জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা, মুক্তি ঘিরে শঙ্কা
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬:৫১
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। সেই সুযোগে জেল থেকে একে একে জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। যাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও হত্যাসহ ডজনের বেশি মামলা রয়েছে।
গেল ৫ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন হামলা হয় অন্তত পাঁচ শ থানায়। লুট হয় অস্ত্র-গোলাবারুদ। খোয়া যায় এসএসএফের অস্ত্রও। এর বেশির ভাগই উদ্ধার হয়নি এখনও। এরই মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কারামুক্তি এসেছে বড় আলোচনায়। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগারে থেকেই ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন। দাগি সন্ত্রাসীরা আবার বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন। এভাবে জামিনে মুক্তি পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে।
জামিনে মুক্ত হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে আছেন ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, হাজারীবাগ এলাকার সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন। এ ছাড়া ঢাকার অপরাধজগতের আরও দুই নাম খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসুও কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
চলতি মাসের শুরুর দিকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন রাজধানীর পূর্ব রাজা বাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম। ১৯৯৭ সালে সুইডেন আসলামকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ২২ টি মামলা ছিল। এর মধ্যে তেজগাঁও এলাকায় গালিব হত্যাসহ ৯ টি হত্যা মামলা রয়েছে।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে আরও ৫ জন গত এক মাসে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এরা হলেন সানজিদুল ইসলাম ইমন ওরফে কলাবাগান ইমন, আব্বাস, টিটন, পিচ্চি হেলাল, ফ্রিডম রাসু। গত ১৪ আগস্ট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ইমন মুক্তি পান। একই সময়ে ইমনের প্রধান সহযোগী মামুনও জামিনে মুক্তি পান।
এর আগে ১২ আগস্ট একই কারাগার থেকে মুক্তি পান ফ্রিডম রাসু ও পিচ্চি হেলাল । রাসুর বিরুদ্ধে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাসহ ১৩ টি মামলা রয়েছে। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তেইশ শীর্ষ সন্ত্রাসী তালিকা প্রকাশের আগেই পিচ্চি হেলাল মোহাম্মদপুর থেকে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তার বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলাসহ ৮ টি মামলা রয়েছে।
২০০১ সালের ডিসেম্বরে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা করে সেসময়কার সরকার। তেইশ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকার ২ নম্বরে টিটনের নাম রয়েছে। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার একটি বাসা থেকে ডিবি ১ টি পিস্তলসহ তাকে গ্রেপ্তার করে। মামলাগুলোর জামিন হওয়ার পর গত ১২ আগস্ট কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেল থেকে জামিনে মুক্তি পান টিটন।
১৩ আগষ্ট কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেল থেকে জামিনে মুক্তি পান আব্বাস উদ্দিন ওরফে কিলার আব্বাস। রাজধানীর কাফরুল, কচুক্ষেত ও ইব্রাহিমপুর এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন ছিলেন আব্বাস। তার বিরুদ্ধে ৬ টি হত্যা মামলাসহ ১০ টি মামলা বিচারাধীন। তবে এই ১০ টি মামলায় একে একে তিনি জামিন পান।
এর আগে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে অন্যতম বিকাশ কুমার বিশ্বাস ওরফে বিকাশ ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জামিনে মুক্তি পেয়ে লাপাত্তা হন। এরপর থেকে বিকাশ ফেরারী আসামি হয়ে ভারতে আত্মগোপন করেছেন।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের এই তালিকায় চার নম্বর তালিকাভূক্ত আসামি ছিলেন তানভীরুল ইসলাম জয়। ২০০৪ সালে তিনি পালিয়ে আমেরিকায় আত্মগোপন করেন। বছর চারেক আগে তিনি মালয়েশিয়ায় আত্মগোপন করেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় চলতি বছরে ১৩ এপ্রিল মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ নিয়ে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় কারাবন্দী রয়েছেন মগবাজারে শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান, মোহাম্মদপুরের কামাল পাশা ও খিলগাঁওয়ের ফ্রিডম সোহেল।
