বন্যা পরিস্থিতি এত দ্রুত খারাপ হলো কেন

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২২ আগষ্ট ২০২৪, ২১:৪৪

ছবি: সংগৃহীত

চলমান বন্যায় দেশের ৮ জেলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ফেনী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পানিতে ডুবে দুজন মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দুপুরে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা।

আলী রেজা জানান, এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। এ দিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, ৭টি নদীর ১৪টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর প্রবাহিত হচ্ছে। ১২ ঘণ্টায় নদ নদীর পানি স্থিতাবস্থা থাকতে পারে বলেও ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছে।

এদিকে, ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী ও নোয়াখালীসহ দেশের আটটি জেলা। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের স্থল দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করতে থাকায় একের পর এক জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে ফেনীর বাসিন্দারা।

জানা গেছে, ফেনীর সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। সব ধরনের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে চরম দুর্ভোগ ও আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। তবে বন্যা নিয়ে ‘না জানিয়ে বাঁধ খুলে দেওয়া’ নিয়ে বাংলাদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ তোলার বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত সরকার।

ভারত সরকারের বিবৃতিতে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে গত কয়েকদিন ধরেই ভারী বৃষ্টি হয়েছে। মূলত বাঁধের নিচের দিকে পানির প্রবাহের কারণেই বাংলাদেশে এই বন্যা হয়েছে।

ফেনী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হোসেন মাহমুদ শামীম ফরহাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভবনগুলোর নিচতলায় পানি ঢুকে মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই পানি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকবে।’

ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৪০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পরশুরামের মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ এবং পৌরশহরসহ ৪৫টির বেশি গ্রাম পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রামে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।

সিলেটে অতিবৃষ্টি আর ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে কুশিয়ারা নদীর পানি। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সকালে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেওয়া তথ্যমতে এমনটি জানা যায়।

২২ আগস্ট সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের ১৯ আগস্টের বৃষ্টির পূর্বাভাসের কথা উল্লেখ করে অনেকে পোস্ট দেন— ভারত আগে থেকে পরিস্থিতি জানিয়েছিল। এ বিষয়ে নদী গবেষক শেখ রোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে ডম্বুর ও কলসি ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি। ভারত যেটা জানিয়েছে, সেটা হলো বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য। অভিন্ন নদী অববাহিকায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য পরস্পরকে জানানোর বিষয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চু্ক্িতও রয়েছে। যেমন- ব্রহ্মপুত্রের তথ্য চীন আমাদের জানিয়ে থাকে।

আবার আত্রাই বা পুনর্ভবা নদী অববাহিকার দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁওয়ে অতিবর্ষণ বা বন্যা হলে আমরা ভারতকে সতর্ক করি, যাতে করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর বা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রস্তুতি নিতে পারে। এ ক্ষেত্রেও ভারত ত্রিপুরায় অতিবৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য জানিয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে ডম্বুর ও কলসি ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি। ভারতীয় পররাষ্ট্র বা আবহাওয়া দফতরও সেটা দাবি করেনি। এই যে ড্যাম বা ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি, সেটাই বন্যাটিকে বিপর্যয়কর করে তুলেছে।’

যৌথ নদীর ক্ষেত্রে বাঁধ খোলার আগে জানানোর নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, ‘‘যেকোনও যৌথ নদীর বাঁধ খুলে দেওয়ার আগে জানানোর রীতি আছে। জানায়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, হাইড্রোপাওয়ারে গেট থাকে না, যেটা খুলে দিতে হবে। এটা ‘স্পিল’ করেছে। তাদের পার্টের লেক পানিতে পূর্ণ হয়ে গেলে অটো স্পিল করে।

ভারতের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা সত্য। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। এটা খুব ছোট হাইড্রোপাওয়ার, গোমতি নদীর ১২৩ কিলোমিটার উজানে এই হাইড্রোপাওয়ার। হঠাৎ টানা বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়েছে। তিন দিন আগে ভারতের যে পূর্বাভাস, তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।’’

যৌথ কমিশনের সদস্যের বক্তব্য যাচাইযোগ্য উল্লেখ করে শেখ রোকন বলেন, ‘ড্যামের ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে, যেমন- ডম্বুর। কিন্তু সেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। বন্যা ও অতি বৃষ্টির ক্ষেত্রে শুধু স্পিল ওভার দিয়ে চলবে না। ফলে ওনার এমন বক্তব্য যাচাইযোগ্য। আর ব্যারাজের ক্ষেত্রে গেট খুলতেই হবে। যেমন মুহুরির কলসি ব্যারাজ।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) এক তথ্য বিবরণীতে জানায়, বন্যায় আটটি জেলার প্রায় ২৯ লাখ মানুষ ক্ষত্রিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বন্যার পানিতে ডুবে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানানো হয়। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীগুলোর সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী সময়ে উন্নতি হতে পারে।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top