আবু সাঈদ হত্যা মামলায় ১৬ বছরের শিক্ষার্থী মাহিম ১২ দিন কারাগারে
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১ আগষ্ট ২০২৪, ১৪:৩৩

কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আলফি শাহরিয়ার মাহিম নামের এক কিশোরকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল ভুক্তভোগীর বোন সানজানা আখতার স্নেহা ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
কারাগারে থাকা আফিল শাহরিয়ার মাহিম রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। মাহিমের বাবা শাহজালাল বলেন, ‘আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আমার ছেলে মাহিমকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। জন্ম সনদ অনুসারে তার বয়স ১৬ বছর ১০ মাস।’ পুলিশ মামলায় তার বয়স উল্লেখ করেছে ১৯ বছর।
এ বিষয়ে রংপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের কৌঁসুলি (পিপি) রফিক হাসনাইন গণমাধ্যমকে বলেন, আবু সাঈদ হত্যা মামলার এজাহারে মাহিমের নাম ছিল না কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মাহিমের বাবা জামিন চেয়ে আবেদন করেছেন। আগামী ৪ আগস্ট সেই আবেদনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
মাহিমের বাবা শাহজালাল বলেন, গত ১৮ জুলাই বাড়ির কাছে পার্কারমোড়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল মাহিম। সে কলেজের ইউনিফর্ম পরেছিল। পার্কারমোড় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই। পার্কারমোড়ের চারপাশে সংঘর্ষ শুরু হলে আতঙ্কিত হয়ে মাহিম বাড়ির উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করে।
সে সময় তার পায়ে শটগানের ছররা গুলি লাগে। সারাদিন খোঁজ করেও মাহিমকে পাওয়া যায়নি। রাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে একজন ফোন করে জানান, মাহিম তাদের হেফাজতে আছে। পরদিন ১৯ জুলাই মাহিমকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। পর দিন ফোন করলে ওই ব্যক্তি জানান, মাহিমকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। ওইদিন বিকেলে তাকে আদালতে হাজির করে রংপুর কারাগারে পাঠানো হয়।
ফেসবুকে পোস্ট করে মাহিমের বোন বলেন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গতকাল মাহিমের পরিবারকে তার কার্যালয়ে ডেকেছিলেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, মাহিম সুস্থ আছেন এবং বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে পরিবারের সদস্যদের আদালতে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, ‘আজ আদালতের কার্যক্রম শেষে মাহিমকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাজহাট থানার এসআই জিল্লুর রহমান বলেন, যে পরিস্থিতিতে মাহিমকে গ্রেপ্তার করা হয় সেসময় তার বয়স নির্ধারণ করার সুযোগ ছিল না। পরে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাকে মাধ্যমে কারাগারে পাঠান। গতকাল বুধবার নানাভাবে তার বয়স নিশ্চিত হওয়ার রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বলেছেন, তার জামিনের ক্ষেত্রে পুলিশ সহায়তা করবে।
‘ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তিনি দায়িত্বরত পুলিশের জন্য হুমকির কারণ ছিলেন না। তারপরও ১৬ জুলাই পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এর কিছুক্ষণ পরই তার মৃত্যু হয়। তবে পুলিশের প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হননি।
এফআইআরে বলা হয়েছে, ‘বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন দিক থেকে গুলি ছুড়তে থাকে এবং ইটের টুকরো নিক্ষেপ করতে থাকে। একপর্যায়ে এক শিক্ষার্থীকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখা যায়।’
আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনার একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ওই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পুলিশ আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। আর আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন।
সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম। তিনি গত শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, আবু সাঈদের বুক ও পেট ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল।
আবু সাঈদ যে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন, তা ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট বোঝা যায়। তাহলে অল্প বয়সী এই শিক্ষার্থীকে কীভাবে এই হত্যা মামলার আসামি করা হলো? তার বয়স কীভাবে ১৯ উল্লেখ করা হলো? পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ছেলেটির বাবা বলেন, তাঁর ছেলে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয়। কিন্তু পুলিশ তাকে আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আসামি করে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। তিনি শুনেছেন, তাঁর ছেলে অসুস্থ। কারাগারে নেওয়ার পর তিন দিন পরিবারসহ সেখানে গেছেন। কিন্তু তাঁদের দেখতে দেওয়া হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গতকাল বিকেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরেছেন। তাঁরা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন।
কিশোরের আইনজীবী আবদুল মোকছেদ বাহালুল প্রথম আলোকে বলেন, জন্মসনদসহ যাবতীয় প্রমাণপত্র দিয়ে রংপুর শিশু আদালত-১–এ গত ৩০ জুলাই জামিনের আবেদন করা হয়েছে। এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে ৪ আগস্ট।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।