বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির ‘ভূমিকা’

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:০৮

ছবি: সংগৃহীত

চলতি বছরের শুরুর দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর মে মাসজুড়ে ছিল ভারতের সাধারণ নির্বাচন। এক সময় একসঙ্গে থাকা এ তিন ভূ-খণ্ডের নির্বাচন, রাজনীতি, সরকারপ্রধানের স্থায়িত্ব, ক্ষমতার রদবদলসহ নানা বিষয়ে আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির মনোভাব কিংবা কারও কারও মতে ‘হস্তক্ষেপ’ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরেই চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সমসাময়িক এসব বিষয়েই ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার নিবন্ধ লিখেছেন মোহিত রায়। পত্রিকাটি তার এ নিবন্ধ গত সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) প্রকাশ করে।

এতে তিনি লেখেন, বছরটা শুরু হয়েছিল ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের দুটি নির্বাচন দিয়ে। বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হল ৭ জানুয়ারি এবং একমাস বাদে ৮ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচন হল পাকিস্তানে। এই দুই দেশের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় পার্থক্য ছিল প্রধানমন্ত্রীদের স্থায়িত্ব। পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত ২৯ জন প্রধানমন্ত্রীর কেউ পূর্ণ সময় মন্ত্রিত্ব করতে পারেননি। এ বারের নির্বাচনের কিছু আগে পদচ্যুত হলেন ইমরান খান। অন্য দিকে, বাংলাদেশের ছবিটা একেবারেই বিপরীত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে পনেরো বছর শাসনকাল পূর্ণ করে আবার নির্বাচিত হলেন।

এই দুই প্রান্তের নির্বাচনী প্রেক্ষাপটের অবশ্য কিছু মিলও রয়েছে। পাকিস্তান তার গত পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসে এবং বাংলাদেশ তার পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে অর্ধেক সময় কাটিয়েছে সামরিক শাসনে। কিন্তু যে মিলটি এ বারের দুই দেশের নির্বাচনেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তা হল আমেরিকা ও পশ্চিমি শক্তির নির্বাচনী ব্যাপারে মনোভাব, বা কারও মতে হস্তক্ষেপ।

নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের ব্যাপারটা ঘনাচ্ছিল ২০২২-এর প্রথম দিক থেকেই। অনেকেই মনে করেন সামরিক বাহিনীর সমর্থনেই ২০১৮-তে ইমরান খানের শাসনক্ষমতায় প্রবেশ। পাকিস্তানে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্রমশ ইমরান কিছুটা স্বাধীন নীতিতে চলার ইচ্ছা প্রকাশ করতে শুরু করেন। বিভিন্ন বিষয়ে আমেরিকা বিরোধিতা, কখনও ভারতের উন্নয়নের প্রশংসা ইত্যাদি। ব্যাপারটা একেবারে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছল যখন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ইমরান গেলেন রাশিয়া সফরে।

পঁচিশ বছর পর কোনও পাকিস্তান রাষ্ট্রপ্রধানের রাশিয়া যাত্রা। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। এর পর ইমরান খান তার বিবৃতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার নিন্দা করলেন না, কূটনৈতিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যা নিরসনের কথা বললেন। আমেরিকান মহল ক্রুদ্ধ, পাকিস্তানের সেনা মহল ইমরানের মতের বিরুদ্ধেই রাশিয়াকে আগ্রাসী বলে নিন্দা করল। এশিয়ায় আমেরিকান সামরিক প্রভাব রক্ষায় প্রথম থেকেই পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রহরী, সিয়াটো সেন্টো বিভিন্ন সামরিক চুক্তিতে দীর্ঘ দিন যুক্ত। পাকিস্তানের সেনা মহলের প্রতিপত্তির প্রধান শক্তি আমেরিকার সামরিক সহায়তা। সুতরাং ইমরান খানের বিতাড়ন প্রয়োজন হয়ে পড়ল।

ইমরান খান এ সব কিছু গোপন রাখলেন না। জনসভায় পকেট থেকে আমেরিকা সরকারের তার বিরুদ্ধে হুমকির চিঠি বার করে দেখালেন। তার পর সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ডাক দিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ইমরানের এই পদক্ষেপ বেআইনি ঘোষণা করে এবং সংসদে আস্থা ভোটে ইমরান হেরে যান। পাকিস্তানের আদালত ইমরান খানের এই আমেরিকার চিঠি প্রকাশ করে দেশের নিরাপত্তা ভঙ্গের অপরাধে তাকে দশ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে। ২০২৪-এর নির্বাচনে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচন কমিশন মান্যতা দেয়নি। ফলে ৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার আশা পূর্ণ করে পাকিস্তানে ইমরান-হীন একটি জোট সরকার ক্ষমতায় এল।

বাংলাদেশের সবশেষ নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়েও অনেক দিন ধরেই আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তি চিন্তিত। ২১ সেপ্টেম্বর আমেরিকান আধিকারিক উজরা জেয়া নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পরই ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক কার্যকলাপে যে সব সরকারি আধিকারিক, শাসক বা বিরোধী দলের নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী আধিকারিকেরা বাধা দেবেন তাদের ও তাদের পরিবারের লোকজনকেও আমেরিকার সরকার ভিসা দেবে না। রাশিয়ার বিদেশ দফতরের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করেন যে অক্টোবর মাসের শেষে বাংলাদেশে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিরোধী দলের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে আলোচনা করেছেন।

