আওয়ামী লীগের এমন করুণ পরিণতিতে দায়ী কারা?
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:৫৬
সেই ২০০৮ সাল থেকে টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। সবশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতায় এলেও ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয়েছে দলটির। এরপর থেকেই দেশে ও বাইরে আত্মগোপনে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ নেতারা। বাংলাদেশে গত ২৩শে জুন ঘটা করে দলের ৭৫ বছরপূর্তি পালন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেদিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সমাবেশে নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। অথচ মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি পাল্টে গেছে।
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ লোকজন। দলের এমপি-মন্ত্রীসহ প্রভাবশালীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মুখে পড়ে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের পর নামফলক ভেঙে ফেলে ‘ছাত্র জনতার কার্যালয়’ উল্লেখ করে নতুন নামফলক টানানো হয়। অবশ্য ছাত্র-জনতা শীর্ষক নাম ফলকটি সরিয়ে আবারও আওয়ামী লীগের নামে ব্যানার লাগানো হলে সেটাও ছিঁড়ে ফেলা হয়।
৭৫ বছর রাজনীতিতে থাকা দলের এমন করুণ পরিণতির জন্য মুষ্টিমেয় নেতাদের দুষছেন শীর্ষ নেতারা। তাদের অভিযোগ, এত বছর ক্ষমতায় থেকেও সংগঠনকে শক্তিশালী না করে ব্যক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন এই নেতারা। ক্ষমতা তাদের কাছে কুক্ষিগত থাকায় মূল্যায়ন করা হয়নি ত্যাগী নেতাকর্মীদের। মুষ্টিমেয় নেতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতা। তাদের মধ্যে একজন সাংগঠনিক সম্পাদক গণমাধ্যমকে বলেন, ওরা দেশটা গিলে খাইসে, আমাদের কথা শুনে নাই। আমার সঙ্গে কারো যোগাযোগ নাই। এখন রাজনীতিতে নাই। দেখি তারা কী করে। যারা আছে তারা দল চালাক।
যাদের দিকে অভিযোগের তীর তারা হলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে চলে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলীয় প্রধানের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য ও দলের অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরে স্থলপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেছেন। কেউ কেউ আকাশ পথেও বিদেশ যেতে সক্ষম হয়েছেন। কেউ পালাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, বাকিরা এখনও দেশের ভেতরে আত্মগোপনে রয়েছেন।
এই অভ্যুত্থানের পরে তো অবশ্যই, আগেও বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। দুঃসময়ে কাউকে পাশে পায়নি না এবং এখনও পাচ্ছে না দেশের সব থেকে পুরনো রাজনৈতিক দলটি। এর জন্য মূলত দুর্নীতিবাজ আর দুর্বৃত্তপরায়ণ নেতাদের দুষছেন অনেক কেন্দ্রীয় নেতা।
আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দীর্ঘ দিন টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন করেনি। বরং ব্যবসায়ীমুখী প্রবণতা দেখা গেছে দলটির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে ৬০ শতাংশের বেশি সংসদ সদস্যের চেয়ার ছিল ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ। যেখানেই টাকাওয়ালা সেখানে দেওয়া হয়েছে মনোনয়ন। জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়েও মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। আবার এমপি কিংবা মন্ত্রীর আত্মীয়রাও ভাগিয়ে নিতেন উপজেলা বা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের মনোনয়ন। সব জায়গায়ই আত্মীয়করণের প্রবণতা ছিল প্রবল।
আত্মগোপনে থাকা কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বরাতে বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) অনলাইন গণমাধ্যম ঢাকা পোস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দলটির এক নেতার বরাতে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল। সেটি নামেমাত্র ছিল। কমিটিকে এক সাইডে রেখে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল কয়েকজনের হাতে।
তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তারাই আওয়ামী লীগকে পরিচালনা করেছে। অনেক বিষয়ে তারা জানতেন কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও জানতেন না। এরা দলের হাইকমান্ডকে দেশের সঠিক পরিস্থিতি বা সঠিক তথ্য দিত না। সে কারণে আজকে আওয়ামী লীগের এমন করুণ পরিণতি।
আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ছিল ৮১ সদস্য বিশিষ্ট। কিন্তু এখানে কয়জন সক্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন? এমনও আছে, যাদের দেশের মানুষ চেনে না। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের মতো দলে কেন অপরিচিত বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে ভেড়াতে হবে? তারা কী দলের দুর্দিনে থাকবে? এখন দেখেন তারা কিন্তু নেই। আমরা দলের থাকলেও দলের মধুটা কিন্তু উনারাই খেয়েছেন। সরকার পরিচালনা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই তারা সামনের সারির লোক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা বাড়াবাড়ি করেছে।
তিনি আর বলেন, আওয়ামী লীগের একটি উপদেষ্টামণ্ডলীর কমিটি রয়েছে। সেখানে অনেক অভিজ্ঞ নেতা ছিলেন। করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত নেত্রী তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন। পরবর্তীতে হাইব্রিডরা নেত্রীর আশেপাশে ভিড়তে থাকে। তাকে সিনিয়রদের কাছ থেকে আলাদা করে। নেত্রীর আশেপাশে সিনিয়ররা থাকলেও এমন আন্দোলন মোকাবিলা করা কোনো বিষয় ছিল না। আমার কাছে মনে হয়, সঠিক তথ্যটাই নেত্রী পায়নি।
দলটির সিনিয়র নেতারা জানান, দীর্ঘ দিন ক্ষমতা থাকার কারণে দলের অনেকগুলো উইংস দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তারা কোনো কাজ করতে পারত না। উপর মহলের নির্দেশ বাস্তবায়নে দিন পর করত। সেসব উইংসের যে নিজস্ব কিছু কাজ আছে সেগুলো ভুলে গিয়েছিল। সরকার পতনের এক মাস পেরিয়ে গেলো। অথচ এই সময়ের মধ্যে সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও দেওয়া গেলো না! এতেই প্রমাণিত হয় উইংগুলো কাজের যোগ্যতা হারিয়েছে। এখন দলটাকে পুনর্গঠন করতে হবে। ব্যক্তি বিশেষে দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে না। রাজনীতিতে অভিজ্ঞদের অবহেলিত না করে কাজে লাগাতে হবে। আওয়ামী লীগকে সক্রিয় করতে হলে তৃণমূলকে সক্রিয় করতে হবে।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।