‘আয়নাঘর’ নিয়ন্ত্রণ করতেন তারিক আহমেদ সিদ্দিক
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৯ আগষ্ট ২০২৪, ১৪:২১
শেখ হাসিনা পতনের পর নিখোঁজ থাকা তিনজন ফিরে এসেছেন, যাদের দীর্ঘদিন কোনো হদিস ছিল না। এরপরই আলোচনায় আসে ‘আয়নাঘর’। এর আগেই এই ‘আয়নাঘর’ আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এটা বাস্তবে আছে কি না, তা নিয়ে তখন অনেকেরই সংশয় ছিল। কিন্তু ফিরে আসা ব্যক্তিরা গণমাধ্যমে মুখ খোলার পর জানা গেল, বাস্তবে ‘আয়নাঘর’ আছে, যেখানে গুম করে রাখা হয় এবং নির্যাতন করা হয়।
আলোচিত গোপন কারাগার 'আয়নাঘর' তৈরিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, ‘আয়নাঘর’ মূলত তৈরি হয়েছে ২০০৯ সালে। এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের নেতাদের অপহরণ করে বছরের পর বছর ধরে ‘আয়নাঘরে’ রাখত। আবার কাউকে মেরেও ফেলা হয়েছে। এ বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষকর্তারা অবহিত ছিলেন। এসব কর্মকাণ্ড করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষকর্তারা পদোন্নতি পাওয়া থেকে শুরু করে পুরস্কৃতও হয়েছেন।
সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গত ১৫ আগস্ট রাতে গ্রেপ্তার করার পর ‘আয়নাঘর’সহ নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসবাদ করা হচ্ছে। বর্তমানে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিউ মার্কেট এলাকায় হকার শাহজাহান হত্যা মামলায় আট দিনের রিমান্ডে আছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে খুন, গুম ও অসংখ্য ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, গোয়েন্দাদের জেরার মুখে জিয়াউল আহসান ও তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম বলেছেন। জিয়াউল আহসান দীর্ঘদিন র্যাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২২ সাল থেকে এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভিন্নমত এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল দমন করার জন্য গুমের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ পর্যন্ত গুমের ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব ও বাহিনীটির কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হলেও এটির নিয়ন্ত্রণ ছিল তারিক আহমেদ সিদ্দিকর হাতে। জিয়াউল এনটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালে একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস করেন। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন সব ব্যক্তির স্পর্শকাতর কল রেকর্ড তার নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
তবে জিয়াউল আহসান গত শুক্রবার আদালতে রিমান্ড শুনানিতে ‘আয়নাঘরের’ সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তিনি বলেন, ৭ আগস্ট তাকে তুলে নিয়ে ‘আয়নাঘরে’ রাখা হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আয়নাঘর’ নিয়ে তারা বেকায়দায় আছেন। এটি নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। সরকার পতনের আগপর্যন্ত এখানে কয়েকশ মানুষ আটক ছিল বলে তারা তথ্য পেয়েছেন।
এ কর্মকর্তা জানান, ‘আয়নাঘর’ কচুক্ষেত, উত্তরা, মিন্টো রোডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইউনিটে ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রিমান্ডে থাকা সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান নানা তথ্য দিচ্ছেন। ইলিয়াস আলীসহ অন্যদের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট) এম ইলিয়াস আলী বনানী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ২০১০ সালের ২৫ জুন নিখোঁজ হন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক কাউন্সিলর চৌধুরী আলম। তেজগাঁওয়ের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড (সাবেক ৩৮) বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ সাতজন নিখোঁজ হন।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে ৭০৮ জন অপহরণের পর ‘নিখোজ’ হয়েছেন বলে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার বলেছে। তার মধ্যে ২০০৯ সালে ৩, ২০১০ সালে ১৯, ২০১১ সালে ৩২, ২০১২ সালে ২৭, ২০১৩ সালে ৫৪, ২০১৪ সালে ৪১, ২০১৫ সালে ৬৯, ২০১৬ সালে ৯৭, ২০১৭ সালে ৯৫, ২০১৮ সালে ৯৮, ২০১৯ সালে ৪৩, ২০২০ সালে ৩১, ২০২১ সালে ২৩, ২০২২ সালে ২১, ২০২৩ সালে ৫৪ ও ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১০ জন নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের নিখোঁজের ঘটনায় র্যাব, পুলিশ, ডিবি, আনসার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, সিআইডি ও ডিজিএফআইসহ অন্য সংস্থা জড়িত।
একইভাবে গুম হন তেজগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যগ্ম সম্পাদক এএম আদনান চৌধুরী, সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসান সুজন, ২৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি কাজী ফরহাদ, তেজগাঁওয়ের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড (সাবেক ৩৮) বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ সাতজন, তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক তরিকুল ইসলাম ঝন্টু,
সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টু, সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমেদ দিনার ও ছাত্রদলকর্মী জুনেদ আহমেদ, ফেনীর যুবদল নেতা সারোয়ার জাহান বাবুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের ছাত্রদল নেতা শামীম হাসান সোহেল, ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য মাসুম হোসেন, যাত্রাবাড়ীর ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি কাজী আতাউর রহমান লিটু, বরিশালের উজিরপুরের বিএনপি নেতা হুমায়ুন খান, চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম,
সূত্রাপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ, বোয়ালখালী থানা বিএনপির সভাপতি ও করলডেঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি গোলাম মোস্তফা নান্না, বরিশালের জাগুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও ওয়ার্ড বিএনপির সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন, সূত্রপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ছাত্রদল নেতা খালিদ হোসেন সোহেল, শাহবাগ থানা যুবদলের কর্মী লিটন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশিক, জিয়াউর রহমান শাহিন, শাহবাগ থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সোহেল প্রমুখ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা বলেন, গুমের উৎপত্তি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জার্মানির নাৎসি বাহিনী দ্বারা। খোদ জার্মানিতে গুম হওয়া থেকে বাঁচতে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতো ব্যক্তিও জার্মানি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মদদে নিরীহ ব্যক্তি বা অপরাধীকে তাদের ধরে নিয়ে গোপন স্থানে আটকে রাখা, পরিবারের কাছে অস্বীকার করা, কিংবা মেরে ফেলা এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সানজিদা ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বছর পাঁচেক আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তার বড় ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমনকে নাখালপাড়ার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে তারা দফায় দফায় যোগাযোগ করেন। সবাই বলেছেন ভাইয়াকে তারা ধরে নিয়ে যাননি। অথচ তাকে ধরে নিয়ে গুম করে রাখা হয়েছে।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনাও বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসেও আমার স্বামীকে ফেরত পাইনি। তারপরও আশায় আছি ইলিয়াস আলী ফেরত আসবেন।’ পুলিশ সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর অনেক স্বজনের দাবির মুখে তিনজন বন্দিকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা। তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল।
গত ৭ আগস্ট তিনি ছাড়া পান। এর আগে মুক্তি পেয়ে বাসায় ফেরেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট আহমদ বিন কাসেমকে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে এবং ওই বছরের ২৩ আগস্ট আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয়েছিল। ‘আয়নাঘরে’ নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশ্বের হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়ও ছিলেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূরে খান লিটন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে আসছে গুম প্রতিরোধে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে। কিন্তু আজও তা করা হয়নি। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হওয়ায় এখন সময় এসেছে এসবের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা।’ সূত্র: ইত্তেফাক, দেশ রূপান্তর
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।