স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় নতুন করে পানিবন্দি ৬৭ হাজার পরিবার

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৬ আগষ্ট ২০২৪, ১২:৩৩

ছবি: সংগৃহীত

দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ১১ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে পানিবন্দি হয়েছে ৬৭ হাজার ১২৮টি পরিবার। শনিবার ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯০১ পরিবার পানিবন্দি ছিল। গতকাল রবিবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবারে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা গত এক দিনে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৬৮ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ লাখ ৯ হাজার ৭৯৮ জনে।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো—ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার।

প্রেস উইং থেকে বলা হয়, বন্যায় এখন পর্যন্ত ২০ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে কুমিল্লায় ছয় জন, ফেনীতে এক জন, চট্টগ্রামে পাঁচ জন, নোয়াখালীতে তিন জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক জন, লক্ষ্মীপুরে এক জন ও কক্সবাজারে তিন জন নিহত হয়েছেন। মৌলভীবাজারে দুই জন নিখোঁজ রয়েছেন। বন্যাদুর্গত ১১ জেলায় মোট ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ত্রাণের চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ৬৫০ টন। এ ছাড়া ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। শিশুদের খাবারের জন্য ৩৫ লাখ টাকা এবং গোখাদ্য কেনার জন্য ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পানিবন্দি-ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় প্রদানের জন্য মোট ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৪ লাখ ১৫ হাজার ২৭৩ জন মানুষ এবং ২২ হাজার ২৯৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যদের সংগৃহীত ৭ হাজার ২০০ ব্যাগ-বস্তা ত্রাণসামগ্রী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যে দুর্গত এলাকায় পাঠানো হয়েছে এবং ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম উপজেলায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নৌ ও সড়ক পথে এবং তাদের হেলিকপ্টারসহ বিমান বাহিনী, র‍্যাব ও বিজিবির হেলিকপটারযোগে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রম চলমান আছে। ফেনীতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার জন্য ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী ও জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসকবৃন্দ সেবা প্রদান করছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে কন্ট্রোল রুম সার্বক্ষণিক খোলা রয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বর চালু রয়েছে।

আকস্মিক বন্যায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। এর মধ্যে দুধ, ডিমে প্রায় ৪১১ কোটি টাকা এবং অবকাঠামোসহ অন্যান্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। গতকাল রোববার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।

কুমিল্লার তিতাসে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরা হলো না শিশু সামিয়া ও আয়েশা আক্তারের। রোববার বেলা ১১টার দিকে মাদরাসা থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুই চাচাতো বোন বাঘাইরামপুর ও দুঃখিয়ারকান্দি রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির স্রোতে পাশের গর্তে পড়ে নিখোঁজ হয়। দেড় ঘণ্টা পর সামিয়া আক্তার (১০) এবং তিন ঘণ্টা পর আয়েশা আক্তারের (১০) লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের বাঘাইরামপুর গ্রামের রাজমিস্ত্রি মুক্তার হোসেনের মেয়ে সামিয়া আক্তার এবং আয়েশা আক্তার একই গ্রামের মালদ্বীপ প্রবাসী মনির হোসেনের মেয়ে।

বন্যার পানিতে ডুবে রোববার সকালে সেনবাগের কেশারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামে স্কুলশিক্ষক গিয়াস উদ্দিনের একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের (২) মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের লোকজনের অজান্তে শিশুটি তাদের বসতঘরের দরজার সামনে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে টানা পাঁচ দিনের বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২ লাখেরও বেশি মানুষ। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এখানকার ফেনী নদীর পানির উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বুধবার থেকে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ১৬৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়।

পানিতে প্লাবিত ১১টি ইউনিয়নে নেই বিদ্যুৎসংযোগ। এদিকে গত কয়েক দিন বন্যার কারণে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে বিবেচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যান চলাচল করছে অনেক ধীরগতিতে। গত কয়েক দিন পথে আটকে থাকার কারণে মালবাহী অনেক যানবাহনে থাকা নিত্যপ্রয়োজনীয় কাঁচা ভোগ্যপণ্য নষ্ট হয়ে গেছে।

কুমিল্লার গোমতী নদীর ভাঙন এলাকা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বুড়িচং উপজেলার বাকশীমুল ইউনিয়নের পিতাম্বর গ্রাম। রোববার দুপুরে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লোকজন রেললাইনে ছুটে যাচ্ছেন। সহায়-সম্বল হারিয়ে কেউবা ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। দুর্গত লোকজন জানিয়েছেন এক দিন আগেও ওই এলাকায় পানি ছিল না। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ঘরের ভেতর পানি উঠে গেছে। বন্যায় এ উপজেলার অধিকাংশ গ্রামের লোকজনই এখন পানিবন্দি।

লক্ষ্মীপুরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে পানি কমতেও শুরু করেছিল জেলা শহরসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোতে। কিন্তু শুক্রবার থেকে নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী খাল দিয়ে ও বিভিন্নভাবে ঢুকে পড়ে লক্ষ্মীপুরে। এতে লক্ষ্মীপুর পৌরসভা ও পূর্বাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোর অধিকাংশ এলাকার মানুষ নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এদিকে শনিবার সকাল থেকে বন্যার পানির চাপ বেড়ে গিয়ে নতুন করে আরও কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে।

নোয়াখালীতে দুই দিন বৃষ্টি বন্ধ থাকার পর শনিবার রাত থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়। উজানের পানি ঢুকে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এতে করে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা বেড়ে ২০ লাখ ছাড়িয়েছে। রোববার দুপুর পর্যন্ত সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ লাখ ৬৩ হাজার ২৯১ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এখনো ছুটছে বানভাসি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। বন্যার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ১১৮ জন ভর্তি হয়েছে। গত তিন দিনে নোয়াখালীতে ৫৩ জনকে সাপে কেটেছে।

সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য-সহায়তা প্রদানের জন্য আগ্রহী ব্যক্তিরা প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলের অ্যাকাউন্টে সহায়তার অর্থ প্রেরণ করতে পারেন। হিসাবের নাম: ‘প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’, ব্যাংক: সোনালী ব্যাংক করপোরেট শাখা, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, হিসাব নম্বর: ০১০৭৩৩৩০০৪০৯৩।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top