‘যৌক্তিক সময়ের’ মধ্যে নির্বাচন দাবি বেশিরভাগ দলের

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৪৩

ছবি: সংগৃহীত

রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার ও নির্বাচনের রূপরেখা তৈরিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফা আলোচনা শেষ করেছে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় রাষ্ট্র সংস্কারের নানা প্রস্তাব তুলে ধরেছে দলগুলো। নির্বাচন কবে হবে, সে ব্যাপারে একটি রূপরেখা বা রোডম্যাপ দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে প্রায় সব রাজনৈতিক দল।

অন্যদিকে সরকার বলেছে, দলগুলোর সঙ্গে এ আলোচনায় যেসব সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে, সেগুলোর ভিত্তিতে সরকার নির্বাচনের একটি রূপরেখা তৈরি করবে। এটি চূড়ান্ত করার আগে আরেক দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময়ে সংবিধানের বহুল আলোচিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। আর হেফাজতে ইসলাম ও ছয়টি ইসলামি রাজনৈতিক দল বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে সংবিধান কমিশন গঠনের মাধ্যমে নতুন করে সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব দিয়েছে। গণভোটের মাধ্যমে সেই সংবিধান অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছে এই দলগুলো।

এছাড়া, একই ব্যক্তি যেন দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে না পারেন- সেই প্রস্তাব দিয়েছে জাপাসহ ইসলামী দলগুলো। গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার বাসভবন ও কার্যালয় ‘যমুনা’য় মতবিনিময়কালে দলগুলোর নেতারা এই প্রস্তাব দেন।

গতকাল ড. ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় করে হেফাজতে ইসলাম এবং ছয়টি ইসলামি রাজনৈতিক দল- চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফতে মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম ও খেলাফত আন্দোলন।

এছাড়া মতবিনিময়ে অংশ নেয়- এলডিপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাংলাদেশ জাসদ, ১২ দলীয় জোট ও গণফোরাম। মতবিনিময়কালে সবগুলো দলই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্র্বতী সরকারকে সময় দিতে নিজেদের সম্মতির কথা জানিয়েছে।

বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দলগুলোর সাথে মতবিনিময় শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, সংবিধান নতুন করে লেখা হবে নাকি সংশোধন করা হবে- সেবিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়কালে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।

আর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবনার ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে- তা নিয়ে শিগগিরই অন্তর্র্বতী সরকার একটি রূপরেখা ঘোষণা করবে।

সন্ধ্যা সাতটায় জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দলটির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময়ে বসেন। প্রতিনিধি দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য মনিরুল ইসলাম মিলন ও মাশরুর মাওলা।

প্রায় পৌণে এক ঘণ্টা মতবিনিময় শেষে যমুনা থেকে বেরিয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, মতবিনিময়ে তাদের দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছেন।

মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বিচারবিভাগ ও সংসদের মধ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন তারা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন। এক ব্যক্তি যেন দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে না পারেন- সে ধরনের সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। সংসদ নেতা যেন প্রধানমন্ত্রী না হন, সেকথাও বলেছেন।

এছাড়া বিচারবিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশসহ বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে যতটুকু যৌক্তিক সময় প্রয়োজন; সে পর্যন্ত এসরকারকে সময় দিতে রাজি বলে মতবিনিময়ে জানিয়েছে জাপা।

এক প্রশ্নের জবাবে জাপা মহাসচিব বলেন, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে জাপা বিগত নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়েছে। জাপা এপর্যন্ত সব নির্বাচনেই অংশ নিয়েছে। আমরাও ক্ষমতায় ছিলাম। আমাদেরও ভুলত্রুটি আছে, সবারই ভুলত্রুটি আছে। আমাদের যেন আর ভুলত্রুটি না হয়, সেজন্যই প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলেছি। কারণ, আমরা মনে করি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে যে সংস্কারগুলো করতে পারবে না, বর্তমান সরকার তা করতে পারবে- এই আস্থা আমাদের রয়েছে।

হেফাজতে ইসলাম ও ৬টি ইসলামি দলের নেতারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তারা দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি না থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। পাশাপাশি একটা যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে বলেছেন। বৈঠক শেষে হেফাজতে ইসলামের নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক সাংবাদিকদের একথা জানান।

মামুনুল হক বলেন, যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে নির্বাচনের আয়োজন করতে বলেছেন তারা। নির্বাচনে অযথা কালবিলম্ব যেন না করা হয়, সেটা উল্লেখ করেছেন। ইসলামি দলগুলোর এমন প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একমত পোষণ করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর কালবিলম্ব না করে নির্বাচনের দিকে চলে যেতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন।

