শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১

ভোটার হওয়ার বয়স : ‘হঠাৎ' পরিবর্তন কে চায়, কেন চায়

রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ৯ জানুয়ারী ২০২৫, ১৫:২৮

ছবি: সংগৃহীত

সম্প্র্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ করা উচিত। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ মুহুর্তে এমন পরিবর্তনের সুযোগ নেই৷ এক দল ছাড়া দৃশ্যত বাকি সব দলও ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৮ রাখার পক্ষে৷ 

নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এটা নিয়ে আমরা ভাবছি না। আমাদের কোনো কমিশন বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি। কারণ, সাংবিধানিকভাবে এটা নিয়ে আমাদের আলোচনার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, সরকার যদি মনে করে, ১৭ বছর বয়সে ভোটার করা উচিত, তাহলে এ বিষয়ে সরকারকেই আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে।

নির্বাচন কমিশন কোনো উদ্যোগ নেবে না। এরপর দেশের মানুষের মতামত নিয়ে সরকার যদি আইন পরিবর্তন করে, তাহলে নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। তার আগ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী চলবে। আমরা বিদ্যমান আইনেই ভোটের প্রস্তুতি নেবো।”

ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর করা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য সম্পর্কে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সাংবিধানিকভাবে এর কোনো সুযোগ নেই। এই আলোচনাই অমূলক। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। সেটা নিয়ে এখন মন্তব্য করা উচিত হবে না।”

অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের আপত্তি, পক্ষে শুধু জামায়াত

গত ২৭ ডিসেম্বর অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘জাতীয় সংলাপ-২০২৪'-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, "ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত। তরুণরা সংখ্যায়ও বেশি। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী।

নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেওয়ার জন্য আমি মনে করি ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত। তবে যে-কোনো সংস্কারের ব্যাপারে আমি জাতীয় এবং রাজনৈতিক ঐক্যমতের পক্ষে।'' প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবের পর বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে তাদের আপত্তি জানিয়েছে। শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামী এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবের পরপরই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, "প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৭ বছর হওয়া উচিত। এর অর্থ, এখন তাহলে আবার নতুন করে ভোটার তালিকা করতে হবে। আপনি প্রধান উপদেষ্টা, প্রথমেই বলে দিচ্ছেন, ভোটারের বয়স ১৭ হলে ভালো হয়।

আপনি যখন বলছেন, তখন নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এটা ইলেকশন কমিশনের কাজ, তাদের ওপর ছেড়ে দিন। এভাবে না বলে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়টি আনা উচিত ছিল, এটি ভালো হতো। মানুষের মনে এখন বেশি করে আশঙ্কা তৈরি হবে, এটা করতে গিয়ে আরো সময় যাবে, কালক্ষেপণ হবে।

মানুষের মনে ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে, কেন যেন এই সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে। যদি কমাতে চান, সেটি ইলেকশন কমিশন প্রস্তাব করুক। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তারা আলোচনা করে আপনাদের কাছে প্রস্তাব পাঠাক। তারপর আপনারা কথা বলবেন।”

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রধান উপদেষ্টা যখন এই ধরনের কথা বলেন, তখন সংস্কার কমিশনগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এরজন্য অনেক সময়েরও প্রয়োজন, পাশাপাশি আইন ও সংবিধান সংশোধনের বিষয়ও আছে। ফলে এ দিকে না গিয়ে আপনারা ভোটার তালিকা ঠিকঠাক করে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এটা আপনাদের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা।”

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, "সংসদ সদস্য হওয়ার বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ২১ করতে চাই।” এটি করতে হলে সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করতে হবে।

জাতীয় পার্টি (এ)-র চেয়ারম্যান জি এম কাদের ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দেশে এখন যেটা আছে, সেটা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেও তাই। এটা তো বৈজ্ঞানিকভাবে ঠিক করা হয়েছে। জাতিসংঘ স্বীকৃত ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। তাহলে সে সঠিক মতামত দিতে পারবে না। আবার প্রার্থীদের ক্ষেত্রে যেটা আছে ২৫ বছর, সেটাও সঠিক। আপনাকে বুঝতে হবে, সংসদ সদস্যরাই তো মন্ত্রী হবেন। তাদের নিচে সচিবদের অবস্থান। একজন সচিব হতে কিন্তু নানা ধাপ পার হতে হয়, একটা বয়সে তিনি সচিব হন।

এখন যদি আপনি ২১ বছরের একজনকে মন্ত্রী করে দেন, সেখানে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? অল্প বয়সে বিপ্লব করা যায়, সরকার ফেলে দেওয়া যায়, কিন্তু দেশ চালাতে অভিজ্ঞতা লাগে, মেধা লাগে, বুদ্ধি লাগে। ফলে যে আলোচনাটা হচ্ছে, সেটা একেবারেই অমূলক। এর কোনো প্রয়োজন নেই।”