১৭ অক্টোবর একটি সংবাদসূত্র জানায় যে, ঢাকা সফরে আসা আমেরিকার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি সেক্রেটারি (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) আফরিন আখতার বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী মাসুদ বিন মোমেন-কে বলেছেন যে, শেখ হাসিনার সরকারকে ৩ নভেম্বরের মধ্যে পদত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় আমেরিকান সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে ঢাকা হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়, যাতে শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করেন। ২৭ অক্টোবর ঢাকায় শাসক আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির মহাসমাবেশ, বিএনপি সমর্থকদের সঙ্গে স্থানে স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং পর দিন ২৮ অক্টোবর দেশব্যাপী হরতাল অনুষ্ঠিত হয়। ২৮ অক্টোবর হরতালের পর আমেরিকান দূতাবাস একটি বিবৃতিতে জানায় যে তারা সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য সমস্ত সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করবে।

কিন্তু পাকিস্তানের মতো জানুয়ারিতে নির্বাচনে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হল না, শেখ হাসিনাই আবার সরকার গড়লেন। এই নির্বাচন নিয়ে অবশ্যই আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি খুবই অপ্রসন্ন। এটাও সত্য যে বাংলাদেশের গত কয়েকটি সাধারণ নির্বাচন আদৌ অবাধ ছিল না এবং জনসাধারণ এ নিয়ে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিলেন। সে জন্য নির্বাচনের ছয় মাস পরে ছাত্রদের চাকরিতে সংরক্ষণবিরোধী আন্দোলন, এবং তা নিয়ে দেশজুড়ে সমর্থন ও আলোড়ন অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু সেই আন্দোলনকে সরকার পতনের সহিংস রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত করাটা স্বাভাবিক মনে হয়নি।

ফলে ছাত্র আন্দোলন পরিণত হল ভারত-বিরোধী, ইসলামপন্থী শক্তির পুনর্বাসনে, যা আমেরিকা ও পশ্চিমি শক্তির পছন্দের ছবি। ইমরান খানের মতো অপসারিত হলেন শেখ হাসিনা, বেশ কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থানে প্রশিক্ষিত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এ বারে উল্টো পথে হেঁটে এই বিতর্কিত গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে দাঁড়াল। সংবাদে প্রকাশ, শেখ হাসিনা জানিয়েছেন যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আমেরিকান সেনা ঘাঁটির অনুমোদন না দেওয়ায় এই ঘটনা ঘটানো হল।

পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে এই সব ঘটার মধ্যেই ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এ বছরেরই মে মাসজুড়ে। ভারতের নির্বাচন প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে গত সাতাত্তর বছরে কোনও সামরিক শাসন হয়নি, অনেক প্রধানমন্ত্রীই তাদের পূর্ণ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। জনসংখ্যা, আয়তন এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের মতো একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের রাজনীতি ও শাসনক্ষমতার প্রতি বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির নজর থাকাটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সাত দশকে ভারত কখনওই পশ্চিমি শক্তি অক্ষের অংশ হয়নি, বরং অনেকটাই অধুনালুপ্ত সোভিয়েট ব্লক ও বর্তমান রাশিয়ার কাছাকাছিই অবস্থান রেখেছে।

গত বছর নরেন্দ্র মোদির আমেরিকায় অবস্থানের সময় ৭৫ জন ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য একটি চিঠিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে জানান, তিনি যেন মোদির সঙ্গে আলোচনায় ভারত সরকার সংখ্যালঘু ও বিরোধীদের উপর যে নিপীড়ন চালাচ্ছে, সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, ইমরান, হাসিনার পর কি নরেন্দ্র মোদি? শেষ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। যে দু’টি প্রধান আঞ্চলিক দলের সমর্থনে বিজেপি জোট সরকার গঠন করেছে তারা নিজ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকতে পারলেই খুশি। দশ বছর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিল মোদি সংসদে পেশ করেননি। এখন ওয়াকফ বিলের সংশোধন, একক দেওয়ানি বিধি ইত্যাদিতে জোটের অন্যান্য দলের সম্মতি পরিষ্কার নয়। ইতিমধ্যে এক বড় শরিক জেডি (ইউ) জাতপাতের জনগণনার দাবি তুলেছে।

এই আবহে অগস্ট মাসে হায়দরাবাদের আমেরিকান উপরাষ্ট্রদূত জেনিফার লারসন তেলুগু দেশম প্রধান ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুর সঙ্গে দেখা করেছেন, দেখা করেছেন মজলিস নেতা ও সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েইসির সঙ্গে। এই অগস্ট মাসেই আমেরিকার ভারতীয় আমেরিকান চার্চ ফেডারেশনের ৪০টি সংগঠন ও তিন শতাধিক নেতা বলেছেন যে, ২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদির সরকার আসার পর থেকেই ভারতে খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ শুরু হয়েছে এবং আমেরিকান সরকারকে ভারতকে ‘বিশেষ চিন্তাজনক দেশ’ ঘোষণা করে উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে আহ্বান করা হয়েছে। ভারত বাংলাদেশ বা পাকিস্তান নয়, এখানে দেশব্যাপী গণ-অভ্যুত্থান তৈরি বা সামরিক বাহিনীকে কব্জায় আনা সম্ভব নয়। তবে খুবই সম্ভব, একটি জোট সরকারের ছোট দলগুলিকে প্রভাবিত করে সরকার ভেঙে দেওয়া। একেবারে ভারত দখল না হলেও টুকরো টুকরো হলেই মন্দ কী। সূত্র: ইত্তেফাক, আনন্দবাজার 



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top