জামিন নিয়ে লাপাত্তা কয়েকজন। যাদের বেশিরভাগে নামে ঝুলছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়ার পরই কারামুক্ত হচ্ছে এসব আসামি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, সরকার ঘোষিত বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে বড় অংশই এখন দেশের বাইরে। মারা গেছেন কেউ কেউ। তাদের বাইরে যারা কারাগারে আছেন, তাদের বেশির ভাগই দু–একটি মামলা ছাড়া অন্যগুলোয় খালাস পেয়ে কিংবা জামিন নিয়ে কারাগারে অবস্থান করছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এখন তাঁরা জামিনে বের হয়ে আসছেন।
২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম প্রকাশ করে। তাতে আব্বাস, হেলাল, টিটন ও রাসুর নাম ছিল। এই চারজনসহ জামিনে বের হওয়া প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ অনেক মামলা রয়েছে। কোনো কোনো মামলায় তাদের সাজাও হয়। আবার কোনো কোনো মামলায় উচ্চ আদালত থেকে অব্যাহতিও পান কেউ কেউ। সুইডেন আসলামসহ কয়েকজনের ক্ষেত্রে অব্যাহতি পাওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল না করার ঘটনাও রয়েছে।
শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কীভাবে জামিন পাচ্ছেন, এ বিষয়ে গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বড় অপরাধীদের মামলা, জামিন, গ্রেপ্তার ও সামগ্রিক কার্যক্রমের ওপর পুলিশের বিশেষ শাখাসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা সব সময় নজরদারি করত। সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা খুব সহজেই বের হয়ে আসছেন। আবার বের হওয়ার পর তাঁদের ওপর কোনো নজরদারি নেই।
ঢাকার অপরাধ জগত নিয়ে খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। মিরপুর এলাকার এক শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগার থেকে বের হয়ে নেপালে পাড়ি জমিয়েছেন এমন গুঞ্জনও রয়েছে। কেউ আবার পুরোনো রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আশায় আছেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের কারও কারও সখ্য হয়েছে। সেই সুযোগও কাজে লাগাতে চাচ্ছেন কেউ কেউ।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের জেলার লুৎফর রহমান বলেন, জামিন ছাড়া কেউ যেতে পারবে না। যারা যারা গিয়েছেন, সবাই সঠিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গিয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জামিনে বের হয়ে কেউ যেন নতুন করে অপরাধমূলক কাজে জড়াতে না পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে আমাদের কঠোর নজরদারি থাকবে। শীর্ষ সন্ত্রাসী, গডফাদার বা যেকোনো পরিচয়েই হোক, অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
২০০১ সালে সরকার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ মোট ৩০ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে নিয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধান করে প্রথম আলো। এতে কারাগারে থাকা অবস্থায় অন্তত সাত শীর্ষ সন্ত্রাসীর ঢাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ ও সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়। এসব ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিভিন্ন সময়ে কারাগারে থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অপরাধে জড়ানোর তথ্য দেয়।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগারে থেকেই বাইরের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাই জামিনে মুক্ত হলে তাঁদের অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘জামিনে বের হওয়া সন্ত্রাসীরা আবার পুরোনো অপরাধের নেটওয়ার্ক সচল করছেন কি না, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা প্রয়োজন। তা না হলে ছাত্র–জনতার নতুন বাংলাদেশের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি নষ্ট হবে।’
অপরাধ বিশ্লেষক ড. হাফিজুর রহমান কার্জন বলেছেন, আমরা কিন্তু অনেকগুলো ঘটনা জানি যে উচ্চ আদালত থেকে এসব অপরাধীরা হত্যা মামলার আসামি হিসেবে জামিনে বেরিয়ে আসে আবার হত্যা করেছে। এটা প্রযোজ্য যারা সাধারণ হত্যা মামলার আসামি। আর যারা শীর্ষ সন্ত্রাসী রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে-তো শুধুমাত্র হত্যা হয়, নানা ধরনের অপরাধ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তাতে করে তো, দেশের যে সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সেটার-ই অবনতির একটা আশঙ্কা আমরা করছি। সূত্র: প্রথম আলো, ইত্তেফাক
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।