বন্যা পরিস্থিতির কোথায় উন্নতি, কোথায় অবনতি
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৭ আগষ্ট ২০২৪, ১৭:১৭
স্মরণকালের নজিরবিহীনবন্যায় দেশের ১১ জেলার ৫৬ লাখ মানুষ পানি বন্দি ও ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলছে সরকারের তথ্য। মারা গেছেন ২৭ জন। আর ব্র্যাকের হিসাব বলছে এই বন্যায় এখন পর্যন্ত ৮০ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ৪৫ লাখ মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। তবে বৃষ্টি কমে আসায় নদ-নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। ফলে আগামী কয়েক দিনে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি আশা করছে আবহাওয়া বিভাগ ও বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ফেনীতে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে হলেও বন্যার পানি সরছে ধীরগতিতে। এই তিন জেলায় বন্যাকবলিত প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সুপেয় পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। নৌযানের অভাবে স্বেচ্ছাসেবীরা ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে পারছেন না।
গত রোববার সকাল ৯টা থেকে গতকাল সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর জেলায় ৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অন্যদিকে নোয়াখালী থেকে রহমতখালী খাল হয়ে বন্যার পানি ঢুকছে লক্ষ্মীপুরে। এতে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার প্রায় সাত লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকার প্রায় ২৩ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। অন্যদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ কষ্ট করে বাড়িঘরেই রয়েছে। দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে পর্যাপ্ত নৌকার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, জেলায় বর্তমানে ৭ লাখ ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ২৩ হাজার ৪০৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৯৪৩ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
এদিকে উজান থেকে আসা পানির চাপ বাড়তে থাকার পাশাপাশি নতুন করে বৃষ্টির ফলে নোয়াখালীর সার্বিক বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই বন্যার পানি বেড়েছে। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়েছে সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলায়। এসব উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কেশারপাড় ইউনিয়নে বন্যার পানিতে ডুবে আবদুর রহমান (২) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় বন্যায় পাঁচজনের মৃত্যু হলো।
নোয়াখালী জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, রোববার সকাল নয়টা থেকে গতকাল সোমবার সকাল নয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মাইজদীতে ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাবে আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও বৃষ্টি হতে পারে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
বন্যা ও বৃষ্টির পানির চাপে গতকাল সকালে ধসে পড়েছে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর স্লুইসগেট (রেগুলেটর)। পানি উন্নয়ন বোর্ড, নোয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির ফয়সাল বলেন, উজান থেকে ধেয়ে আসা পানি ও অতিবৃষ্টির চাপ নিতে না পারার কারণে স্লুইসগেটটি ভেঙে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে তাঁরা ধারণা করছেন।
ফলে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, ফেনী সদর, দাগনভূঞা, সোনাগাজীর একাংশ এবং নোয়াখালীর সেনবাগ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একাংশে জমে থাকা বন্যার পানি দ্রুত নামতে পারবে। পাশাপাশি সাগরে যখন বেশি জোয়ার হবে, তখন লোনা পানিতে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হতে পারে।
এবার বন্যায় পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়েছে ফেনীতে। এখানকার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী—এ ছয় উপজেলা পুরো বন্যাকবলিত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছয়টি উপজেলার প্রত্যন্ত ও দুর্গম গ্রামগুলোয় পানি ও খাবারের সংকট রয়েছে। বিশেষ করে কহুয়া, মুহুরী ও সিলোনিয়া নদী–লাগোয়া গ্রামগুলোয় ঢুকতেই পারছেন না স্বেচ্ছাসেবকেরা। ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা ঢলে এ তিন নদীর পানি গত কয়েক দিন বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গ্রামগুলোর দোতলা ভবন পর্যন্ত ডুবে গেছে।
সোনাগাজী উপজেলার মুহুরী রেগুলেটরের ৮ ও ১২ নম্বর গেটের দুটি দরজা উজানের পানির স্রোতে ভেঙে গেছে। আরও আটটি দরজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঝুলছে। গতকাল দুপুরে পুলিশ মুহুরী প্রকল্প এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় একজনের লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে গেছে।
বন্যায় জেলায় আট লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার। তিনি বলেন, দেড় লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৬২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার এবং ১ হাজার ৩০০ টন চাল দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বন্যাকবলিত এলাকাগুলো থেকেও একটু একটু করে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে এখনো অনেক মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মুশফিকুর রহিম জানান, যেখান থেকে যে তথ্য পাচ্ছেন সেভাবে বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলায়ও পানি কমেছে। ফটিকছড়ির আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষজন বাড়িতে ফিরে গেছে। তবে পানি জমে থাকায় হাটহাজারীর কয়েক শ মানুষ এখনো ঘরে ফিরতে পারেনি।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, তাঁর উপজেলায় সাড়ে সাত হাজার কাঁচা বসতঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৬০০ বসতঘর। সড়ক–মহাসড়কেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাউজানের ইউএনও অংগ্যজাই মারমা বলেন, তাঁর উপজেলায় বাড়িঘরের চেয়ে সড়কের ক্ষতি হয়েছে বেশি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগসংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১টি জেলায় ৭৪টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত। এখন পর্যন্ত ২৩ জন মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মৌলভীবাজারে দুজন নিখোঁজ আছেন। মোট ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৭ লাখ ১ হাজার ২০৪ জন। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩৪টি। এগুলোতে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৫২৩ জন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। কুমিল্লা জিওসির তথ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কুমিল্লা জেলার সব উপজেলায় সড়কপথে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। গতকাল ২০ হাজার প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করার কথা ছিল। যার মধ্যে আট হাজার প্যাকেট হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বিতরণের কথা।
ফেনীতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানে সেনাবাহিনী ও জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসকেরা সেবা দিচ্ছেন। পাশাপাশি স্থানীয় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।