জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৬ আগষ্ট ২০২৪, ১৩:২৭

ছবি: সংগৃহীত

দেশে কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশবাসীকে বলব একটা আলোচনা শুরু করতে, আমরা সর্বনিম্ন কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাব, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে। কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে। এই দিকনির্দেশনা না পেলে আমরা দাতা সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনায় দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হতে পারছি না।

রোববার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন। এ সময়ে কোন প্রেক্ষাপটে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন, তা তুলে ধরেন। একটি উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে তার সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেন। তার মতে, সারা দেশ ঘুসের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত। এ অবস্থায় বিভিন্ন খাতে সংস্কার জরুরি। এ সময় দাবি-দাওয়া আদায়ে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন না করে কাজ করার সুযোগ দিতে অনুরোধ জানান।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ৮ আগস্ট শপথ নেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শপথ নেওয়ার ২ সপ্তাহের বেশি সময় পর আজ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন তিনি।

ড. ইউনূস বলেন, একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন। আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে আমরা এই দায়িত্ব নিয়েছি। সব শক্তি দিয়ে এই দায়িত্ব পালন করব। আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীও এই লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই মিলে একটা টিম হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।

দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছেন। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাব যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়, আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবেন, আমরা চলে যাব। আমরা সংস্কারের অংশ হিসাবে নির্বাচন কমিশনকেও সংস্কার করব। কমিশনকে যে কোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখব। আমরা বিভিন্ন সংস্কারের কাজ শুরু করেছি।

দেশবাসীকে অনুরোধ করব, একটা আলোচনা শুরু করতে। আমরা সর্বনিম্ন কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাব, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলব না।

তিনি বলেন, বিপ্লবী ছাত্র-জনতা জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাকে এক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তারা নতুন এক বাংলাদেশ গড়তে চান। নতুন প্রজন্মের এই গভীর আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সংগ্রামে আমি একজন সহযোদ্ধা। দেশের সব বয়সের, পেশার, মতের, ধর্মের সবাইকে বিনা দ্বিধায় এই সংগ্রামে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, লাখো শহিদের রক্ত ও মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ পেয়েছিলাম, তা ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের হাতে ধ্বংস হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে শেষ করেছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। এমন এক দেশে আমাদের দেশ রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে স্বৈরাচারের পিয়নও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪শ কোটি টাকার সম্পদ করার মতো অকল্পনীয় কাজ নির্বিবাদে করেছে।

শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার খাতে লুটপাট, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্বরেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাক-স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার হরণ এসবই হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ফ্যাসিবাদী সরকার খর্ব করেছে জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে।

জনগণকে নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানুষসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকারকে বছরের পর বছর হরণ করেছে। মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে স্বৈরাচার তার নিজের, পরিবারের ও দলের কিছু মানুষের হাতে দেশের মালিকানা তুলে দিয়েছে। কিন্তু এই দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েই গড়তে হবে স্বপ্নের বাংলাদেশ।

বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আমি সেই স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। সবাইকে এই শুভলগ্নে স্বপ্নপূরণে সব শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। তরুণদের স্বপ্ন আমাদের স্বপ্ন। জাতীয় জীবনে তরুণরা একটি মহাসুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। সুযোগ ব্যবহার করার কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাচ্ছি।

গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার-প্রধান দেশত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই। যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই। উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ২ সপ্তাহ হলো। অনুধাবন করছি আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর। যদিও দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গিয়েছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।

এখনই সব দাবি পূরণের জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তি বিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণে চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা, তা থেকে বের হতে হবে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসব কাজে ম্লান হয়ে যাবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাও এতে ব্যাহত হবে।

রাতারাতি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কঠিন। নড়বড়ে এবং জনস্বার্থের বিপরীতমুখী এক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে। এখান থেকেই বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই, যেন এ দেশে সত্যিকার অর্থেই জনগণ সব ক্ষমতার উৎস হয়। বিশ্ব দরবারে একটি মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসাবে সমাদৃত হয়। তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী ও জনতার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে সফল আমাদেরকে হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

ড. ইউনূস বলেন, জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে বলপ্রয়োগ ও হতাহতের ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধানকে বাংলাদেশে এসে তদন্ত শুরু করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তদন্তের প্রক্রিয়া এ সপ্তাহেই শুরু হবে। তাদের প্রথম দল ইতোমধ্যে এসে গেছে। আমরা ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে যে শত শত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছিল, তার অধিকাংশ প্রত্যাহার করেছি।

আটক ছাত্র-জনতার মুক্তির ব্যবস্থা করেছি। পর্যায়ক্রমে মিথ্যা ও গায়েবি মামলার ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নিয়ে মানুষকে দুঃসহ ভোগান্তি থেকে মুক্ত করা হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গণঅভ্যুত্থানে সব শহিদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। সব আহত শিক্ষার্থী ও জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে।

এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী দুজন উপদেষ্টার সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই কার্যক্রমের জন্য এবং গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকার অতি দ্রুত ‘জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে এনেছে। সবার এবং বিদেশে অবস্থানরত ভাইবোনদের অনুদান এখানে পাঠানোর অনুরোধ করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেছি।

তিনি আরও বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা অঙ্গনে অস্থির পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। সবার সহযোগিতা ও দেশপ্রেমিক সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজে যোগ দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকার প্রশাসনে চরম দলীয়করণ করার ফলে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন বৈষম্যের শিকার।

ইতোমধ্যে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। তবে প্রশাসনকে গতিশীল রাখতে এবং একই সঙ্গে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সময় প্রয়োজন। সেজন্য সবাইকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন জনগণের আস্থা ফিরে পায়, সেটি আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।

লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিতে উদ্যোগ নিয়েছি। এই খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং জনগণের জীবনযাপন সহজ করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ সচল করেছি।

ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে। আর্থিক খাতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে যা দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। শেয়ারবাজার, পরিবহণ খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

বিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।

এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার নিশ্চিত করা হবে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করা হবে। আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে গঠন করা হবে পুলিশ কমিশন। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সব সংস্থা ও জনগণের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কমিশনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনো দিন কেউ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। ফ্যাসিবাদী সরকার গণমাধ্যমের ওপরও দলীয়করণ ও নির্যাতনের বোঝা চাপিয়েছিল। জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তথ্যের প্রবাহে বিদ্যমান আইনি ও অন্যান্য বাধা অপসারণ করা হবে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে এমন সব আইনের নিপীড়নমূলক ধারা সংশোধন করা হবে। ইতোমধ্যে এ ধরনের আইনগুলো চিহ্নিত করে এ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। বিদেশি সংবাদকর্মীদের এ দেশে আসার ওপর যে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল, ইতোমধ্যে তা তুলে নিয়েছি। বিদেশি সাংবাদিকদের দ্রুত ভিসা দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকর্মীরা নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা চালিয়ে যাবেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে গেছে বিগত সরকার। আমরা তার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেব। এটা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। ড. ইউনূস আরও বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল, নিরাপদ ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকার। একই সঙ্গে পাঠ্যক্রমকেও যুগোপযোগী করার কাজও দ্রুত শুরু করা হবে।

গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে। গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনি ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।

বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমাদের সব উপদেষ্টা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। পর্যায়ক্রমে এটি সব সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত এবং বাধ্যতামূলক করা হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে প্রতিশ্রুত ন্যায়পাল নিয়োগে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হবে।

এই নোবেল বিজয়ী বলেন, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষকের স্বার্থ যেন সুরক্ষিত থাকে, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান তা নিশ্চিত করা হবে। প্রবাসী শ্রমিকরা যেভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন, মুক্তিকামী জনগণ তা কৃতজ্ঞচিত্রে স্মরণ করে। তাদের প্রতি সব পর্যায়ে সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করা হবে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। জনগণের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। এ খাতে সংশ্লিষ্টরা আসবে জবাবদিহিতার আওতায়। হাসপাতালগুলোকে আধুনিকায়ন, সরকারি ডাক্তারসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে।

স্বাস্থ্যসেবা যাতে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত না থাকে, দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমান স্বাস্থ্যসেবা পান, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আমরা বদ্ধপরিকর। শুধু জিডিপি একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। আগামী প্রজন্মের জন্য পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতিসংঘ বর্তমান সরকারের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। আমরা সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব।

পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা। আমরা মানবাধিকার আইনসহ সব আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমাদের পক্ষ থেকে গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির পক্ষরাষ্ট্র হওয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পক্ষভুক্ত এমন সব আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সমঝোতা বাস্তবায়ন করে যাব। রোহিঙ্গা সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করা হবে।

তিনি বলেন, আমরা জাতীয় ঐক্যে বিশ্বাসী। প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হবে। নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী সবাই এ দেশের নাগরিক। তারা সমান আইনের সুরক্ষার অধিকারী।

সবার অধিকার নিশ্চিত করতে উপদেষ্টা পদমর্যাদার একজন বিশেষ সহকারী নিয়োগ দিয়েছি। বন্যা কবলিত এলাকার সব মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারের সঠিক সহায়তার জন্য সরকারের যত কার্যক্রম আছে। উপদেষ্টারা বিভিন্ন এলাকার দায়িত্ব নিয়ে এলাকায় গেছেন। আমার কার্যালয়ে একটা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। বন্যা পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে বন্যা নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

ড. ইউনূস বলেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র?্যাবকে গুম, নির্যাতনের কাজে লাগিয়ে তাদের কলঙ্কিত করা হয়েছে। তারা দেশের গৌরব। তাদেরও কিছু অতি উৎসাহী সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীকে কলঙ্কিত দেখতে চাই না।

অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে চাই। ভবিষ্যতে তারা যেন কারও হুকুমে হত্যাকাণ্ড, গুম ও অত্যাচারে জড়িত হওয়ার সাহস না করে। হুকুম যত বড় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই আসুক না কেন, তারা তা উপেক্ষা করবে। ভবিষ্যতে উপরওয়ালার হুকুমে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, এমন ব্যাখ্যা কারও কাছে গৃহীত না হয় তার ব্যবস্থা করা হবে।

আমি দেশরক্ষা বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও অন্যান্য সব বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি, তারা তাদের মধ্যে যারা হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন বা শারীরিক, মানসিক অত্যাচারে সরাসরি জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে। যারা গুম হয়েছে, হত্যার শিকার হয়েছে তাদের তালিকা প্রস্তুত করতে। তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। তাদের জীবনের শান্তি ফিরিয়ে আনতে আমরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। দেশরক্ষা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের ওপর জনগণের সম্পূর্ণ আস্থা ফিরিয়ে আনতে সব পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছি।

গত ১৫ বছরের দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর, প্রকল্পের নামে লুটপাট ইত্যাদি তথ্য নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দেশের রাষ্ট্রদূত এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ গঠনে সব ধরনের আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য তাদের অনুরোধ জানাচ্ছি। তারা এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাদের কাছে আমাদের প্রস্তাব প্রণয়ন করে দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়েছি।

তাদেরকেও অনুরোধ জানিয়েছি তারা যেন পরিস্থিতির কারণে অতি দ্রুত অর্থ ছাড় করার ব্যবস্থা নেন। তাদেরকেও বলেছি, যে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তা যেমন একটি দুর্যোগপূর্ণ সময়, তেমনি এটি জাতির জীবনে মস্ত বড় সুযোগ। এই সুযোগকে যেন পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারি সেজন্য তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। এই গণঅভ্যুত্থানে বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

তিনি বলেন, আমাদের একটি লক্ষ্য হবে বিদেশগামী এবং প্রত্যাবর্তনকারী প্রত্যেক প্রবাসী শ্রমিককে মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে দেশে আসা এবং যাওয়া নিশ্চিত করা। সে ব্যাপারে শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিদেশে অবস্থানরত সবার কাছে আমার আবেদন, তারা যেন তাদের উপার্জিত অর্থ অফিশিয়াল চ্যানেলে দেশে পাঠান। দেশের অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে এ অর্থ বিশেষভাবে প্রয়োজন। কী কী ব্যবস্থা নিলে তাদের জন্য অফিশিয়াল চ্যানেলে অর্থ পাঠানো সহজ হবে সেটা সম্বন্ধে আমরা তাদের পরামর্শ নেব।

সারা দেশ ঘুসের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত। কীভাবে ঘুস থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি তার জন্য আমাদের পরামর্শ দিন। শুধু এই কাজটা নিয়ে অগ্রসর হতে পারলেই দেশের জন্য এ সরকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে বলে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমি কথা দিচ্ছি, এ ব্যাপারে আমি আমার সর্বশক্তি নিয়োজিত করব।

আমাদের দায়িত্ব দেশের সব মানুষকে একটি পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। পরিবারে মতভেদ থাকবে। বাগ্বিতণ্ডা হবে। কিন্তু আমরা ভাই-বোন, আমরা বাবা-মা। আমরা কেউ কারও শত্রু না। কাউকে তার মতের জন্য শত্রু মনে করব না। কাউকে ধর্মের কারণে শত্রু মনে করব না।

তিনি বলেন, একটা বিশেষ ব্যাপারে আপনাদের সহযোগিতা চাই। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা বুঝি। আমাদের কাজ করতে না দিলে এই দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাদের কাজ করতে দিন।

আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিতভাবে দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসংগতভাবে যা কিছু করার আছে, আমরা অবশ্যই তা করব। কিন্তু আমাদের ঘেরাও করে এই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। সবাই মিলে তাদের বোঝান, তারা যেন এ সময়ে তাদের অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা না দেন।

আমরা আপনাদের সবার দোয়া চাই। যে কদিন আছি সে সময়টুকু উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রত্যেকে নিজ নিজ সাধ্যমতো দেশের এই সংকট উত্তরণে সাধ্যমতো কাজে লাগাতে পারি। নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করলাম, আমাদের মতানৈক্যের কারণে সেটা যেন হাতছাড়া না করে ফেলি, এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই।

এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসাবে পরাজিত হয়ে যাব। শহিদ, আহত এবং জীবিত ছাত্র-জনতার কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই আমরা এই অর্জনকে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেব না। যে সুযোগ তারা আমাদের দিয়েছে তার মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর একটি শ্রদ্ধেয়, সব দিকে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top