যৌক্তিক সময়টা কত দিনের, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মামুনুল হক বলেন, যৌক্তিক সময়ের বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাবনা দেওয়া হয়নি। সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নিয়ে আমরা আলোচনা করিনি।

প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিটি দল সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেছে জানিয়ে তিনি বলেন, মৌলিকভাবে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। তিনি বলেন, দেশব্যাপী সব ভোটারের প্রতিনিধিত্ব যাতে জাতীয় সংসদে নিশ্চিত করা যায়, সেধরনের একটা মৌলিক পরিবর্তনের সংস্কারের প্রস্তাব আমরা দিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার যে ব্যবস্থা এবং যেখান থেকেই স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব, এই জায়গায় যেন ভারসাম্য তৈরি করা হয়, সেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানান মামুনুল হক।

মামুনুল হক বলেন, হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন আন্দোলনে বহু মামলা এবং শত শত ব্যক্তি হতাহত হয়েছেন, অনেকে নিখোঁজ, তাদের সন্ধানে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সব হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। যারা দায়ী, যারা নির্দেশদাতা তাদেরও যাতে বিচারের মুখোমুখি করা যায়, সে দাবি জানিয়েছেন তারা।

তিনি বলেন, ইসলামবিরোধী কোনো আইন যাতে প্রণয়ন করা না হয়, আমরা সেই প্রস্তাব দিয়েছি। পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের মামলা নির্বাহী আদেশ অথবা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেন প্রত্যাহার করা হয়, সেজন্য আমরা এক মাসের সময়সীমা চেয়েছি।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের (পীর সাহেব চরমোনাই) নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেয়। গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিশন ও স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই গণহত্যাকাণ্ডের বিচার করাসহ ১৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন- মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ও ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আশরাফুল আলম।

ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার যেহেতু একটি গণ-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনগণের অভিপ্রায়ে গঠিত হয়েছে এবং এই সরকারের পক্ষে যেহেতু রাজনৈতিক ঐকমত্য রয়েছে; অতএব দেশকে এবং দেশের রাজনীতিকে সঠিক ধারায় নিয়ে আসার ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করে, অন্তর্র্বতী সরকার যদি প্রাপ্ত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ না করে তাহলে হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তদান ব্যর্থ হবে।

ইসলামী আন্দোলনের প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে- বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠনের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করা এবং গণভোটের মাধ্যমে তা অনুমোদন করা; বিগত ১৬ বছরে সংগঠিত সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা, গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করা এবং এক্ষেত্রে যেসব ব্যক্তি বা সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হবে তাদেরকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করতে হবে;

তদন্ত সাপেক্ষে বিগত বছরের সকল দুর্নীতিবাজ ও বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের সকল সম্পত্তি ক্রোক করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা; পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ গ্রহণ; অবৈধ ও প্রহসনের নির্বাচনে সহযোগিতাকারী ৩টি নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করা।

বৈঠক শেষে বিএনপি মিত্র ১২ দলীয় ঐক্য জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে শহীদ আবু সাঈদ নামকরণ করতে বলেছি। মুগ্ধকে স্মরণ করার জন্য উত্তরাকে মুগ্ধনগর করার প্রস্তাব দিয়েছি। চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনাল যেন বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া না হয়, সেই প্রত্যাশার কথা বলেছি আমরা।

বৈঠকে জাপাকে আমন্ত্রণ জানানোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এই জিএম কাদের গং ছলে বলে কৌশলে গণতন্ত্র হত্যা করেছে।’ বৈঠকে নেতৃত্বে দেন ১২ দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার।

প্রসঙ্গত, অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-জোটের এটি দ্বিতীয় ধাপের মতবিনিময়। প্রথম দফায় বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতারা বৈঠক করেন। তবে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলীয় জোটের কাউকে এখনও বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে সংলাপ হয়েছে, তাতে সব দল ‘যৌক্তিক সময়ের’ মধ্যে নির্বাচন চেয়েছে। তবে সে সময় কতদিন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়নি কোনো দল।

বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে ‘অতি দ্রুত’ সংলাপের দাবি উঠার পর বেশকিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা। শনিবার (৩১ আগস্ট) বিকেল তিনটায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যুমনায় শুরু হওয়া এই সংলাপ চলে রাত পর্যন্ত।

সংলাপে দলগুলোর পক্ষ থেকে আগে সংস্কার করে পরে নির্বাচনের দাবি তোলা হয়। এর পাশাপাশি সরকার পতন আন্দোলনে সংঘটিত হত্যার বিচারে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার, সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপনের দাবি উঠে আসে।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top