আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন নিয়ে গুজব, হাল ধরছেন কে?
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:৫২
গণআন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর এখনও নিজেদের স্বাভাবিক চলাফেরা ও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন দলটির সর্বস্তরের নেতারা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় বহু নেতারাও ‘আত্মগোপনে’ রয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেকে। ফলে নেতৃত্বশূন্যতা অনুভব করছেন বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
এমন অবস্থার মধ্যে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে, শিগগিরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বে কারা আসছেন, সেটি নিয়েও নানা আলোচনা শোনা যাচ্ছে।
সাংগঠনিক এ বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক আলোচিত মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে দলের হাল ধরতে যাচ্ছেন বলে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গুঞ্জন উঠেছে। তবে এ ধরনের গুঞ্জনকে অপপ্রচার বলে দাবি করেছেন দলটির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা।
আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, এসব সবই অপপ্রচার। কমিটি পরিবর্তনের ওইরকম কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি। কিন্তু হঠাৎ এমন ‘অপপ্রচার’ ছড়ানোর কারণ কী? কারাই-বা এটি ছড়াচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই নেতা বলেন, এটি ছড়ানোর উদ্দেশ্য হলো আওয়ামী লীগকে দ্বিধাবিভক্ত করা। দলে ফাটল ধরানোর জন্যই বিএনপি-জামায়াত এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে, যা আগেও বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি।
এ ছাড়া তৃণমূলের কর্মীরা শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটি স্বীকার করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের শীর্ষ ওই নেতা আরও বলেন, আমাদের যে ভুল আছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন কীভাবে সেই ভুল শুধরে দলকে আবারও সক্রিয় করা যায়, মিটিং হলে আমরা সেটিই আলোচনা করবো। সূত্র: বিবিসি বাংলা
আওয়ামী লীগের আত্মগোপনে থাকা সভাপতিমণ্ডলী ও সম্পাদকমণ্ডলীর বেশ কয়েকজন সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, দলের প্রয়োজনে ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব দেওয়ার সময় এলে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্য থেকেই দায়িত্ব দেওয়া হবে। নির্বাচিত নেতৃত্বের বাইরে থেকে কাউকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়ার নজির আওয়ামী লীগে নেই। দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসাই এখন সবার কাম্য। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি শিগগিরই কেটে যাবে বলে আশা করছেন তারা। তাই এখনই দলের শীর্ষ পদে রদবদল এবং ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করার ভাবনা নেই দলের অভ্যন্তরে।
আওয়ামী লীগের আত্মগোপনে থাকা বিভিন্ন পদের কেন্দ্রীয় নেতারা আরও বলেন, দলের সব স্তরের নেতাকর্মীরা জীবন শঙ্কায় দিন পার করছেন। অকল্পনীয় ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। চলমান পরিস্থিতিতে দলের নেতাকর্মীরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সম্ভবত অল্প কয়েকজন নেতার সঙ্গে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যোগাযোগ করেছেন। সেই যোগাযোগের সময় মূল নির্দেশনা ছিল আপাতত প্রত্যেকের জীবন রক্ষার, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের কোনো দিকনির্দেশনা আসেনি। বিভিন্ন অপরিচিত মোবাইল ফোন নাম্বার থেকে যোগাযোগ করে এমন তথ্য জানান জীবন-ঝুঁকিতে থাকা কেন্দ্রীয় এসব নেতা।
ক্ষমতার পালাবদলের পর গতকাল সোমবার পর্যন্ত কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য-প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত ছিল পঁচাত্তর বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। মাঝে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলীয় প্যাড ব্যবহার করে বিবৃতি এলেও তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এসব বিবৃতির সত্যতা নিয়ে আলোচনা আছে দলটির কর্মীদের মধ্যে। দলের দপ্তর বিভাগও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর প্রথমে কয়েক দিন ভিডিও বার্তা দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা ও তার ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সজীব ওয়াজেদ জয়। তবে বেশ কয়েক দিন ধরে তিনিও নীরব।
আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, অন্তর্র্বতী সরকারের দায়িত্ব ও কর্মকাণ্ড নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন তারা। আরও অন্তত এক মাস পরিস্থিতি দেখবে আওয়ামী লীগ। তারপর দলীয় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হবে। কথা বলার মতো এখনই উপযুক্ত ও অনুকূল পরিবেশ আওয়ামী লীগের জন্য আসেনি। তাছাড়া সাধারণ মানুষ চলমান নানা ঘটনাগুলো কীভাবে নিচ্ছে, তা দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে দল চালানোর মতো পরিস্থিতি এখনো এসেছে বলে মনে করছে না আওয়ামী লীগ। সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত নেতৃত্ব এখনো রয়েছে। ফলে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার যে প্রচার-প্রোপাগান্ডা চলছে এর কোনো সত্যতা নেই। দলের প্রয়োজনে ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব দেওয়ার সময় এলে দলের নির্বাচিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্য থেকেই দায়িত্ব দেওয়া হবে। নির্বাচিত নেতৃত্বের বাইরে থেকে কাউকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়ার নজির আওয়ামী লীগে নেই।’
ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়ার গুঞ্জনকে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল দুর্বল করার কৌশল অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, ‘আমার জানামতে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দলের অনেক নেতার ইতিমধ্যে যোগাযোগ চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে অমুক-তমুককে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়ার যে আলোচনা চলছে, তা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনোবল দুর্বল একটি খেলা (ষড়যন্ত্র)। এটা দল ভাঙার এক ধরনের খেলার অংশও হতে পারে।’
ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে দল চালানোর সময় এখনো আসেনি বলে মনে করছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদের এক নেতা। তিনি বলেন, ‘সাধারণ সম্পাদক পদে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়া হবে, এটি আমারও দাবি। তবে সভাপতি পদে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়ার প্রয়োজন দেখছি না। ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব আপাতত দেওয়া হবে বলে আমার জানা নেই। এটি করতে হলে বেশ কিছু নিয়ম মানতে হয়, দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা আহ্বান করতে হয়। এগুলো কোনোটিই করার পরিস্থিতি বা সুযোগ না ঘটলে সভাপতির ক্ষমতাবলে করার সুযোগ রয়েছে। সবই হবে হয়তো, কিন্তু আপাতত নয়। আরও একটু সময় নেওয়া হবে এ ক্ষেত্রে।’
কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরের কাউকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়ার নজির আওয়ামী লীগে নেই বলে জানান দলটির আত্মগোপনে থাকা সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য। তিনি বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও গঠনতান্ত্রিক বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরের কোনো নেতাকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব অতীতে কখনো দেওয়া হয়নি। গঠনতন্ত্রও বৈধতা দেয় না এ ক্ষেত্রে।
দল বিপর্যয়ের মুখে পড়লে, কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো নেতা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলে বা পাওয়া না গেলে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। এজন্য তলবি সম্মেলন করতে হয়। তলবি সম্মেলন করে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে সে পথ অনুসরণ করে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগে সভাপতিও আছেন, সাধারণ সম্পাদকও আছেন।’ আওয়ামী লীগের জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলনেও দেখা গেছে, আগের কমিটিতে পদে না থাকা কোনো নেতা সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার নজির নেই।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কে কাকে নেতৃত্ব দেবে? আগে তো দল টিকিয়ে রাখতে হবে। কর্মীরা হামলা-মামলায় পড়ছে। তাদের আগে নিরাপদ রাখতে হবে। এখন আর আগের মতো হুটহাট কর্মসূচি দিলে হবে না। অনেক ভেবে-চিন্তে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বিদেশে অবস্থান করার সময়ই ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনা দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপরই তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ১৯৮১ সালে দলের অবস্থা বর্তমানের চেয়ে খারাপ ছিল। সেই সময় দেশে না থেকেও শেখ হাসিনাকে দলের হাল ধরতে হয়। সেই তুলনায় এখনের অবস্থা ভালো। এদিকে আওয়ামী লীগের একটি অংশ দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বের অবসান চান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দায়ী। তার কথার লাগাম ছিল না। তার কারণে দলের এই পরিণতি। তার পরিবর্তে একজন জনপ্রিয় নেতাকে দায়িত্ব দিতে হবে। এখন অনেক নেতাই পলাতক রয়েছেন। সেক্ষেত্রে কর্মীদের সঙ্গে যিনি যোগাযোগ করতে পারবেন; এমন কোনো নেতার প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ২০০৭ সালের ১/১১'র সময় যেভাবে দলের হাল ধরেছিলেন তখনকার দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেই আশরাফুলের মতো একজন নেতার খুব প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ এমন একজন নেতাকেই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে খুঁজছে। প্রয়োজনে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। নেতারা আত্মগোপনে আছেন, কর্মীদের পাশে কেউ নেই। কর্মীদের সক্রিয় রাখতে হলে দেশের মধ্যে কাউকে না কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ফলে আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে। সরকার পতনের কারণে রাজনৈতিকভাবে ভেঙে পড়া দলটিকে আবারও চাঙা করতে এবং সব নেতাকর্মীকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দলের হাইকমান্ড।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।