্তে সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের শক্তি দিয়েই উচ্চারিত হয়।

১৯৮০ সালের অক্টোবর মাসে ছয় লাখ নিম্নবেতনভুক্ত সরকারি কর্মচারীর আন্দোলনে জিয়া সরকার মোহাম্মদ ফরহাদকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশে জেনারেল জিয়াকে উদ্দেশ করে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বক্তৃতা করলে মোহাম্মদ ফরহাদের ওপর আবার নেমে আসে নির্যাতন।

১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এরশাদের শিক্ষানীতিবিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে তুলে নিয়ে ১৪ দিন ক্যান্টনমেন্টে নির্যাতন চালান জেনারেল এরশাদ। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদকে পরাস্ত করার কৌশল হিসেবে তিনি দিয়েছিলেন দুই নেত্রীর ১৫০-১৫০ আসনে নির্বাচন করার ফর্মূলা। সেদিন ভীত হয়ে এরশাদ অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন যে কোন প্রার্থী পাঁচটির বেশি আসনে এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।

তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নিপুণ কারিগর। বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব-অবিসংবাদিত নেতা। তার ছিল আকণ্ঠ বিপ্লব পিপাসা। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন নেতাদের নেতা। বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির অগ্রদূত। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে বিশ্বাসী আপাদমস্তক বিপ্লবী। শত নিপীড়নেও যিনি সংগ্রামী জীবন ও আদর্শচ্যুত হননি।

চোখে ছিল সাম্যের সমাজ বিনির্মাণের উজ্জ্বল স্বপ্ন। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ তাঁর আজীবনের ব্রত। শোষণহীন একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল যার আজন্ম স্বপ্ন। তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আন্দোলনের অগ্রপথিক।

ফরহাদ ছিলেন সর্বাংশে একজন কমিউনিস্ট, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের আদর্শের প্রতি আত্মনিবেদিত। পার্টির জন্য তিনি সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান ও সাধনার প্রধান কেন্দ্র। কমরেড ফরহাদ ও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল এক নাড়িতে বাঁধা, অভিন্ন সত্তা।

বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি বিকাশের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের প্রধান নির্মাতা ও সংগঠক ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। তিনি ছিলেন আশির দশকের সিপিবির স্বর্ণযুগের স্থপতি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই দলটি ছিল বাংলাদেশর মুক্তিকামী মানুষের সাহসী ঠিকানা। আর এর সিংহভাগ কৃতিত্ব কমরেড ফরহাদের।

আন্দোলনের পটভূমিতে যে হাজার হাজার মানুষ পার্টির পক্ষে সমবেত হয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে প্রভাবিত করা এবং কোন ধরনের সাংগঠনিক প্রভাবে আনার জন্য গণগ্রুপ গঠন ও গণক্লাস চালুর সুস্পষ্ট ধারণা মোহাম্মদ ফরহাদের সৃজনশীল সাংগঠনিক কাজের এক বিশেষ দৃষ্টান্ত।

অসাধারণ বাগ্মী আর প্রজ্ঞার অধিকারি কমরেড ফরহাদের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সহজ, সরল, সাদামাটা। মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল হৃদ্যতার। নির্লোভ, নিরহঙ্কার মানুষ ছিলেন কমরেড ফরহাদ। সাদা পজামা-পাঞ্জাবী পরতেন। এত শান্ত-ধীর-স্থির নেতা বাংলাদেশে খুব কমই জন্মগ্রহণ করেছেন। বিশ্বাস-আদর্শে, কথায়-কর্মে-আচরণে এমন আশ্চর্য মিল খুব কম মানুষের মধ্যেই থাকে। প্রিয় খাবার ছিল সাদাভাত, আলু আর টাকি মাছের ভর্তা। কথা বলতেন আস্তে আস্তে, অত্যন্ত সাজিয়ে-গুছিয়ে, যুক্তি দিয়ে।

রাজনৈতিক জীবনে প্রচুর লেখালেখি করেছেন পার্টির মুখপত্র এবং কখনো কখনো জাতীয় দৈনিকে। কমরেড ফরহাদের দৈনিক সংবাদের খেলাঘর পাতার সম্পাদক ছিলেন। রাজনৈতিক দলিল, প্রস্তাব, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি রচনায় কমরেড ফরহাদের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। একটানা লম্বা সময় ধরে না লিখেও তিনি বেশ দ্রুত লিখতে পারতেন।

রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণেও তিনি ছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী। পার্টির অভ্যন্তরে অথবা বাইরে সর্বত্রই তাঁর এই দক্ষতার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যেত। সৃজনশীল গণ-লাইন ছাড়াও, টেবিল টকেও বিরোধী রাজনৈতিক ধারাগুলোর সঙ্গে আলোচনাকালে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন মোহাম্মদ ফরহাদ। অকমিউনিস্টরা অনেকেই সে জন্য তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেন।

সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের হয়ে কাজ করলেও ছুটে যেতেন ফরহাদের কাছে। নিজ ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক অপেক্ষা করতেন- কী সিদ্ধান্ত দেবেন মোহাম্মদ ফরহাদ।

সে সময়কার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত সাংবাদিক বজলুর রহমান লিখেছেন, যে পারে সে এমনি পারে, পারে সে ফুল ফুটাতে। মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন অনেকটা তেমনি। হালকা-পাতলা ছোটখাটো গড়নের মানুষটি। বন্ধুরা টেক নাম দিয়েছিল ছোটলোক বা লিটলম্যান। সবাই জানতো ছাত্র ইউনিয়নের মূল নেতা তিনিই, তাঁর কথাই শেষ কথা।

তাঁর মৃত্যুর পর একটি লেখায় দৈনিক খবর–এর সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান লিখেছেন, বিপ্লবী কমরেড ফরহাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল পাঁচ দফা আন্দোলন ও পনের দলীয় জোট। এখানে ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর হিসাবে তার অবদান তুলনাহীন।

১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর রাশিয়ার মস্কোয় নিভে যায় দেশের এ উজ্জ্বল রাজনৈতিক জ্যোতিষ্কের জীবন প্রদীপ। তার অকাল প্রয়াণ বাংলাদেশের বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্ট করে। মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। এখন বাম রাজনীতিতে যে অনৈক্য, কমরেড ফরহাদ থাকলে হয়তো এ অবস্থা হতো না।

আজকের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংকটের সময় একজন কমরেড ফরহাদ প্রয়োজন। স্বাধীন দেশের লাল পতাকায় তার স্বপ্ন ও ছায়া এখনও ভাসে। মহান মানবতাবাদী মোহাম্মদ ফরহাদ মানুষের হৃদযয়ের মণিকোঠায় চির জাগরুক হয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল ধরে।

মোহাম্মদ ফরহাদের বিপ্লবী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের লড়াইকে বেগবান করতে হবে। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে। মোহাম্মদ ফরহাদ চিরঞ্জীব। তার প্রতি নমিত শ্রদ্ধা।




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top