তবে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে জামায়াত সমর্থন করে বলে জানিয়েছেন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা বলি, তাদেরকে ভোটার করা হোক। রাস্তায় তো এরাই নেমে জীবন দিয়েছে। আপনি-আমি যেটা পারিনি, আল্লাহর সাহায্য নিয়ে এসে অসাধ্য সাধন করেছে তারা। যারা জীবন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিতে পারে, আমরা দেশবাসী তাদের ভোটের অধিকার দিতে পারি না? ফলে, আমরা চাই তারা ভোটের অধিকার পাক।”

১৭ বছর বয়সিদেরও তথ্য সংগ্রহ করবে নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন কমিশন চলতি মাসেই ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করবে। সেখানে র্বর্তমান ১৭ বছর বয়সিদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে, যারা ২০২৬ সালে ভোটার হবেন। ১৭ বছর বয়সিদের ভোটার করতে হলে ২০২৫ সালের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন করতে পারবে না নির্বাচন কমিশন। সেক্ষেত্রে ২০২৬ সালেই ভোট করতে হবে।

তবে সংবিধান ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে অনেকেই বলছেন, ১৭ বছর বয়সিদের ভোটার তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করতে হলে আইনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। ওই সনদে ১৮ বছর বছরের কম বয়সিদের শিশু এবং এর বেশি বয়সিদের প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে গণ্য করা হয়।

বাংলাদেশে শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে যারা, তারা শিশু হিসেবে গণ্য হবে। সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সি কোনো ব্যক্তি ভোটাধিকারপ্রাপ্ত হবেন না। এছাড়া ভোটার তালিকা আইন ২০০৯ অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হলে যে-কোনো ব্যক্তি ভোট দিতে পারবেন। ফলে, এসব জায়গায়ও পরিবর্তন করতে হবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসিরউদ্দিন সম্প্রতি চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, "১৭ বছর করা যাবে না- আমরা বলি নাই। সংবিধান আবার সংশোধন করতে হবে। সংবিধানে তো বলা আছে ১৮ বছর। যদি সংবিধান পরিবর্তন করে ১৭ বছর করার সিদ্ধান্ত হয়, আমরা সেভাবে কাজ করবো। আমরা সংবিধান অনুযায়ী চলি। অন্য কারো নির্দেশনায় চলি না। সংবিধানে যদি পরিবর্তন আসে, ১৭ বছর বয়সে ভোটার হবার যোগ্যতা রাখে, তাহলে আরপিও সংশোধন করতে হবে।”

ভোটার বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ

হালনাগাদের পর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন, যাতে যুক্ত হয়েছে ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ জন নতুন ভোটারের নাম। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের তথ্য জানিয়ে বলেন, দাবি ও আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। নতুন ভোটারদের নিয়ে দেশে এখন ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২ জনে।

সবশেষ ২০২৪ সালের ২ মার্চ প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় ভোটার ছিল ১২ কোটি ১৮ লাখের বেশি। তালিকায় যুক্ত হওয়া নতুন ভোটারদের মধ্যে পুরুষ ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫১৬ জন, নারী আছেন ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৪ জন। এছাড়া ৬২ জন হিজড়া। ২০২৪ সালের ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার ছিল ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। এবার খসড়া তালিকায় সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২ জন।

সেই হিসাবে ভোটার বেড়েছে দেড় শতাংশ। ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য হয়েছেন, এ বছরের হালনাগাদে তারা যুক্ত হলেন। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চূড়ান্ত হওয়ার পর বাদ পড়া ও ভোটার হওয়ার যোগ্যদের তালিকাভুক্ত করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিবন্ধন তথ্য নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। আগামী ২০ জানুয়ারি থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হবে। ৩০ জুনের মধ্যে এ কাজ শেষ করা হবে।

নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আইন অনুযায়ী চলতি বছর হালনাগাদের যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে, তা অন্তর্ভুক্ত করে হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে আগামী বছরের ২ জানুয়ারি। আর চূড়ান্ত তালিকা হবে আগামী বছরের ২ মার্চ। তিনি বলেন, যদি এর আগে জাতীয় নির্বাচন হয়, প্রয়োজন হলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ভোটার বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-র তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সির সংখ্যা এক কোটি ৬৫ লাখ ৬৭ হাজার ১৫০। ১৭ বছরের বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা আলাদা করে প্রতিবেদনে নেই। তবে গড় হিসাবে ১৭ বছর বয়সির সংখ্যা ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৩০।

ইসির তথ্যমতে, প্রতি বছর ভোটার বৃদ্ধি প্রায় প্রায় ৩২ লাখের মতো। তবে নির্বাচন কমিশন যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু করবে, সেখানে বাদপাড়া ভোটারযোগ্যদের পাশাপাশি কিন্তু ১৭ বছর বয়সিদের ভোটার করার জন্য তথ্যও সংগ্রহ করা হবে। তাদের বয়স ২০২৬ সালের ১লা জানুয়ারি ১৮ বছরে পূর্ণ হবে। ১৭ বছর বয়সিদের ভোটার করতে হলে ২০২৫ সালে ভোট করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচন বিলম্বতি হবে।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top