যেসব দেশে আশ্রয় খুঁজছেন শেখ হাসিনা
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৮ আগষ্ট ২০২৪, ১৯:৫৩
ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা এখন অন্য কোনো দেশে আশ্রয় খুঁজছেন। এখন পর্যন্ত কোনো দেশে আশ্রয় না পেয়ে তিনি আপাতত ভারতেই আছেন। তবে তিনি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ফিনল্যান্ডে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু।
সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে পালিয়ে দিল্লির হিন্দন ঘাঁটিতে অবতরণ করার ২৪ ঘণ্টা পরেও তার চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায় হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, যুক্তরাজ্য তার আশ্রয়ের আবেদন গ্রহণ করার ‘সম্ভাবনা কম’।
এদিকে, এটি বোঝা যাচ্ছে যে খুব অল্প সময়ের নোটিশে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া শেখ হাসিনা তার স্বজনরা যেখানে বাস করে, সেসব জায়গা ছাড়াও অন্যান্য দেশ যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবে আশ্রয় চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড এবং ভারতে আশ্রয় চাইতে পারেন।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানাও রয়েছেন। শেখ হাসিনার আশ্রয়স্থলের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা একটি ‘নিরাপদ বাড়িতে’ রয়েছেন।
এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের সরকারি কর্মকর্তারা অভিবাসন আইনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যার অধীনে যুক্তরাজ্যের বাইরের ব্যক্তিদের জন্য আশ্রয় বা অস্থায়ী আশ্রয় চাওয়ার ‘কোনো বিধান নেই’। ‘যাদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষা প্রয়োজন তাদের প্রথম নিরাপদ দেশে আশ্রয় দাবি করা উচিত। এক্ষেত্রে ভারত একটি নিরাপদ রুট। আর শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে নিয়মিত ভিসার জন্য আবেদন করেছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গত সোমবার দিল্লি অবতরণের পরপরই শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্য ভ্রমণের অনুমতি চেয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিমানে তিনি সরাসরি লন্ডনে যেতে পারবেন। তার বোন শেখ রেহানার যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব রয়েছেন। রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেটের (উত্তর লন্ডন) বর্তমান লেবার সংসদ সদস্য (এমপি) এবং ট্রেজারি ও সিটি মিনিস্টারের অর্থনৈতিক সচিব।
তবে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার সেই আশা ক্ষীণ হয়ে যায় কয়েক ঘণ্টা পর, যখন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিবৃতি দেন এবং সেখানে শেখ হাসিনার অনুরোধের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। উপরন্তু, তিনি বলেন যে ‘বাংলাদেশের জনগণ গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলির বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন একটি পূর্ণ ও স্বাধীন তদন্তের অধিকার রাখে।’
ডেভিড ল্যামির বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাজ্যের সরকার তাদের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের অবস্থান সত্ত্বেও শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডের আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য চাপ দিতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের মতে, যুক্তরাজ্য সরকার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি দলের অনুগতদের চাপ নিয়ে উদ্বিগ্ন, যারা সেখানে প্রভাবশালী, পাশাপাশি হাসিনার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হতে পারে এমন উদ্বেগ নিয়েও। অতীতে অবশ্য নওয়াজ শরীফ ও বেনজির ভুট্টোর পাশাপাশি বিএনপির তারেক রহমানসহ নির্বাসনে থাকা পাকিস্তানি নেতাদের সেখানে বসবাসের অনুমতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
ইউরোপে শেখ হাসিনার পরবর্তী বিকল্প হবে ফিলল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি। এ শহরে তার ভাগ্নে অর্থাৎ শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি সেখানে বসবাস করেন। ববি ফিনল্যান্ডের নাগরিককে বিয়ে করেছেন।
শেখ রেহানার ছেলে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) ও ‘ইয়াং বাংলা’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এ সংগঠন দুটি আওয়ামী লীগের দলীয় ও তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রচারণা চালায়। ফিনল্যান্ডে শেখ হাসিনার আশ্রয় চাওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবের কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো সাড়া দেয়নি।
এদিকে, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং তার স্ত্রী (মার্কিন আইনজীবী) যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বসবাস করছেন। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার সময় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা করার অভিযোগে সমালোচনার মুখে পড়েন জয়।
বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে, বিশেষত ২০২৩ সালের মে মাসে ‘বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’ সমর্থনের জন্য বিশেষ ভিসানীতির পরে যা প্রক্রিয়াটিকে ধ্বংস করছে বলে মনে করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার দিকে পরিচালিত করেছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনেরও কঠোর সমালোচনা করেছিল এবং এ বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রচ্ছন্ন মন্তব্যে ‘পশ্চিমা সরকারকে’ বাংলাদেশে জোর করে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন যে, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর শেখ হাসিনা মার্কিন ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন কি না তা তারা জানেন না। তবে তারা নিশ্চিত করেছেন যে, শেখ হাসিনার অফিসিয়াল পাসপোর্টে তার বর্তমান ভিসা ‘আর বৈধ হবে না’ কারণ তিনি তার পদ (প্রধানমন্ত্রী) থেকে পদত্যাগ করেছেন।
ভারতের সরকারি সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং গত এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও নয়াদিল্লির জন্য শেখ হাসিনার অবস্থান সম্ভবত সবচেয়ে বিশ্রী হবে। হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসাবে দিল্লিতে থাকেন।
এ পদে প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার জন্য ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল নয়াদিল্লি। তা সত্ত্বেও, যেহেতু নয়াদিল্লি ঢাকায় নতুন সংস্থাকে সম্পৃক্ত করতে চায় এবং তার কৌশলগত, বাণিজ্য ও যোগাযোগের অংশীদারত্ব অব্যাহত রাখতে চায়, তখন এখানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি ব্যাখ্যা করা কঠিন হবে, বিশেষত যদি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বা নতুন কোনও সরকার তাকে বাংলাদেশে অভিযুক্ত করার জন্য প্রত্যর্পণ দাবি করে।
একই কারণে শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে বা আফগানিস্তানের আশরাফ গনি সরকারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা নিজ নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের অনুরোধ গ্রহণ করেনি মোদি সরকার।
উপরন্তু, ভারতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি বাংলাদেশ থেকে তার আরও সমর্থকদের আশ্রয়ের জন্য অনুরোধের দিকে পরিচালিত করতে পারে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত হস্তক্ষেপ করছে এমন সন্দেহের জন্ম দিতে পারে। হাসিনার প্রত্যাশিত অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে একটিতে তার গ্রহণযোগ্যতা মুলতুবি রয়েছে, তবে নয়াদিল্লি বাংলাদেশি নেতাকে স্বাগত জানাবে। যেমনটি তিনি সর্বশেষ ১৯৭৫ সালে তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান, তার মা এবং তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যার পরে ভারতে ছিলেন। আমাদের সময় থেকে নেওয়া।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।