জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক বিভেদ ও মতবিরোধ স্পষ্ট
রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:৩৮
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে বলে ইতোমধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও পক্ষ-বিপক্ষের বাগবিতন্ডা চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের পক্ষ থেকে দৃঢ়ভাবে বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধান কবরস্থ করে নতুন বন্দোবস্ত করা হবে। এমন বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, এ আন্দোলনে কার কী ভূমিকা তা নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে নানা বক্তব্য আসছে। ফলে আন্দোলনে অংশীজনদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এমন এক বাস্তবতায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণায় কী আসতে পারে, আদৌ জনমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন তাতে ঘটবে কিনা- এ নিয়ে অস্পষ্টতা বিরাজ করছে। রাজনীতিকরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর ঘোষণাপত্র উত্থাপনের ইতিহাস নেই। তাহলে কেন এই ঘোষণা করা হচ্ছে জানেন না তারা। অন্যদিকে ঘোষণাপত্রে সব পক্ষের মতামত থাকা জরুরি বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। বিগত ১৬ বছরের লড়াই-সংগ্রামের প্রতিফলন এই ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে বলেও মনে করেন রাজনীতিকরা।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান জানান, জুলাই ঘোষণাপত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন প্রকাশ করেছে। সরকার যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছে, তারা সব পক্ষের মতামত নিয়ে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করবে। তিনি মনে করেন, এটা একদিক থেকে ভালো হয়েছে। কারণ ছাত্ররা এই ঘোষণা করলে একপক্ষ দ্বিমত পোষণ করতে পারত। এতে বিভেদ আরও বাড়ত। এখন যা হবে তাতে সবপক্ষের মতামত থাকলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করেন তিনি।
গত ৩১ ডিসেম্বর বিকাল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে বিপ্লব আখ্যা দিয়ে ঘোষণাপত্র পাঠের সিদ্ধান্ত নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। পাশাপাশি ছাত্রদের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানকে কবর দেবেন তারা। এককভাবে এমন ঘোষণাপত্র পাঠের সিদ্ধান্ত এবং ’৭২-এর সংবিধানকে কবর দেওয়ার বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকেন। এরপর অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়ে দেন, ঘোষণাপত্রের এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি এটিকে ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তারপর ঘোষণাপত্রের
সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সমাবেশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেখানে ১৫ দিনের মধ্যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে সরকারকে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।
এসব বিষয়ে গত রবিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দলীয় সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। জানা গেছে, ওই আলোচনায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির ত্যাগ-তিতিক্ষা, গুম, হত্যা, নির্যাতন, হামলা, মামলাসহ তাদের অবদান যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত ’৭২-এর সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারেও পরামর্শ দিয়েছেন।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। এই ছাত্র-জনতা কারা? আমরা যারা গত ১৬ বছর গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি তারাই তো। লড়াই করতে গিয়ে আমাদের নেতাকর্মীসহ গণতন্ত্রকামী মানুষ জীবন দিয়েছেন। গুম-খুন, জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের নির্যাতনের পুরোচিত্র এ ঘোষণাপত্রে থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে একমত হয়ে তা করতে হবে।
সংগ্রাম-লড়াইয়ের প্রেক্ষিত উল্লেখ থাকার মতামত দিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি আসম আবদুর রব। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় পূরণের অঙ্গীকার থাকতে হবে, সংগ্রাম-লড়াইয়ের প্রেক্ষিত উল্লেখ থাকতে হবে, জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে, গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের ঘোষণা থাকতে হবে, প্রজাতন্ত্র নির্মাণে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সংস্কারের পরিকল্পনা থাকতে হবে।
জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, ঘোষণাপত্র আগে তৈরি হয়। আমরা যদি ইতিহাস দেখি বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ, তাহলে দেখব ঘোষণা পাঠ হয়েছে; ঘোষণা হয়েছে তারপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এখন জুলাই অভ্যুত্থানের কী ঘোষণা দেবেন তা আমার মাথায় কাজ করছে না। কথাবার্তায় যা মনে হচ্ছে তাদের বিষয়টা অস্পষ্ট। এই অস্পষ্ট বিষয় কেন সামনে আসছে তা আমার বোধগম্য নয়।
‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমি এটাকে বিপ্লব বলছি না। এটা জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণা। অভ্যুত্থানের পরপর ঘোষণা করলে যে আবেদন ছিল, সাড়ে চার মাস বা পাঁচ মাস পর সেই আবেদন অনেকখানি ফিকে হয়ে গেছে। তারপরও যদি এটা করা যায় খারাপ হবে না। সেদিক থেকে রাজনৈতিক দল, ছাত্র, তরুণসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে সবার মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণা তৈরি করা যেতে পারে।
সবার মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র হওয়া দরকার বলেও মনে করেন সাইফুল হক। তিনি বলেন, সরকারের উচিত হবে সবার সঙ্গে কথা বলে ঘোষণাপত্র তৈরি করা। আমি মনে করি, এই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিত হচ্ছে ষোলো বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই; ঘোষণাপত্রে সেই প্রেক্ষিত থাকা দরকার। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বা মাইলফলক থাকা দরকার। ওই সময় বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী যে মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার, গুম, খুন, নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েছে তার উল্লেখ থাকা দরকার।
গোটা আন্দোলনে মানুষের যে অধিকার মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ছিল, তার যথাযথ প্রতিফলন সেখানে থাকা চাই। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে অঙ্গীকার চাই। সব সম্প্রদায়ের অধিকারের প্রতিফলন চাই। সর্বোপরি আমরা যে একটা শোষণহীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠন করতে চাই সেটাও থাকতে হবে। অভ্যুত্থান যে জনগণের অভ্যুত্থান- এই স্বীকৃতির উল্লেখ থাকা দরকার। সূত্র: আমাদের সময়
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।